কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্বব্যাংক : বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫

ড. মিহির কুমার রায় [প্রকাশিত: জনকণ্ঠ, ২ ডিসেম্বর ২০২৫]

বিশ্বব্যাংক : বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫

বাংলাদেশের প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অসুস্থতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যে কোনো অপ্রত্যাশিত বিপর্যয়ের মুখে পড়লে আবারও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল সময়ে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে দারিদ্র্য হ্রাস করেছে। ফলে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া ৯০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাদের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, পয়োনিষ্কাশনের মতো জরুরি সেবাগুলো পাওয়া সহজ হয়েছে।

 

 

তবে ২০১৬ সাল থেকে দারিদ্র্য কমার গতি ধীর হয়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চরম দারিদ্র্য ১২ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মাঝারি দারিদ্র্য ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

 

 


বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালের পর থেকে তুলনামূলকভাবে কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিপথ বদলে গেছে। দেখা গেছে, প্রবৃদ্ধির সুফল পেয়েছেন ধনী মানুষেরা, ফলে আয়বৈষম্য বেড়েছে। কৃষির ওপর ভর করে গ্রামীণ এলাকাগুলো দারিদ্র্য হ্রাসে নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে গেছে। একই সময়ে শহরে দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে। ২০২২ সালের মধ্যে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি শহরে বাস করতে শুরু করেছেন। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জাঁ পেম বলেন, বহু বছর ধরে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে সাফল্যের জন্য পরিচিত। কিন্তু পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, জলবায়ু ঝুঁকি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় শ্রম আয়ও কমেছে। তিনি আরও বলেন, প্রথাগতভাবে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি বাড়ানো যাবে না। দারিদ্র্য কমানো এবং মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো- কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিশেষ করে যুবক, নারী এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের ব্যবস্থা করা। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে চাইলে সবচেয়ে জরুরি হবে দরিদ্রবান্ধব, জলবায়ু সহিষ্ণু এবং কর্মসংস্থান কেন্দ্রিক কৌশল নেওয়া।

 

 


প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি স্থবির। এর বদলে কম উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারী এবং তরুণেরা। প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন বেকার। আর প্রতি চারজন শিক্ষিত নারীর মধ্যে একজনের কর্মসংস্থান নেই। শহরেও, বিশেষ করে ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান তৈরি একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। ফলে শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ বিশেষ করে নারীদের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ অনেক কমে গেছে। ১৫-২৯ বছর বয়সী সব তরুণ-তরুণীর প্রায় অর্ধেক কম মজুরিতে কাজ করছেন, যা শ্রমবাজারে চাহিদা ও দক্ষতার মধ্যে অসঙ্গতির ইঙ্গিত দেয়। লাখ লাখ বাংলাদেশির জন্য দরিদ্র অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি মাধ্যম হচ্ছে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন। প্রবাসী আয় দারিদ্র্য কমাতে সহায়তা করেছে। তুলনামূলকভাবে গরিব পরিবারগুলো এটা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন। কিন্তু দেশের মধ্যে অভিবাসী হওয়া কর্মীরা শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় জীবন-যাপন করেন। যেখানে জীবনযাত্রার মান নিম্ন। আর সচ্ছল পরিবার ছাড়া আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সুযোগ নেওয়া যায় না।

 

 

 

কেননা, বিদেশ যাওয়ার খরচ খুবই বেশি। যদিও বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বেড়েছে, তবে সেখানে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে এবং উপকারভোগী নির্বাচন লক্ষ্যভিত্তিক নয়।’ প্রতিবেদনটি আরও বলছে,  ২০২২ সালে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা পাওয়াদের মধ্যে ৩৫ শতাংশই ধনী পরিবার। যেখানে অতি দরিদ্র পরিবারের অর্ধেকও এই সুবিধা পায়নি। এ ছাড়া ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বেশিরভাগ সময়েই লক্ষ্যভিত্তিক হয় না। এমনকি বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং সারে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তার সিংহভাগ অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারগুলো পায়। প্রতিবেদনে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমাতে সহায়ক হবে এমন চারটি প্রধান নীতিগত করণীয় চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- ১. উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের ভিত্তি মজবুত করা; ২. দরিদ্র এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি করে কাজের ব্যবস্থা করা; ৩. আধুনিক প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা সহায়ক বিধিবিধান তৈরি করে দরিদ্রবান্ধব বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং ৪. শক্তিশালী রাজস্ব নীতি এবং কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা শক্তিশালী করা।

