কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বিশ্বশান্তি মঞ্চে আবারও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ

মোস্তফা কামাল [প্রকাশ : ইত্তেফাক, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫]

বিশ্বশান্তি মঞ্চে আবারও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ

জীবন হাতে নিয়ে কেবল দেশে নয়, সমরে-শান্তিতে বিশ্বের তরেও তারা। যার সবশেষ উদাহরণ সুদানে শান্তি মিশনে। সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালনের সময় আমাদের ছয়জন বীর শান্তিরক্ষী শাহাদতবরণ করেছে। আহত আটজন। এই আত্মত্যাগ জাতির গৌরব, গভীর বেদনারও। জাতিসংঘের পতাকা তলে বিশ্বশান্তি রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের শপথ তারা রক্ষা করেছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিপুল অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সুদানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসাধারণ পেশাদারিত্ব, সাহস আর আত্মত্যাগ দেখল বিশ্ববাসী। আহত আট জনের মধ্যে তিন জন নারী সৈন্য। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলমান রয়েছে। আটকে আছে অনেকে।

 

 


জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানো ১১৯টি দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ। বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের যাত্রা শুরু হয়। 'নীল হেলমেট' পরে বিশ্বশান্তির এ মঞ্চে বাংলাদেশের অভিষেক ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরানে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তখন জাতিসংঘের ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক মিশনে ১৫ জন সদস্য পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ১০টি দেশে শান্তির পতাকা হাতে নিয়োজিত তারা।

 

 

 

 এরই মধ্যে প্রথম বারের মতো ডিআর কঙ্গোতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনটি হেলিকপটার মোতায়েন করা হয়েছে। শুরু থেকে সুদানে সর্বশেষ ছয় জন নিহত হওয়া ছাড়াও এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর ১৩১ জন, নৌবাহিনীর চার জন, বিমানবাহিনীর ছয় জন এবং পুলিশের ২৪ জন। আহত হয়েছেন ২৭২ জন। শুরু থেকেই বিভিন্ন বৈশ্বিক মিশনে বাংলাদেশের চিকিৎসক, প্রকৌশলীরাও অংশ নিয়েছেন, যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের অবদানের একটি দুর্দান্ত স্বীকৃতি। বৈশ্বিক ফোরামে নেতৃত্বের স্মারক। আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির সঙ্গেও সম্পর্কিত। মিশনগুলো অনেক চ্যালেঞ্জে ভরা। আফ্রিকায় স্থানীয় গোষ্ঠীগত সংঘাত প্রায়ই মিশনের কার্যক্রম ব্যাহত করে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনুকূল নয় এমন জলবায়ু, সম্পদের অভাব-সব মিলিয়ে মিশন বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈশ্বিক রাজনীতির টানাপোড়েন, যা কার্যকর শান্তি রক্ষা নিশ্চিতে আরো জটিলতা তৈরি করে। তা সামলে বা মোকাবিলা করেই এগোতে হয়।

 

 


সময়ের ব্যবধানে শান্তি রক্ষা মিশনের ধরন কিছুটা পালটে যাচ্ছে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। সময়ের পরিক্রমায় শান্তি রক্ষার ইতিহাসে জাতিসংঘের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে দেশের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও বেসামরিক সদস্যরা। সংঘাতপূর্ণ বা গৃহযুদ্ধের শিকার, গণহত্যা বা গণনির্বাসনের ঝুঁকিতে থাকা দেশ বা অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়। যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা, পুনর্গঠন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি বা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়োজন, মানবিক সংকট মোকাবিলাসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী সীমান্ত অঞ্চল আবেই, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (সিএআর), সাইপ্রাস, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআর কঙ্গো), লেবানন, দক্ষিণ সুদান, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার বিরোধপূর্ণ অঞ্চল পশ্চিম সাহারা, ইয়েমেন, লিবিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দায়িত্ব পালন নানা মাত্রায় কঠিন কাজ।

 

 

 

