কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্ব অর্থনীতি : ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভীতিকর নাকি সম্ভাবনাময়?

কায়সুল খান। সূত্র : বণিক বার্তা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্ব অর্থনীতি : ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভীতিকর নাকি সম্ভাবনাময়?

পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার তীর্থভূমি যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে বড় মোড়ল। অর্থনীতির আকার ও জনসংখ্যা বিবেচনায় জাতি হিসেবে মার্কিনদের গড় জাতীয় দক্ষতা, উপার্জন সক্ষমতা ও ক্রয়ক্ষমতা সমগ্র বিশ্বে সর্বোচ্চ। ২০২৫ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রনীতি অবিশ্বাস্য রকম আক্রমণাত্মক। অভিবাসন নীতি থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মার্কিন নীতি কিংবা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নয়া শুল্কনীতি মার্কিন ইতিহাসের সব ধারা ও ঐতিহ্যকে ভেঙেচুরে ফেলেছে। ট্রাম্পের নতুন নীতি এতটাই অভূতপূর্ব যে একে নিছক বাণিজ্যনীতির আলাপে সীমাবদ্ধ রাখা যৌক্তিক নয়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী অর্থনৈতিক শক্তি।

 

 

অর্থনৈতিক সমীক্ষার ভিত্তিতে করা পরিকল্পনা ব্যতীত তাদের পক্ষে গোটা বিশ্ব ব্যবস্থাকে ঝাঁকিয়ে দেয়ার মতো ভয়ংকর ও চরম স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অসম্ভব। তাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও বাণিজ্যনীতির অতি আক্রমণাত্মক বৈশিষ্ট্য বরং ভিন্ন কোনো আশঙ্কার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—যুক্তরাষ্ট্র কি তবে নতুন কোনো অর্থনৈতিক সংকটের পূর্বাভাস পেয়েছে এবং সেই বিপর্যয় ঠেকাতেই এ অতি আক্রমণাত্মক রাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন?

 

 

 

বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দা মার্কিন অর্থনীতিকে যখন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে তখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে রক্ষা করতে ‘নয়া নীতি’ (নিউ ডিল) নিয়ে হাজির হন। তার এ নীতির ভিত্তি ছিল ‘থ্রি আর’ অর্থাৎ বেকারদের জন্য রিলিফের ব্যবস্থা করা, অর্থনীতিকে রিকভার করে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং অর্থনৈতিক রিফর্ম নিশ্চিতের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেন গ্রেড ডিপ্রেশনের মতো সংকটের পুনরাবৃত্তি না ঘটে তা নিশ্চিত করা। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সেই পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ দারুণ কার্যকর হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরিণত করে বিশ্বরাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী কেন্দ্রে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পৃথিবীর ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপ। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় এবং অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত কার্যকর পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ বিশ্ব ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক করে তোলে।

 

 

যুক্তরাষ্ট্র তার আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্কারোপ করেছে। সারা বিশ্বের অন্তত ৬০টি দেশের ওপর মার্কিন নতুন শুল্কনীতির সুস্পষ্ট বোঝা চেপেছে। তবে লক্ষ করলে দেখা যায় যে ট্রাম্প প্রশাসনের অতি উচ্চহারের শুল্কারোপ কয়েকটি বিশেষ দেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর। বিশেষত এশিয়ান কিছু দেশে ট্রাম্পের রেসিপ্রোকাল ট্যাক্সের প্রভাব অতি তীব্র। এক্ষেত্রে চীনের নাম থাকবে সবার প্রথমে। চীনের ওপর গড়ে ৮৪ শতাংশ পর্যন্ত করারোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরই আছে আফ্রিকান লেথোসো রাষ্ট্র এবং উত্তর যুক্তরাষ্ট্রসংলগ্ন ফরাসি উপনিবেশ ও দ্বীপ সাঁ পিয়ের ও মিক‌লোঁর নাম। এ দেশ দুটির ওপর করের বোঝা ৫০ শতাংশ। পরবর্তী নামগুলোর মাঝে রয়েছে কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম কিংবা শ্রীলংকার মতো এশিয়ান দেশ।

 

 

এদের ওপর ন্যস্ত করের হার ৪৯ থেকে ৪৪ শতাংশের এর মাঝে। চীন, ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে প্রযুক্তিপণ্যের বাজার সুবিস্তৃত। ভিয়েতনামের প্রযুক্তিপণ্যের বাজার প্রায় ১৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যার মাঝে ৪২ শতাংশই রফতানিনির্ভর। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার মূল রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে বৈদেশিক বাণিজ্যের বাজার প্রায় ৬৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (Bilateral Relations Fact Sheet - US Relations with China, 2023)। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের দ্রব্য ও সেবা চীনে রফতানি করে, অন্যদিকে চীন থেকে তাদের আমদানির পরিমাণ প্রায় ৪৪৭ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের। সুতরাং এখানে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যের দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক সমানুপাতিক নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে সুস্পষ্ট বাণিজ্য ঘাটতি লক্ষণীয়। এমন পরিস্থিতিতে উভয় দেশই নিজেদের বাণিজ্য স্বার্থরক্ষা করতে বদ্ধপরিকর এবং চীন-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।

