বিশ্বায়নের পথে নানামুখী বেড়াজাল
আব্দুল বায়েস [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৩ মে ২০২৫]

বিশ্বায়ন নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জগদীশ ভগবতীর চিত্তাকর্ষক মন্তব্য এখনো মনে গেঁথে আছে, যা আমার পাঠকের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না। বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশ্বায়নবিরোধী অবস্থানের কারণে আমাকে প্রায় মৃত বিষয়টি তুলে ধরতে হচ্ছে। ‘ম্যানহাটান’ ছায়াছবিতে উডি অ্যালেনের চরিত্রটি একটি হোটেলে ঢুকে ভয়ানক পচা খাবারের সন্ধান পায়। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকানোর পর ভ্রুকুঞ্চিত উডি অ্যালেন বিড়বিড় করে বলে, ‘তা-ও তো দেখছি খুব বেশি নেই।
দুই
তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিচ্যুতি হচ্ছে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের অবমূল্যায়ন করার কাজটি। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণের প্রতি উদাসীনতা এবং যথাযথ পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভালাভের হিসাবের প্রকট অনুপস্থিতি শুধু বেদনাদায়ক নয়, বড় ধরনের বিপত্তিরও উৎস হতে পারে। এ নিয়ে অনেক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, তবে খুব সংক্ষেপে একটি ঘটনার কথা বলতে হচ্ছে।
তিন
যাক সে কথা। আমরা সবাই জানি যে বৈশ্বিকীকরণ বা বিশ্বায়নের স্তর ও মাত্রা অতি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং আমরা এও জানি যে অর্থনৈতিক অখণ্ডতার সুযোগে দেশগুলো পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করে। ভগবতীর মতে, বিশ্বায়নের এই প্রবণতা নতুন কোনো ঘটনা নয়, এমনকি শত বছর আগেও জাতিগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক যোগসূত্রতার কথা শোনা যায়। তবে হয়তো বা তা বর্তমানের মতো এত গভীর ও বহুমুখী ছিল না। উদাহরণস্বরূপ, অতীতের তুলনায় ইদানীং অপ্রত্যাশিতভাবে পণ্য ও আর্থিক বাজারে সংযোগ বেড়ে চলেছে (সম্ভবত কিছুদিন আগেও ঐতিহাসিক সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থান করছিল)। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, আগের চেয়ে বর্তমানে পুঁজি ও পণ্য বাজার অধিকতর বেগবান হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আরো তিনটি উৎস বর্তমান বিশ্বায়নের ১০০ বছরের আগের বিশ্বায়নের চেয়ে ভিন্নতর বাণিজ্যকৃত পণ্য উৎপাদনের একটি বড় অংশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে, সেবামূলক পণ্যের বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং উৎপাদন ও বিশেষ করে বাণিজ্যে বহুজাতিক কম্পানিগুলোর উপস্থিতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বহুজাতিক কম্পানির আগমন প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে ১০০ বছর কেন, ৩০০ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আগমন প্রকৃতপক্ষে ব্রিটেনকে ভারত আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করেছিল। অন্যদিকে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ইন্দোনেশিয়ায় প্রবলভাবে প্রভাব রেখেছিল। যা হোক, সংযোগকে আগের চেয়ে আরো ব্যয়সাশ্রয়ী করার জন্য এরই মধ্যে পরিবহন খরচ তীব্রভাবে কমে যেতে শুরু করেছে। যেমন—নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনে তিন মিনিটের টেলিফোন কলের দাম ১৯৩০ সালের ২৩০ ডলার থেকে বর্তমানে কয়েক সেন্টস মাত্র দাঁড়িয়েছে।
ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থার সংখ্যা ১৯৮৬ সালের পাঁচ হাজার থেকে বর্তমানে কয়েক কোটি। এর পেছনে কাজ করেছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশেষত বিমান ও জাহাজ পরিবহন ক্ষেত্রে। সুতরাং বিশ্বায়নের বলে শুধু আন্তর্দেশীয় বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে তা নয়, সে বাণিজ্য আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ওপরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রবৃদ্ধির ওপর বাণিজ্যের প্রভাব পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ এবং অর্থনৈতিকভাবে অর্থবোধক হয়ে উঠছে এই অর্থে যে যদি বাণিজ্য-জিডিপির অনুপাত ২০ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়, প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি বাড়ে ০.৫-১ পয়েন্ট। হেকসার-ওহলিন তত্ত্ব অনুযায়ী বাণিজ্যের ফলে শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রেক্ষাপটে আমদানি উদারীকরণের উপকরণের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
চার
বিশ্বায়ন দরিদ্রদের জন্য আশীর্বাদ, না অভিশাপ—এই প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি আজ সর্বত্র আলোচিত। যারা বিশ্বায়নকে অভিশাপ হিসেবে দেখে, তাদের যুক্তিগুলো মোটেও অগ্রাহ্য করার মতো নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কথাটি ধরা যাক। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশ্বায়নের একটি বিরূপ প্রভাবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক সূত্র বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে নাকি ১০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, যার অর্থ দাঁড়ায় প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন (বাজারমূল্য ২৫০ কোটি ডলার বা জিডিপির ২-৩ শতাংশ) খাদ্য উৎপাদন কমে যায়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কেউ যদি বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাকে কি দোষ দেওয়া যায়?
