কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্ব অর্থনীতি : ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব

ড্যানিয়েল গ্রস [সূত্র : বণিক বার্তা, ১৬ মে ২০২৫]

বিশ্ব অর্থনীতি : ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের পরোক্ষ প্রভাব

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করেন যে উচ্চ শুল্ক আরোপ চলতি হিসাবের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। তবে সিংহভাগ অর্থনীতিবিদ মোটামুটি নিশ্চিত যে শুল্ক কখনই চলতি হিসাবের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না। কারণ নিকট অতীতে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী শুল্কহার সাধারণত বেশ নিম্ন পর্যায়েই ছিল। অধিকাংশ উন্নত দেশে গড় শুল্কহার এখনো এক অংকের ঘরে। তবু প্রশ্ন জাগতে পারে, অর্থনীতিবিদদের এ মতামতের সপক্ষে যুক্তি কী?

 

 

এক্ষেত্রে শুরুইতেই বলা যায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়, ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে প্রচলিত উচ্চ শুল্কের কথা। সেসময় উচ্চ শুল্কের কারণে কোনো দেশের চলতি হিসাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসার নজির নেই। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হুভার বিতর্কিত স্মুট-হলি শুল্ক আইন পাস করেন। এতে বিশ্ববাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি।

 

 

মূলত এ কারণে চলতি হিসাবের ওপর শুল্কের প্রভাব নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদরা এ মতে পৌঁছেছেন যে শুল্ক চলতি হিসাবকে প্রভাবিত করবে না। চলতি হিসাবে ভারসাম্যের নির্ধারক হলো একটি দেশের মোট সঞ্চয় ও বিনিয়োগের ব্যবধান। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঞ্চয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ শতাংশ। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে তা প্রায় ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি, ২৪ শতাংশে। এ দুই মহাদেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের হার প্রায় সমান হলেও সঞ্চয়ের ব্যবধান তাদের চলতি হিসাবের ভারসাম্য পার্থক্য তৈরি করে দিয়েছে। যেখানে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল জিডিপির ৪ শতাংশের কাছাকাছি, ইউরোপে একই সময়ে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত ছিল জিডিপির ২ দশমিক ৭ শতাংশ।

 
 
 

এটা নিশ্চিত যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন গত ২ এপ্রিল যে পাল্টা শুল্কের ঘোষণা দিয়ে পরে ৯ এপ্রিল স্থগিত করেছে, তার মূলে ছিল পণ্য বাণিজ্যের ঘাটতি পূরণ, যেটি চলতি হিসাবে ভারসাম্যে একটি উপাদান মাত্র। কিন্তু এর বাইরে আরো দুটি বিষয় চলতি হিসাবকে প্রভাবিত করে। তা হলো সেবার উদ্বৃত্ত বাণিজ্যের ভারসাম্য ও বিনিয়োগ থেকে আয়। যুক্তরাষ্ট্রে এ দুই খাতই তুলনামূলক ছোট ও এখান থেকে প্রাপ্ত আয়ে খুব বেশি ওঠানামা দেখা যায় না।

 
 
 

যেকোনো দেশের অর্থনীতির চলতি হিসাব পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এক. ব্যাপক হারে সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং দুই. উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিনিয়োগ হ্রাস। ট্রাম্পের শুল্কনীতি এ পরিবর্তন ঘটাতে পারে যদি এর প্রভাবে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা, বিশেষত মন্দার আশঙ্কা তৈরি হয়। দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ কমিয়ে দিতে পারে। পাশাপাশি আমদানীকৃত পণ্যের মূল্য বাড়লে ভোক্তারা তাদের ব্যয় কমাতে পারে। তখন তারা পণ্যের প্রাপ্যতা ও দামের তথ্যের জন্য অপেক্ষায় থাকবে।

 

 

