বিশ্বের লাইটহাউস ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৫ মার্চ ২০২৫

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এর বাইরে বিশ্বব্যাপী তাঁর পরিচয় হলো শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশের কৃতী সন্তান। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একমাত্র ‘গ্লোবাল সেলিব্রিটি’ হলেন অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ৮৪ বছর বয়সেও তারুণ্যে ভরপুর মানুষটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তিনি যা গবেষণা করেন তা মাঠে বাস্তবায়ন করেন। বিশ্বের একমাত্র শিক্ষাবিদ, যিনি তাঁর চিন্তার ব্যাবহারিক প্রয়োগ ঘটিয়ে সফল হয়েছেন। ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, দারিদ্র্যবিমোচন, তারুণ্যের নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনীকে কাজে লাগানোর মতো তাঁর অনেক দর্শন ও চিন্তা বিশ্বকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিকালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই গোটা জাতিকে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্যারিস থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে নেমেই বলেছিলেন, গোটা বাংলাদেশ একটা পরিবার হয়ে ওঠার কথা। এরপর ওই দিন (৮ আগস্ট) বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন। যেকোনো সংকটে সব সময় ঐক্যকে গুরুত্ব দেন তিনি।
গণ-অভ্যুত্থানের পর পর দেশের ভেতরে-বাইরে যখন প্রতিবিপ্লব কিংবা নানা ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখনই তিনি ধর্ম-বর্ণ-দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে বসেছেন, সবার কথা শুনেছেন, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন খুব শক্তভাবে। রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো দাম্ভিকতা স্পর্শ করতে পারেনি নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদকে। তিনি এমনই একজন সাধারণ গুণী, যাঁর রয়েছে অসাধারণ কৃতিত্ব। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ শুরু করলেও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি প্রতিটি সেক্টরে তাঁর মেধার সাক্ষ্য রেখেছেন। যার কারণে ব্যক্তি জীবনে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মাননা।
কিছুদিন আগেও তিনি পেয়েছেন ‘নেশন বিল্ডার’ স্বীকৃতি উপাধি।
নেশন বিল্ডার : গণ-অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তকমা পেয়েছেন ‘নেশন বিল্ডার’ হিসেবে। গত ৭ ডিসেম্বর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার এই উপাধি দিয়েছে। নেচারের সেরা ১০ ব্যক্তিত্বের তালিকা ৭ নম্বরে রাখা হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। ২০২৪ সালে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের এ খেতাব দেওয়া হয়। প্রতিবেদন অনুসারে, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এরপর তাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্র সংস্কার এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। নেচারের প্রতিবেদনে ইউনূস সম্পর্কে বলা হয়েছে, ছয় দশকের কর্মজীবনে ড. ইউনূস দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য নতুন ধারণা পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অবস্থা বুঝে সমস্যার সমাধান করা ইউনূসের কাজের মূল ভিত্তি।
প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তি : সম্প্রতি বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমদের মধ্যে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের প্রভাব ও অবদান পর্যালোচনা করে প্রকাশিত হয় ‘দ্য মুসলিম ৫০০ : দ্য ওয়ার্ল্ডস ৫০০ মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল মুসলিমস’। এ তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ৫০ নম্বরে স্থান পেয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিট অ্যাওয়ার্ড : ক্রীড়া জগতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আজীবন কৃতিত্ব ও অর্জনের জন্য ২০২৩ সালে ওয়ার্ল্ড ফুটবল সামিটের (ডব্লিউএফএস) আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বছর ১১ ডিসেম্বর সৌদি আরবের জেদ্দায় এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।
চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ : ২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের ‘চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ’ পুরস্কার পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিউইয়র্কে আয়োজিত ‘উই দ্য পিপলস’ অনুষ্ঠানে তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। মানবমর্যাদা, সমতা এবং ন্যায়বিচার বৃদ্ধির জন্য তাঁর আলোকিত নেতৃত্ব এবং উদ্ভাবনের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. এনগোজি ওকনজো-ইওয়েইলা।
অলিম্পিক লরেল অ্যাওয়ার্ড : শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন ও শান্তিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০২১ সালে অলিম্পিক লরেল পুরস্কার পান শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাপানের রাজধানী টোকিওতে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই পুরস্কারে ভূষিত হন।
গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড : ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ২০১৯ সালে ‘গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।
প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম : ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন সাতজন ব্যক্তির একজন, যিনি ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার, ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম এবং ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল পেয়েছেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার : ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন।
পিফার শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র : গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৪ সালে ড. ইউনূসকে পিফার শান্তি পুরস্কার দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
কেয়ার পুরস্কার : দরিদ্র নারী ও পুরুষদের ক্ষমতায়নের জন্য ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে কেয়ার পুরস্কারে ভূষিত করেন। মুহাম্মদ সাহেবুদ্দিন বিজ্ঞান (সামাজিক অর্থনীতি) পুরস্কার, শ্রীলঙ্কা : সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য ১৯৯৩ সালে মোহাম্মদ সাহাবদিন পুরস্কারে ভূষিত হন ড. ইউনূস। আগা খান অ্যাওয়ার্ড : দরিদ্রদের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রগ্রাম ডিজাইন ও পরিচালনার জন্য ১৯৮৯ সালে জেনেভাভিত্তিক আগা খান ফাউন্ডেশন পুরস্কার পান তিনি।
স্বাধীনতা পুরস্কার : পল্লী উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড : গ্রামীণ ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে ঋণ প্রদানের জন্য একটি নতুন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রণয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৯৮৫ সালে এই পুরস্কার দেন।
র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার : ‘এশিয়ার নোবেল’ হিসেবে পরিচিত ‘র্যামন ম্যাগসেসাই’ পুরস্কার পান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ১৯৮৪ সালে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের ক্ষমতায়নে তাঁর ক্ষুদ্রঋণ মডেলের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার পান তিনি।