কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্বের সেরা বইমেলা

সূত্র : আজকের পত্রিকা, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫

বিশ্বের সেরা বইমেলা

বইমেলা শুধু বই কেনাবেচা নয়, এটা পাঠক, লেখক, প্রকাশক এবং সাহিত্য অনুরাগীদের মিলনমেলা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত সব বইমেলা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটিয়ে চলছে বছরের পর বছর। লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব ধরুন আপনি বইপ্রিয়। একজন বইপ্রিয় মানুষের খুব বেশি কিছরু দরকার হয় না। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা, সঙ্গে প্রিয় বই আর অলস অবসর।

 

 

এই আয়োজনেই মন ভরে যাবে আনন্দে। তবে এর সঙ্গে যদি আপনাকে স্ুেযাগ দেওয়া হয় পৃথিবীর বিখ্যাত সব বইমেলায় আপনি ঘুরে বেড়াবেন। দারুণ সব লেখক-প্রকাশকদের সঙ্গে হাত মেলাবেন, গল্প করবেন, বই দেখবেন এবং কিনবেন। তাহলে নিশ্চয়ই আপনি আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাবেন। সে রকম সুযোগ যদি কখনো এসে যায় তাহলে কোন মেলায় আপনি যেতে পারেন,  কেমন ধারনা পেতে পারেন তা নিয়ে বিস্তারিত এই লেখা।

 

 


বিশ্বের বৃহত্তম সাহিত্য মিলনমেলা

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন বইমেলা। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে প্রতি বছর অক্টোবর মাসে এই মেলা বই প্রকাশনা শিল্পের কেন্দ্র।  বিশ্বের প্রধান সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবেই পরিচিত। গুটেনবার্গ ১৪৫৪ সালে যখন মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন, তখন থেকেই ফ্রাঙ্কফুর্ট বই প্রকাশ এবং বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে আধুনিক ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার যাত্রা শুরু হয়। প্রতি বছর পাঁচ দিনব্যাপী এই মেলায় অংশ নেন প্রায় একশটি দেশের সাড়ে সাত হাজারেরও বেশি প্রকাশক। মেলায় স্থান পায় লক্ষাধিক নতুন বই, যার মধ্যে থাকে সাহিত্যের ক্লাসিক থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তিযুক্ত প্রকাশনা। শুধু বই নয়, কমিকস, ম্যাগাজিন, ই-বুক, অডিওবুক এবং ডকুমেন্টারি নিয়েও থাকে আলাদা আলাদা আয়োজন।

 

 


আপনি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় গিয়ে দেখবেন যে বিভিন্ন ভাষার  লেখক, প্রকাশক এবং এজেন্টদের জন্য চুক্তি ও কপিরাইট বিক্রির আদর্শ স্থান। প্রতি বছর একটি দেশকে বিশেষভাবে ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যার মাধ্যমে সেই দেশের সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার সুযোগ থাকে। মেলার শেষ দুদিন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে, সে সময় তারা বিভিন্ন বই কেনার পাশাপাশি লেখকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং অটোগ্রাফ নেওয়ার সুযোগ পান।

 

 


নর্ডিক অঞ্চলের বৃহত্তম সাহিত্য উৎসব

গোথেনবার্গ বইমেলা (এস্খঃবনড়ৎম ইড়ড়শ ঋধরৎ) সুইডেনের একটি অনন্য সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন। নর্ডিক অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ এই বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার কেন্দ্র নয়, এটি বৈশ্বিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে সুইডেনের গোথেনবার্গ শহরে আয়োজিত হয় এই মেলা। যা মূলত নর্ডিক ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যিকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।

 

 

১৯৮৫ সালে এই বইমেলার যাত্রা শুরু হয়, মূলত সুইডেনের শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক আয়োজনে রূপান্তরিত হয়েছে। গোথেনবার্গ বইমেলা সাহিত্যের পাশাপাশি সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরার জন্য বিখ্যাত। প্রতি বছর মেলায় একটি নির্দিষ্ট থিম নির্ধারণ করা হয়। এই থিমের মাধ্যমে বিশেষ সাহিত্য, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। যেমনÑ শিশুসাহিত্য, পরিবেশ, মানবাধিকার প্রভৃতি। গোথেনবার্গ বইমেলা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ আয়োজন থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন সেশন ও কর্মশালা হয়, যা শিক্ষা উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

 

 

লাতিন আমেরিকার সাহিত্য উৎসব

গুয়াদালাহারা আন্তর্জাতিক বইমেলা, যাকে স্থানীয়ভাবে Feria Internacional del Libro de Guadalajara (FIL) বলা হয়। লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বইমেলা। মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা শহরে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই মেলার আয়োজন হয়। ১৯৮৮ সালে যাত্রা শুরু এই মেলার। শিল্প, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনার এক ব্যতিক্রমী মঞ্চ। গুয়াদালাহারা আন্তর্জাতিক বইমেলার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল মেক্সিকোর সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্পকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে।

 

 

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ থেকে প্রকাশক, লেখক এবং পাঠকরা এতে অংশগ্রহণ করেন। সাহিত্য ছাড়াও, এই মেলায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প সংস্কৃতি সম্পর্কিত বই ও আলোচনা অনুষ্ঠান থাকে। গুয়াদালাহারা বইমেলা কপিরাইট এবং প্রকাশনা সংক্রান্ত আলোচনার জন্যও বিখ্যাত। যা প্রকাশক এবং লেখকদের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে চুক্তি করার আদর্শ মঞ্চ।

 

 


গুয়াদালাহারা বইমেলার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। সাধারণ পাঠকরাও এখানে বই কিনতে পারেন, প্রিয় লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে এবং বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে।

 

 

