কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্ববাণিজ্যে চলমান অস্থিরতা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়

শুল্ক আরোপ ও সুরক্ষামূলক নীতির মাধ্যমে পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চলেছে-শাহ্‌ মো. আহসান হাবীব । সূত্র : বণিক বার্তা, ০৯ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্ববাণিজ্যে চলমান অস্থিরতা দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়

শুল্ক আরোপ ও সুরক্ষামূলক নীতির মাধ্যমে পরিবর্তিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চলেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিশোধ, মূলধনের প্রবাহ এবং বিনিময় হার নির্ধারণ সবই একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে ঘটে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার ইতিহাসের ‘যুদ্ধান্তরকাল’ (প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কাল) এবং সেই সময়ের অর্থনৈতিক পরাশক্তিদের ‘প্রতিবেশীকে দরিদ্র করার নীতিমালা’র কথা।

 

 

 

‘যুদ্ধান্তরকাল’ সময়কালে অনেক অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বিনিময় হারের অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছিল। মুদ্রা প্রবর্তন স্বর্ণ দ্বারা সমর্থিত ছিল না এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো স্বতন্ত্র মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছিল। এ সময়কাল ছিল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্যযুদ্ধ, অতি মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং জোরপূর্বক মুদ্রার অবমূল্যায়নের মাধ্যমে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের অর্থনীতিগুলো ১৯৩০-এর মহামন্দার মুখোমুখি হয়, যার ফলে তীব্র অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নিম্ন মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাপক হারে বেকারত্ব দেখা দেয়।

 

 

মার্কিন নেতৃত্বাধীন বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়াগুলো কি আমাদের আবার সেই অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে? বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ অবস্থায় সতর্কতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে?

 
 
 

যুদ্ধান্তরকালে অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নাটকীয়ভাবে বেড়েছিল। ওই সময় বৈদেশিক বাণিজ্য শুল্ক বেড়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায় এবং আমদানি কোটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র পুরোটা সময়জুড়ে উচ্চ শুল্কহার বজায় রাখে। অনেক দেশ পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদের শুল্ক অনেক বাড়িয়ে তোলে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বপণ্যের দামের পতন ও রফতানি আয়ের ধসের মুখে নিজেদের রক্ষা করতে নিয়ন্ত্রণ এবং সুরক্ষামূলক নীতিতে ঝুঁকে পড়ে। অনেকেই শুল্ককে আয়ের উৎস এবং শিল্প সুরক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে।

 
 
 

আমদানি কোটা, লাইসেন্সিং ও বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্যিক লেনদেন নীতির অংশ হয়ে উঠেছিল ওই সময়। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে মুক্ত বাণিজ্যপন্থী অর্থনীতিগুলোও নিয়ন্ত্রণপন্থী নীতি গ্রহণ করা শুরু করে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য দ্রুত কমতে থাকে এবং অর্থনৈতিক মন্দা আরো গভীর হয়। অর্থনৈতিক সংকোচনের মুখে অনেক দেশ নিজেদের প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য আমদানির ওপর প্রতিবন্ধকতা বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করে।

 

 

বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মুদ্রার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিশ্ববাণিজ্য তথা আন্তর্জাতিক মুদ্রাপ্রবাহে প্রভাব ফেলেছিল বড় আকারে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতি খণ্ডিত হয়ে পড়ে এবং অনেক রফতানিমুখী উন্নয়নশীল দেশ ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ে। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনেক দেশেই মুদ্রা অরূপান্তরযোগ্য হয়ে যায় এবং রফতানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। সরকার এ বৈদেশিক মুদ্রা মূলত আমদানির জন্য বরাদ্দ করত। ফলে ১৯৩৫ সালের মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতি কয়েকটি বাণিজ্য জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যেমন স্টার্লিং জোট, ডলার জোট এবং জার্মানি নিয়ন্ত্রিত ক্লিয়ারিং জোট। তখনকার বাণিজ্য ছিল দ্বিপক্ষীয় ও নিয়ন্ত্রিত, যা প্রথাগত স্বর্ণমুদ্রা যুগের বহুপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর ফলস্বরূপ মহামন্দা আরো গভীর হয়, বিশেষ করে যেসব দেশ বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল তাদের জন্য এর প্রভাব ছিল ভয়ানক।

 

 

১৯২৯-৩৯ সাল পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির ওপর মহামন্দা বিরূপ প্রভাব ফেলে। যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, সে সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে এবং অস্থিরতা তৈরি হয়। এ ব্যর্থতা যুদ্ধ-পরবর্তী সহযোগিতামূলক একটি নতুন ব্যবস্থা প্রণয়নের পরিবেশ তৈরি করে, যার ফলে ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার পত্তন হয় এবং এ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক জন্ম লাভ করে।

