বিশ্বে নতুন যুদ্ধ কি আসন্ন?
নিরঞ্জন রায় । সূত্র : সময়ের আলো, ৫ জানুয়ারি ২০২৫

আমেরিকায় দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনালন্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারের শুরু থেকেই বলে আসছেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে বিশ্বে কোনো যুদ্ধ বাধত না। এ প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে দায়িত্ব নেওয়ার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বে চলমান যুদ্ধ বন্ধ করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। মানুষ তার কথায় বেশ আস্থাও রেখেছে।
কেননা প্রথম মেয়াদে, অর্থাৎ ২০১৭ থেকে ২০২০ সময়কালে ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় বিশ্ব থেকে যুদ্ধ দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয়, যে উত্তর কোরিয়া-আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাপে-নেউলে সম্পর্ক, সেই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের উদ্দেশ্যে সেখানকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার জন্য ট্রাম্প ছুটে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বিশ্বে যুদ্ধের উন্মাদনা অনেকটা কমে আসত।
ডেমোক্র্যাট দলের জো বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আর এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। উল্টো বিশ্বে নতুন করে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। প্রথমে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যায় বিশ্বের অনেক বৃহৎ দেশ। এমনকি এই যুদ্ধের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পরে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এর পর দেখা দেয় ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ, যেখানে নিহত হচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণ।
এর পাশাপাশি শুরু হয়েছিল চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা এবং অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল ছিল যেকোনো সময় এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। যে কারণেই হোক সেই উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। আপাতত চীন-তাইওয়ানের মধ্যে সংঘাতময় অবস্থার অবসান হয়েছে। এসব ছিল মূলত সরাসরি যুদ্ধ। কিন্তু এর বাইরেও কিছু ছায়াযুদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে চলছে। সব মিলিয়ে বিগত কয়েক বছর বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পার করেছে।
এসব কারণে ট্রাম্প আমেরিকার ভোটের ময়দানে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় নির্বাচনি প্রচারে যুদ্ধের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি যুদ্ধবিরোধী অবস্থানকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে ট্রাম্প উচ্চ শুল্কহার প্রয়োগ করে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে সমস্যার সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ কারণে বিশ্বে এখন একধরনের শুল্কযুদ্ধের উত্তেজনা শুরু হয়ে গেছে। এর ফলে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেছে যে ট্রাম্পের আগামী চার বছরের শাসনামলে বিশ্বে প্রকৃত যুদ্ধের দামাম থাকবে না। সেই স্থানে দেখা দিতে পারে বাণিজ্যযুদ্ধ।
কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি মনে হয় না সেভাবে অগ্রসর হবে। ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের এখনও অল্প কয়েক দিন বাকি কিন্তু অবস্থা ইতিমধ্যে পাল্টে যেতে শুরু করেছে। নতুন করে যুদ্ধের ইঙ্গিতই যেন সামনে চলে আসছে। বিশেষ করে, ট্রাম্প অফিসিয়ালি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন তাতে অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন যে বিশ্বে যদি নতুন করে কোনো যুদ্ধ শুরু হয় তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ট্রাম্প আমেরিকায় কানাডার রফতানির ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে যান। সেই আলোচনা শেষে ট্রাম্প কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম স্টেট বলে আখ্যায়িত করলেন। এটি যে তিনি কথার কথা হিসেবে বলেছেন তেমন নয়। নানা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে কানাডা আমেরিকার রাজ্যের মতো। একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ নিয়ে এ রকম মন্তব্য করায় অনেকেই হতবাক হয়েছেন। আমেরিকার সংলগ্ন প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় আমেরিকার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের বিরুদ্ধে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হয়নি। কিন্তু বিষয়টিকে কেউই ভালোভাবে নিতে পারেনি।
ট্রাম্প কানাডাকে নিয়ে এ রকম মন্তব্য করার রেশ কাটতে না কাটতেই ঘোষণা দিয়ে বসলেন যে তিনি ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন। এ ব্যাপারে তিনি ডেনমার্কের জন্য রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের মাধ্যমে এমন ইঙ্গিতই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণভার নেওয়ার ব্যাপারটি তার দীর্ঘদিনের আগ্রহের মধ্যেই আছে। এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে বিশ্বব্যাপী জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার স্বার্থে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা আমেরিকার জন্য অত্যাবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাম্প যখন প্রথম মেয়াদে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তিনি রিয়্যাল এস্টেটের ব্যবসার জন্য গ্রিনল্যান্ড ক্রয় করার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ডেনমার্কের সরকার বিষয়টিকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এই দ্বীপ বিক্রি করার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। এবার দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প আর গ্রিনল্যান্ড ক্রয়ের কথা বলছেন না, একেবারে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার কথা বলছেন। এর অর্থ হচ্ছে ইচ্ছায় না দিলে, জোরপূর্বক গ্রিনল্যান্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে নিয়ে নেবে।
গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেক ঘোষণায় ট্রাম্প জানালেন যে তিনি পানামা ক্যানেলও আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো পানামা ক্যানেলের মাধ্যমে আমেরিকা লাভবান হওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি অ্যারিজোনার ফনিক্সে অনুষ্ঠিত কনজারভেটিভ দলের এক সম্মেলনে ট্রাম্প রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পানামা ক্যানেলকে আমেরিকার কাছে ফেরত দেওয়ার দাবি জানান। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে আমরা কখনোই এই ক্যানেলকে আমেরিকার জন্য হুমকি হতে পাওে, এমন কোনো পক্ষের অধীনে থাকতে দিতে পারি না।
ট্রাম্প অবশ্য স্পষ্ট করেননি যে তিনি কীভাবে এই পানামা ক্যানেলের নিয়ন্ত্রণভার নেবেন। পানামা ক্যানেলের দখল নেওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের কারণে পানামার প্রেসিডেন্ট হোশে (জোসে) রাউল মুলিনো তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি ট্রাম্পের এমন হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন যে ট্রাম্পের পানামা ক্যানেল দখলের ঘোষণা পানামার সার্বভৌমত্বের প্রতি কোনো হুমকি হবে না। এ প্রসঙ্গে পানামার প্রেসিডেন্ট, মুলিনো দ্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেন যে পানামা ক্যানেলের প্রতি বর্গমিটার জায়গার মালিক পানামা। পানামার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা হতে পারে না।
এ কথা ঠিক যে আজ থেকে শত বছরেরও বেশি সময় আগে এই আমেরিকাই পানামা ক্যানেল নির্মাণ করেছিল, যা মূলত পানামা রাষ্ট্রের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। ১৯৭৭ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যেমে আমেরিকা পানামা ক্যানেলের নিয়ন্ত্রণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে থাকা পানামার অঞ্চল পানামা সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
২০০০ সালে এসে পানামা এই ক্যানেলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণভার ফিরে পায় এবং সেই থেকেই এই ক্যানেলের নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনা, সবকিছুই পানামার মালিকানায় আছে। ট্রাম্পের ধারণা যে আমেরিকা কোনোকিছুর বিনিময় ছাড়াই পানামা ক্যানেল নির্মাণ করে দিয়েছে। এমনকি তিনি এটাও বিশ্বাস করছেন যে এই কানেল থেকে চীনই সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে।
ট্রাম্প যেভাবে একের পর এক দেশ বা অঞ্চল দখলে নেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে চলেছেন, তাতে বিশ্বে নতুনভাবে যুদ্ধ বাধার এক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেখা দিয়েছে নতুন করে আঞ্চলিক উত্তেজনা। কানাডার বিষয়টি হয়তো কথার কথা হিসেবে ট্রাম্প বলে থাকতে পারেন। কিন্তু গ্রিনল্যান্ড এবং পানামা ক্যানেলের বিষয়টি মোটেই হালকাভাবে নেওয়ার মতো নয়।
গ্রিনল্যান্ডকে নতুনভাবে সাজিয়ে তুলতে পারলে সেখানে যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করা সম্ভব, তা ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ত্ব ট্রাম্প খুব ভালো করেই জানেন। তাই ট্রাম্প যদি সত্যিকার অর্থেই গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার জন্য অগ্রসর হন এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা হলে সেখানে যে একধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পানামা ক্যানেলের বিষয়টি আরও বেশি নাজুক এবং উত্তেজনাকর। বিশ্ববাণিজ্যে পানামা ক্যানেলের গুরুত্ব অপরিসীম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৪ শতাংশ পণ্য এই পানামা ক্যানেল দিয়েই সম্পন্ন হয়। এ কারণে পানামা সরকার এই ক্যানেলের নিয়ন্ত্রণ বুঝে পাওয়ার পর থেকে প্রায় পাঁচ বিলিয়নের ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করেছে এই ক্যানেলের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য, যাতে করে বৃহৎ আকৃতির জাহাজ এই ক্যানেল দিয়ে চলাচল করতে পারে।
ট্রাম্প যদি বিশ্বাস করেন যে এই ক্যানেল থেকে চীনের বাণিজ্যই সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে, তা হলে তিনি এই ক্যানেলের নিয়ন্ত্রণভার নিয়ে নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। পানামা সরকারও সহজে এই ক্যানেল হাতছাড়া করবেন না। সর্বশক্তি দিয়ে ট্রাম্পের এই উদ্যোগ প্রতিহত করতে চেষ্টা করবেন। পানামাকে সমর্থন করার মতো দেশের অভাব হবে না। কলোম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুসটাভো পেট্রো ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন যে পানামার সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে তার দেশ পানামার পক্ষেই থাকবে।
ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড এবং পানামা ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নে তিনি সত্যি এগিয়ে যাবেন কি না এবং এ কারণে বিশ্বে নতুন করে কোনো যুদ্ধ শুরু হবে কি না, তা হয়তো ভবিষ্যৎ বলতে পারবে। তবে ট্রাম্পের এমন ঘোষণার কারণে যে নতুন করে এক উত্তেজনার সৃষ্টি হবে তা তো ইতিমধ্যে দৃশ্যমান। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প এ রকম বক্তব্য দিয়ে বিশ্বকে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি আগামীতে সংঘাতময় বা কনফ্রনটেশনাল পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবেন বলেই ধারণা করা যায়।
অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