বাংলাভাষী বইপ্রেমীদের উৎসব

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এশিয়ার বৃহৎ এবং জনপ্রিয় বইমেলা। বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা এবং সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য এক বিশেষ আবেগ এই মেলা। প্রতি বছর জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতায় আয়োজিত হয় এই মেলা। ১৯৭৬ সালে এই বইমেলার যাত্রা শুরু। মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বাংলা সাহিত্য।

 

 

বাংলা ভাষার নতুন এবং পুরনো বইয়ের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক কাজগুলো মেলায় স্থান পায়। ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষার বইও পাওয়া যায়। মেলায় বিভিন্ন দেশের প্রকাশক, লেখকরাও অংশগ্রহণ করেন। প্রতি বছর একটি দেশকে ‘ফোকাস থিম’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, যার মাধ্যমে সেই দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। মেলায় পাঠকদের প্রিয় লেখকদের সঙ্গে দেখা করা, অটোগ্রাফ নেওয়া এবং সাহিত্যবিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে।

 

 

আধুনিক প্রকাশনার মঞ্চ

নিউ ইয়র্ক বুক এক্সপো যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে আয়োজিত আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানের বইমেলা। বই প্রকাশনা শিল্পের আধুনিক রূপ, ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা এবং অভিজ্ঞতা ভাগ করার গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। প্রতি বছর মে মাসে এই মেলা হয়। বইপ্রেমীদের পাশাপাশি প্রকাশক, লেখক, ডিজিটাল প্রকাশক, এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের আগমন হয় এখানে। নিউ ইয়র্ক বুক এক্সপোর শুরু ২০০০ সালে এবং দ্রুতই বিশ্বমানের প্রকাশনা মেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

 

 

মেলার লক্ষ্য ছিল বইয়ের প্রচার ও বিক্রির পাশাপাশি প্রকাশনা শিল্পের বিভিন্ন দিক এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করা। এটি শুধু বই প্রদর্শন করার মেলা নয়, বরং বইয়ের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং নতুন প্রকাশনা বিষয়ক আলোচনারও একটি মঞ্চ। নিউ ইয়র্ক বুক এক্সপো আধুনিক বই প্রকাশনাকে গুরুত্ব দিয়ে ই-বুক, অডিওবুক এবং ডিজিটাল মিডিয়া সম্পর্কিত সেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই বইমেলায় প্রকাশনা শিল্পের আধুনিক প্রযুক্তি, সফটওয়্যার এবং নতুন প্রকাশনার উদ্ভাবন নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করে।

 

 

এশিয়ার সাহিত্যিক মঞ্চ

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে প্রতি বছর বেইজিং আন্তর্জাতিক বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় চীনা সাহিত্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সাহিত্যও গুরুত্ব পায়। এই বইমেলা ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারপর থেকে চীনের প্রকাশনা শিল্পের প্রধান মঞ্চ হয়ে উঠেছে। বেইজিং বইমেলা চীনা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রসারকে গুরুত্ব দেয়। এখানে চীনা লেখক এবং কবিদের নতুন কাজের পাশাপাশি, প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের পুরনো কাজও স্থান পায়। মেলায় চীনের সাহিত্যিক ঐতিহ্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে তুলে ধরে।

 

 

 

এই বইমেলা চীন এবং অন্য দেশগুলোর সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গুরুত্বপূণ উৎসব। বিভিন্ন দেশের ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করে। মেলায় চীনের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপস্থিতি থাকে। যা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুযোগ, যেখানে তারা নতুন বই এবং গবেষণামূলক কাজের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।

 

 

সাহিত্য ও শিল্পের মোহনীয় সমাবেশ

প্যারিস বইমেলা যা Foire du Livre de Paris  নামে পরিচিত, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আয়োজিত বিশ্বখ্যাত বইমেলা। এটি শুধু বইমেলা নয়, বরং সাহিত্য, শিল্প এবং সংস্কৃতির এক বিস্ময়কর  মিলন মেলা। ১৯৮১ সালে প্যারিস বইমেলার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় । পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক বইমেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। প্যারিস শহরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে মেলাটি লেখক, শিল্পী এবং পাঠকদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় ও আলোচনার মঞ্চ তৈরি করেছে।  ফরাসি লেখক এবং কবিদের নতুন বই এই মেলাকে ঘিরে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্যারিস বইমেলা শুধু বই নয়, বরং চিত্রকলার মতো অন্যান্য শিল্পকলা প্রর্দশনের একটি জায়গা।

 

 

প্রযুক্তি ও সাহিত্যের মেলবন্ধন

টোকিও আন্তর্জাতিক বইমেলা জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর বইমেলা। এশিয়ার জনপ্রিয় বইমেলা হিসেবে পরিচিত। যেখানে প্রযুক্তি এবং সাহিত্য একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে স্থান পায়।  ১৯৫১ সালে  মেলার যাত্রা শুরু এবং তখন থেকে বিশ্বের বৃহত্তম বইমেলাগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠে । বইমেলার উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্য এবং প্রকাশনা শিল্পের প্রতি জাপানিজদের আগ্রহ বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জাপানি সাহিত্যকে পরিচিতি করা। এখানে ই-বুক, অডিওবুক, ডিজিটাল প্রকাশনা এবং প্রকাশনা প্রযুক্তির নতুন দিক নিয়ে সেশন এবং প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

 

 

মেলায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানও অংশগ্রহণ করে।

মেলাতে থাকে নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত এবং শিল্পকলা প্রদর্শনী। এ ধরনের আয়োজন বইমেলাকে সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত করেছে। মেলায় সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আলোচনা, এবং কর্মশালার আয়োজন থাকে। বর্তমানে সব মেলাতেই ই-বুক, অডিওবুক এবং নতুন প্রকাশনা প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।