তবে বিশ্বায়ন নিয়ে উন্নত ও অনুন্নত উভয় দেশেই প্রচুর বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এমনকি ধনী বিশ্বের কেউ কেউ মনে করে যে বৈশ্বিকীকরণের ফলে ধনী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন—অনুন্নত বিশ্বে সস্তা শ্রম দ্বারা তৈরি পণ্যের প্রবাহ তাদের আপেক্ষিক সুবিধাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে যে তাদের দেশের অদক্ষ শ্রমিক চাকরি হারাতে বসেছে; যেমন—বর্তমান আমেরিকায় চলমান অভিযোগ এবং বাণিজ্য বাধা। যুক্তিতর্ক শেষে কথা একটিই, আর তা হচ্ছে বৈশ্বিকীকরণ ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে গ্রাস করছে গরিবকে। সুতরাং বিশ্বায়ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর বিপরীতে বিশ্বায়নের সমর্থকদের যুক্তি হচ্ছে, দেশগুলোর মধ্যকার ক্রমবর্ধমান যোগাযোগের কারণে, বিশেষত চীন ও ভিয়েতনামে দারিদ্র্য ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। ইউরোপের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেনে উঠে আয় বৃদ্ধিতে সামর্থ্য অর্জন করেছে এবং আফ্রিকা মহাদেশের কিছু দেশের জন্যও তা আশার আলো দেখাতে শুরু করেছে।
তবে এটি সত্য যে যদিও বিশ্ববাজারের বিস্তৃতি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভালো করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু যেসব নিয়ম-কানুন বা বিধি-নিষেধ পেরিয়ে উন্নত দেশের বাজারে প্রবেশ করতে হয়, তাতে সে উদ্দেশ্য তো সফলতা পায়ই না, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চাহিদা, বিশ্বব্যাংকের কঠোর নিয়মানুবর্তিতামূলক নির্দেশ, আইএমএফের শর্ত এবং অর্থবাজারের আস্থা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা—এসব বহুমুখী বেড়াজালে পড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তাদের নিজস্ব পথ ও পাথেয় প্রণয়ন করার অবকাশ থেকে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে যে বৈশ্বিকীকরণের বিরুদ্ধে যুক্তিগুলো দরিদ্র দেশের সমস্যা সমাধানে অসমর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে দাতা দেশগুলোর ভুল উপদেশের ওপর গ্রথিত। এর ফলে কেন্দ্রে থাকা (সেন্টার) ও কেন্দ্র থেকে দূরে থাকা (পেরিফারি) দেশগুলোর মধ্যকার ব্যবধান ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাঁচ
তবে আমরা মনে করি, উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্যের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারণ বিশ্বায়ন যেমন বহুবিধ, দরিদ্র মানুষও তেমনি কোনো সমজাতীয় গোষ্ঠী নয়। লিঙ্গ, অঞ্চল, পেশা, জমির মালিকানা, বাসস্থান, শিক্ষা, অবকাঠামোগতে সুযোগ এবং এমনকি পরিধানেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তীক্ষ বিভাজন বিরাজ লক্ষ করা যায়। সুতরাং এটি ভাবাই স্বাভাবিক যে বিশ্বায়ন বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর বিভিন্ন উপায়ে এবং বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাব ফেলবে। আবার বিশ্বায়নের কোনো একটি উপাদান উপকারী হলেও অন্য একটি উপাদান অপকারী হতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিশ্বায়ন এক মাত্রিক কোনো ধারণা নয়। বিভিন্ন উপাদান নিয়ে বৈশ্বিকীকরণ প্রবাহিত; যেমন—বাণিজ্য, অর্থ, সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিগত সেবা ইত্যাদি। আরো মনে রাখা দরকার যে এমনকি অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়নের বহুমাত্রা রয়েছে—বাণিজ্য, দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ, স্বল্পকালীন পোর্টফলিও বিনিয়োগ প্রবাহ ইত্যাদি। আবার এর সঙ্গে আছে আইনি-বেআইনি অভিবাসন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর। এগুলো সাংস্কৃতিক বা যোগাযোগজনিত বিশ্বায়ন থেকে আলাদা প্রভাব নিয়ে হাজির হয়, যদিও সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন দ্বারা প্রভাবিত এবং যোগাযোগজনিত বিশ্বায়ন অর্থনৈতিক বিশ্বায়নকে গভীরতর করে।
ছয়
এবং সব শেষে এযাবৎকালের দেশভিত্তিক রিগ্রেশন থেকে সাধারণভাবে যে মন্তব্যগুলো এসেছে, তা নিতান্তই বিশ্বায়ন ও দারিদ্র্যের মধ্যকার অনুবন্ধ, কার্যকর সমৃদ্ধ বা অনুঘটক নয়। বিশ্বায়নবাদীরা মনে করে, সাম্প্রতিককালের ব্যাপক অর্থনৈতিক অখণ্ডতার ফলে চীন ও ভারতে দারিদ্র্যের মাত্রা বেশ কমেছে। কিন্তু এর পেছনে যে অভ্যন্তরীণ উপাদান; যেমন—অবকাঠামোর বিস্তৃতি অথবা ১৯৭৮ সালের বড়মাপের ভূমি সংস্কার, পল্লী থেকে নগরে অভিবাসনের ওপর বিধি-নিষেধ শিথিলকরণ, সবুজ বিপ্লব, সামাজিক আন্দোলন কিংবা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি (বিশেষত ভারতে) বড় ভূমিকা রাখেনি, সেটি জোর দিয়ে বলা যাবে না।
অন্যদিকে বিশ্বায়নবিরোধীদের বক্তব্য হচ্ছে, একই শতাব্দীতে সাব-সাহারান আফ্রিকায় কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এমনও হতে পারে যে এর পেছনে বিশ্বায়নের কোনো প্রভাব নেই, প্রভাব আছে যুদ্ধবিগ্রহ, অস্থিতিশীলতা অথবা ব্যর্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার। যেসব কারণে বিশ্বায়নের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। এটি সত্য যে সব ক্ষেত্রেই উদীয়মান বৈষম্য, ক্ষমতায়নের পরিবর্তন এবং সংস্কৃতি সংকট অবিশ্বাস সৃষ্টি করে চলেছে, তবে এর সঙ্গে ঠিক কোন অংশটি দরিদ্রের বাঁচার বিরুদ্ধে কাজ করছে, তা শনাক্ত করা কঠিন কাজ। তৃতীয়ত, বৈশ্বিকীকরণ ও দারিদ্র্য উভয় যদি বহুমাত্রিক হয়, তাহলে তাদের মধ্যকার সংযোগটিও বহুমাত্রিক থেকে যাচ্ছে। যেমন—মানবসূচকের মাত্রায় একটি দেশের উন্নতি হতে পারে, কিন্তু ক্ষুধা ও অপুষ্টির মাত্রায় সেই দেশটির অবনতি হতে পারে। সুতরাং বিশ্বায়নের মূল্যায়ন যেমন আলো থেকে অন্ধকারে পতিত হওয়ার কথা বলে, আবার একই সঙ্গে অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের গল্পও শোনায়।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়