 
 
 

ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৯০৯ সালের পর সর্বোচ্চ। এটি বিগত এক শতকের অধিক সময়ের বিশ্ববাণিজ্যের চলমান রীতিনীতিকে ভেঙেচুরে দেয়ার মতো এক বাণিজ্যযুদ্ধের সূচনা করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এ বাণিজ্যনীতি একদিকে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক, একই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যের জন্য বিপজ্জনক। বিশেষত বিশ্বের সবচেয়ে ‘স্ট্যাবল ইকোনমিক জোন’ হিসেবে স্বীকৃত ইউরো জোন তথা সমগ্র ইউরোপ ট্রাম্পের হাইপার ট্যাক্সেশনের ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যা সর্বোপরি ইউরোপের ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আক্রান্ত করতে পারে, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা ভেঙে পড়তে পারে এবং ইউরোপে স্বৈরতান্ত্রিক নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

 

 

বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো উদ্বিগ্ন এবং তারা ইউরোপের জন্য আত্মরক্ষার্থে একটি পথ খুঁজে বের করতে বদ্ধপরিকর। ইউরোপের সম্ভাব্য এ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিতে চীন ও রাশিয়া নতুন করে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেতে পারে। আধুনিক বিশ্বে এ প্রভাব মূলত বাণিজ্যিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার নামান্তর। যেখানে ভূমি দখলের প্রয়োজন নেই, অথচ বাণিজ্য তথা বাজার দখলের মাধ্যমে একটি ভূখণ্ডের ওপর সামগ্রিক কর্তৃত্ব স্থাপন করার পরিপূর্ণ সুযোগ রয়েছে। এ নব্য উপনিবেশিকতা আরো ভয়ংকর; এর ফলে মার্কিনদের দায়হীন অর্থনৈতিক শাসনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন কিংবা অর্থনৈতিক শোষণের অবারিত সুযোগ তৈরি হতে পারে।

 
 
 

সমগ্র বিশ্বে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মোড়লগিরির অন্যতম প্রধান হাতিয়ার মার্কিন মুদ্রার এ শক্তিশালী অবস্থান ও মূল্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে প্রথাগত বিকল্প মুদ্রার পাশাপাশি ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রভাব ও ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন এ বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। মার্কিন স্টক মার্কেটে সাম্প্রতিক সময়ে একটি বড় ধরনের মোমেন্টাম শক লক্ষণীয় হয় (The Bitcoin Boom and Easy Money, WSJ, December 5, 2024)। এর ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর চিপ নির্মাতা এনভিডিয়াসহ অসংখ্য মার্কিন কোম্পানি অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করেছে।

 

 

ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় মার্কিন শীর্ষ টেক কোম্পানির কর্ণধারদের উপস্থিতি ও প্রভাব সমগ্র বিশ্বকে একটি ইংগিত প্রদান করে। একই সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে সমগ্র বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের প্রকাশযোগ্য ও বৈধ তথ্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ তথ্য আইনের কাঠামোর মধ্য দিয়েই ব্যবহার করতে পারে এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যবহার করার অধিকার রাখে। মার্কিন প্রশাসনে ইলোন মাস্কের মতো শীর্ষ ধনী ও ব্যবসায়িক ব্যক্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া বিষয়টিকে আরো খোলাসা করে দেয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দেশটিকে হাইপার-ক্যাপিটালিজমের দিকে ট্রানজিশনাল শিফট করার সম্ভাব্যতা ক্রমে প্রকাশ্য হতে শুরু করেছে।

 

 

এ বছরের জানুয়ারিতে কলম্বিয়ান পণ্যের ওপর ফ্লাট ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ফেব্রুয়ারির শুরুতে চীনের পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং কানাডা-মেক্সিকান পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্কারোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেশগুলোও পাল্টা শুল্কারোপ করে মার্কিন পণ্যের ওপর। এ পর্যায় পর্যন্ত বিষয়টি সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে সরাসরি ব্যাপক প্রভাব ফেলেনি। যদিও ইউরোপ, চীন ও এশিয়ান দেশগুলো ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে তখনই কিছুটা আঁচ পেতে শুরু করে। ৩ এপ্রিল মার্কিন প্রশাসন ব্যাপকার্থে নতুন শুল্কনীতি ঘোষণা করলে সমগ্র বিশ্ব নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। বস্তুত ট্রাম্পের এ নতুন পাল্টা শুল্কনীতি চীন, ইউরোপ ও এশিয়ান দেশগুলোর অর্থনীতিতে বড় একটি ঝাঁকি দিয়েছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের নানা দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের মাঝে ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণে একটি অদৃশ্য ঐক্য তৈরি হয় এবং তার প্রভাবে ট্রাম্প প্রশাসন ৯ এপ্রিল চীন ছাড়া বিশ্বের অন্য দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্কনীতি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। এখানেই লুকিয়ে আছে নতুন সম্ভাবনার সূত্র।