তবে শিগগিরই এসব তথ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাবে সম্ভবত কয়েক মাসের মধ্যেই। কারণ ট্রাম্প প্রশাসন এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি চুক্তি এবং চীনা পণ্যের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেহেতু চুক্তি সইয়ে অতি আগ্রহী এবং আমূল কোনো পরিবর্তন আনার বিষয়ে সেভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নন, পাল্টা শুল্ক আরোপ স্থগিতের নির্ধারিত সময় শেষের আগেই তিনি আরো কিছু বাণিজ্যিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

 

যখন নীতিগত অনিশ্চয়তা হ্রাস পাবে, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত আবারো আগের মতো স্বল্প সঞ্চয় ও উচ্চ বিনিয়োগের পথে ফিরে যাবে। বিশেষত মার্কিন কোম্পানিগুলো যেহেতু এখনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতে প্রাধান্য বিস্তার করছে। ফলে চলতি হিসাবের সাময়িক উন্নতি হলেও দীর্ঘমেয়াদে চলতি হিসাবে ঘাটতি থেকেই যাবে। অন্যদিকে চীন, ইউরোপ ও জাপানের চলতি হিসাব উদ্বৃত্তই থাকবে।

 

 

তবে ট্রাম্পের শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রে চলতি হিসাবের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব না ফেললেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ভারসাম্য পুরোপুরি বদলে দিতে পারে, যেমনটা আমরা আগেও দেখেছি। ২০১৮ সালে প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন চীনের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্য রফতানিতে ধস নামে। ২১ শতাংশ থেকে তা ১৪ শতাংশে নেমে আসে। যদিও একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) চীনের পণ্য রফতানি বেড়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশের ওপরে।

 

 

তবে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য ঘাটতি কমলে সেখানেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষান্ত হতে পারেন। কারণ তার কাছে এ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ভারসাম্যই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এই দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতিকে কেন্দ্র করেই ট্রাম্প প্রশাসন উচ্চ শুল্কের পথে হেঁটেছে। এদিকে সর্বশেষ আলোচনায় উভয় দেশই অন্তত স্বল্পমেয়াদে শুল্ক কমানোর বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেছে। যদিও পাল্টা শুল্ক স্থগিতের ৯০ দিনের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বছরের শুরুতে যা ছিল, তার চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশিই থাকবে।

 

 

ফলে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পণ্য রফতানি আরো কমবে। সেক্ষেত্রে চীনের উৎপাদকরা সেসব পণ্য অন্য বাজারে, বিশেষত ইইউর বাজারে রফতানির দিকে ঝুঁকতে পারে। তবে ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে চীনা পণ্যের আমদানি বাড়লেও সেসব দেশের মোট সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ভারসাম্যে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। এসব দেশ অন্য দেশ থেকে আমদানি কমানো বা নিজস্ব রফতানি বাড়িয়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ধরে রাখবে। রফতানির দেশের তালিকায় চীনও থাকতে পারে। আবার চীনও যুক্তরাষ্ট্র থেকে কম আমদানি করবে। অন্যদিকে যেসব দেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক তুলনামূলক কম, তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত বাড়বে। তবে একই সময়ে চীন বা অন্য দেশের সঙ্গে সেসব দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য পরিস্থিতির অবনমন ঘটতে পারে।

 

 

সব মিলিয়ে সামনে বড় ধরনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ভারসাম্যের পুনর্বিন্যাস ঘটতে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় শিল্প খাতকে ব্যাপক মাত্রায় নমনীয় হতে হবে। নতুন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে হবে। একই সঙ্গে চীনা পণ্যের ব্যাপক আমদানি থেকে অভ্যন্তরীণ বাজারকে সুরক্ষা দেয়ার প্রলোভন থেকে নীতিনির্ধারকদের নিজেদের বিরত রাখতে হবে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার এসব পরিবর্তন বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে তা হবে শুল্কনীতির প্রভাবের চেয়েও আরো বিস্তৃত ও ব্যাপক।

 

 

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৫]

ড্যানিয়েল গ্রস: বোকোনি ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপিয়ান পলিসিমেকিংয়ের পরিচালক

ভাষান্তর: সাবরিনা স্বর্ণা