 

 

 বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ সার্জিও অলিভিয়েরি বলেন, বাংলাদেশ আঞ্চলিক বৈষম্য, বিশেষ করে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য বেশ কমিয়েছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আঞ্চলিক বৈষম্য, বিশেষ করে শহর ও গ্রামের বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দারিদ্র্য মূল্যায়ন দেখিয়েছে, উদ্ভাবনী নীতি গ্রহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শহরে গুণগত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষিতে দরিদ্রবান্ধব মূল্য-শৃঙ্খল নিশ্চিত করা এবং কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসের গতি পুনরুদ্ধার ও ত্বরান্বিত করতে এবং সমৃদ্ধিতে সবার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারে।

 

 


বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে উন্নয়নের পথে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখনো রয়ে গেছে। উচ্চমূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক খাতের নাজুকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে এখনো বড় বাধা মনে করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে গুণগত কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশের সংস্কারকে এ মুহূর্তে অপরিহার্য হিসেবে দেখা হয়েছে। বিভিন্ন খাতে অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন খাতে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা এবং সমর্থন থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুলাই সেখ। প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপির ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা সমাপ্ত অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলা হয়, অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে।

 

 

 

তবে কত হতে পারে সে ব্যাপারে কোনো পূর্বাভাস দেওয়া হয়নি। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও জ্বালানি মূল্যের কারণে গত অর্থবছর মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য ঝুঁকিতে রয়েছে। ২০২২ সালে দেশের প্রতি ১০ জনের মধ্যে অন্তত চারজন হয় গরিব অথবা দরিদ্র্য হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। অন্যদিকে আয়বৈষম্যও নগর দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক বছরে দারিদ্র্য কমলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। 

 

 


প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পতনের দাবিতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জনজোয়ারের পেছনে আর্থসামাজিক বিভিন্ন কারণের মধ্যে দারিদ্র্যও একটা বড় কারণ হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। শহরমুখী মানুষের ঢল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এখন গ্রাম থেকে নগরমুখী। দেশে প্রতি চারজনে একজন শহরে বসবাস করেন। দারিদ্র্য ঝুঁকির অনুমান ছাড়াও বিশ্বব্যাংক বলেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই অর্থবছর দেশের শিল্প এবং সেবা খাতে নানা নেতিবাচক প্রভাব ছিল। শুধু গত অর্থবছরে এ কারণে চাকরি হারিয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। বছরটিতে মজুরি প্রায় ১ শতাংশ কমেছে। এতে চাকরি হারানো পরিবারগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। একই কারণে অতিদারিদ্র্য শূন্য দশমিক ৭ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে বলে ধারণা করা হয়।

 

 

 


সবশেষে বলা যায়, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে অর্থনীতির অনেক পরিবর্তন হলেও সমাজের মৌলিক সমস্যা যেমন- নারীর প্রতি বৈষম্য, যৌতুক প্রথা, মানবিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্রিক আচরণ, ভোগের প্রবণতা বৃদ্ধি, পরিবার প্রথায় অনীহা, কালো টাকার প্রভাবমুক্ত সমাজ, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, হতাশাজনক রাজনীতি, নির্বাচনের প্রতি অনীহা, সরকার-বিরোধী দল দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিষয়ে তেমন গুণগত পরিবর্তন হয়নি, যা নিয়ে সমাজ বিশ্লেষকগণ চিন্তিত। গ্রামীণ থেকে শহরে, স্থানীয় থেকে জাতীয়/আঞ্চলিক স্তরের সকল পর্যায়ে যে পরিবর্তন হয়েছে, তার সঙ্গে দেশের আদি সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থায় রয়েছে, যা কাম্য নয়।

 

 

লেখক: গবেষক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