ইতিহাসে লক্ষ করা যায়, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছে। বিশেষ করে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার প্রবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেখানে মার্কিন ডলারকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

 

 

১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্যতা বন্ধ করে দেয় এবং বিশ্ব অর্থনীতিগুলো বাজারভিত্তিক মুদ্রাহার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এর ফলে বিনিময় হার ব্যবস্থায় একটি সার্বিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক উদারীকরণ ও বৈশ্বিকায়নের নতুন তরঙ্গ শুরু হয়। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহু দেশ মুক্ত বাণিজ্য ও উদার নীতি গ্রহণ করে, যার ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে চীনও তাদের অর্থনীতি ‘উন্মুক্তকরণ’ প্রক্রিয়া শুরু করে।

 

 

১৯৯০-এর দশক ছিল এক অসাধারণ বৈশ্বিকায়নের যুগ। এ দশকে বিশ্ববাণিজ্য-সংক্রান্ত উরুগুয়ে রাউন্ড শেষ হয় এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯৯৫), নাফটা স্বাক্ষরিত হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক বাজার ও মুদ্রা ইউরোর যাত্রা শুরু হয়। এসব উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল।

 

 

২০০০-এর দশকে বৈশ্বিকায়ন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও এগিয়ে চলছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আবার নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ শুরু করে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম দায়িত্ব পালনের সময়ে। এ সময়ের বেশকিছু পদক্ষেপ সরাসরি নিয়ন্ত্রণমূলক, যা বিশ্বায়নের বিপরীতমুখী ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে গৃহীত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক নীতি এবং পন্থা ব্যবসাপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, মন্দা ও বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকোচনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে পাল্টা শুল্ক, সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতে পারে। এর ফলে আমরা সম্ভবত এমন এক পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছি, যা ইন্টারওয়ার পিরিয়ড বা যুদ্ধান্তরকালের সঙ্গে তুলনীয়।

 

 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং আন্তঃসরকারি সংস্থাগুলোর প্রভাব এবং কার্যক্ষেত্রের পরিধি পরিবর্তিত হবে যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে বাধ্য করবে এবং দেশগুলোয় অর্থনৈতিক কৌশলগত বড় পরিবর্তন সাধিত হবে।

বাড়তে থাকা নিয়ন্ত্রণ বা সুরক্ষাবাদ এবং সম্ভাব্য মুদ্রা ব্যবহার সংকোচন নীতিমালা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পেমেন্ট তথা মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও ব্যবসায়ীরা আরো নিরাপদ ও ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য অর্থায়ন পদ্ধতিতে ফিরে যেতে পারে, যেমন লেটার অব ক্রেডিট বা ঋণপত্র। ঋণপত্র বিশেষভাবে কার্যকর যেখানে মুদ্রা অরূপান্তরযোগ্য, আমদানি/রফতানি সীমিত, শুল্ক হঠাৎ বৃদ্ধি পায় বা নিষেধাজ্ঞা থাকে।

 

 

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো, যারা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্বায়নের অনুসারী ছিল, তাদের এখন পুরনো বাণিজ্য অংশীদারদের (যুক্তরাষ্ট্রসহ) সঙ্গে নতুনভাবে আলোচনার পাশাপাশি নতুন বাণিজ্য মিত্র খুঁজে বের করার প্রতি আগ্রহী হতে হবে। দরকার হবে অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যাদির ক্ষেত্রে যথাসম্ভব আমদানিনির্ভরতা কমানো।

 

 

এটি আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা যে এখন দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করার সময় এসেছে। কভিড­-১৯ মহামারী আমাদের দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর অতিনির্ভরতা আমাদের কতটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। সীমান্ত বন্ধ হলে বা রফতানি সীমিত হলে দেশে খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়।

 

 

আজকের বাস্তবতা আমাদের অন্তত কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসা ও জ্বালানি সরবরাহ খাতগুলোয় স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার দিকে নির্দেশ করে। বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন, চিকিৎসা, জ্বালানি ও প্রযুক্তি কাঠামোতে বিনিয়োগ এবং স্থানীয় উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নয়নের গুরুত্ব কত বেশি। স্থানীয় ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন করলে তা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, উদ্ভাবন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে এবং আজকের এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। বিশেষ করে আমাদের দেশের কৃষি, ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য নীতিগত, আর্থিক, অবকাঠামোগত, প্রযুক্তিগত এবং বাজারসহায়তা অপরিহার্য। আর এটাই হতে পারে দেশের টেকসই অর্থনীতি ও আত্মনির্ভরতার মূল ভিত্তি।

 

শাহ্‌ মো. আহসান হাবীব: অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)