 

 

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে ট্যারিফ যুদ্ধের সূচনা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফলে দেশটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত অন্য সব রাষ্ট্র মার্কিনদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের একটি বৈধ ভিত্তি পেয়ে গেছে। চীনে উৎপাদিত পণ্যের ওপর মার্কিন সরকারের অতিরিক্ত করারোপের ফলে চীনে উৎপাদিত যেকোনো দ্রব্য মার্কিনদের পক্ষেও সস্তায় কেনা সম্ভব হবে না। তাদের সরকার নিজ দেশের মানুষের পকেট কাটলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ভোক্তাদের তরফ থেকেও ট্রাম্প সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ আসবে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে মার্কিন সরকার নিজ নাগরিকের ওপর ব্যাপকার্থে বল প্রয়োগের সুযোগও পাবে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি দ্রব্যের ওপর বিশ্বের অন্য দেশগুলোও পাল্টা শুল্কারোপের শর্ত দেখিয়ে নেগোশিয়েশনের সুযোগ পাবে। তাই ট্রাম্পের এ শুল্কনীতি যেমন আতঙ্কের, একই সঙ্গে নতুন সম্ভাবনারও।

 

 

বর্তমান সময়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন ও ইউরোপের শক্তিশালী অবস্থান, ভারত-ব্রাজিলের মতো নতুন অর্থনৈতিক বাজার ও শক্তির উদ্ভব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও একক নায়ক হয়ে উঠতে দেবে না। বরং সারা বিশ্ব যদি ডলারের বিকল্পের সন্ধানে একত্রিত হয় সেটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর পরিণতি হলো বিশ্ববাণিজ্যের ওপর তাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান এবং সম্পূর্ণ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের সূচনা। তেমনটি হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেবল বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মোড়লগিরির ক্ষমতা হাতছাড়া করবে না বরং সামগ্রিকভাবে বিশ্ব ব্যবস্থার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা হারাতে শুরু করবে। এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছায় শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার চাপ অনুভব করতে পারে, কেননা চলমান শুল্কযুদ্ধে তার পরাজয়ের মূল্য হতে পারে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।

 

 

২০২৫ সালের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে মার্কিন ইতিহাসে ২০০১ সালের পরে সর্ববৃহৎ ট্রেজারি শক লক্ষণীয় হয়েছে (US Economic Outlook, April 2025)। একই সঙ্গে মার্কিন ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটেও অস্থিতিশীলতা সুস্পষ্ট, প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি এবং সর্বোপরি ভোক্তাদের আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস এবং শ্রমবাজারের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের নানা অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে সামনে নিয়ে আসছে। ফলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে আসন্ন দিনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে একটি সম্ভাব্য স্থবিরতার নিদর্শন সম্পর্কে মার্কিন সরকার জ্ঞাত এবং সম্ভবত সেই অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলা করতেই অস্বাভাবিক হারে পাল্টা শুল্কারোপের মতো চরমতম অপ্রথাগত পথে হাঁটছে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ১৯৩০ সালে বিশ্বব্যাপী যে বড় ট্যারিফ যুদ্ধ হয়েছিল তাতে যুক্তরাষ্ট্র চরমভাবে পরাজিত হয়।

 

 

ঠিক এ মুহূর্তের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সুস্পষ্টভাবে ট্রাম্পের নয়া রাষ্ট্রনীতির প্রভাব মার্কিনদের জন্য ভয়ংকর কিংবা আত্মঘাতী কিনা সেটা বলা যৌক্তিক নয়। কিন্তু একটি বিষয় সম্ভবত সুস্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্র বনাম সমগ্র বিশ্ব বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব ও পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী হতে চলেছে। এটিই বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন পথের সন্ধান করে দিতে পারে। অতিরিক্ত রকমের মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরতা এবং মার্কিন ডলারের প্রভাব থেকে সমগ্র বিশ্ব বেরিয়ে আসতে পারলে সেটি বিশ্বব্যাপী ভোক্তা ও ব্যবসায়ী উভয় শ্রেণীর জন্যই বেশ স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসবে।

 

 

কায়সুল খান: গবেষক, নোভা স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস

লিসবন, পর্তুগাল