শান্তিরক্ষীরা মিশনগুলোতে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করা, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তায় কাজ করে। অবস্থানভেদে দুই পক্ষের মধ্যে অস্ত্রবিরতির শর্ত মানা হচ্ছে কি না, তা নজরে রাখা, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘিত হলে রিপোর্ট করা, সাবেক যোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নেওয়া, তাদের সমাজে পুনঃস্থাপন করা এবং সমাজে শান্তি ও আস্থা ফিরিয়ে আনাসহ অনেক কাজ তাদের। কখনো কখনো স্থানীয় পুলিশ ও বিচারব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তাও করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণেও অংশগ্রহণ করেন শান্তিরক্ষীরা। এসব কাজ করতে গিয়ে তাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও পড়তে হয়। আবার আজীবন মনে রাখার মতো আনন্দঘন অভিজ্ঞতাও আসে। মিশনে থাকা শান্তিরক্ষীরা দেশে দেশে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করছে অবিরাম। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অপ্রতিরোধ্য সাহসিকতা, পেশাদারিত্ব ও মানবিকতার মাধ্যমে শুধু বিশ্বে দেশের মর্যাদা বাড়িয়েই চলেছে না, বাংলা ভাষাকেও করে তুলেছে শ্রদ্ধার ভাষা। তা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিয়েরা লিওন জুড়ে।

 

 


১৯৮৯ সালে নামিবিয়া মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুলিশ। এ পর্যন্ত বিশ্বের ২৪টি দেশের ২৬টি মিশনে পুলিশের ২১ হাজার ৮১৫ জন শান্তিরক্ষী সদস্য অংশগ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনটি দেশে ১৯৯ জন পুলিশ সদস্য শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন। কঙ্গো, সুদান, আইভরিকোস্ট, পূর্ব তিমুর, বসনিয়া, কসোভো, লাইবেরিয়া, হাইতি, মালিসহ বিভিন্ন দেশে সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালনকালে এ পর্যন্ত ২৪ জন পুলিশ সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে জীবন উৎসর্গ করেছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ২০১০ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশের দল পাঠিয়েছিল।

 

 

 

 আর্মড ফোর্সেস ডিভিশনের (এএফডি) এক হিসাব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৭১৮ জন নারী শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৫১৩ জন, নৌবাহিনীর ৫৪ জন এবং বিমান বাহিনীর ১৫১ জন। চলতি বছরের মধ্যে শান্তি রক্ষা মিশনে ২২ শতাংশ নারী স্টাফ অফিসার ও মিলিটারি অবজারভার নিয়োগের লক্ষ্য রয়েছে জাতিসংঘের। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ১৮-১৯ শতাংশ নারী অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন এবং এই হার আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ রয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যরা শান্তিরক্ষী মিশনে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে পুলিশের ৭১ জন নারী সদস্য নিয়োজিত আছেন কঙ্গো, দক্ষিণ সুদান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকায়।

 

 

 

১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় অন্যান্য দেশের সেনারা মিশন থেকে প্রত্যাহার করলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে সেখানে অবস্থান নিয়েছে। রক্ষা করেছে বহু প্রাণ। সোমালিয়ার মিশনে আমেরিকান সেনারা স্পষ্টভাবে বাংলাদেশি সেনাদের সঙ্গে থাকার দাবি জানিয়েছিল। বসনিয়ার বিহাচ শহরে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা হালকা অস্ত্র নিয়েও সাহসিকতার সঙ্গে গণহত্যা ঠেকাতে সক্ষম হয়, যেখানে ইউরোপীয় সেনারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা দেশের রেমিট্যান্স আয়েও বড় অবদান এই খাতের, যেখান থেকে আয় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের শান্তি মিশন সদস্যদের কাজের প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পিস অপারেশনের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়ে ল্যাক্রয়। তার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সাক্ষাতের সময় উঠে আসে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য পাঠানোর বিষয়ও। হয় তো অদূর ভবিষ্যতে তাও হবে।

 

 

 

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবদানের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রশংসায় 'শান্তির কূটনীতির মোরসাল' হিসেবে অভিহিত করেছে। শুধু যুদ্ধবিগ্রহের স্থগিতাদেশ রক্ষা বা সংঘাত প্রতিরোধ নয়, স্থানীয় জনগণের কল্যাণ, পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনে এমন ভূমিকা অন্য অনেক দেশের কোনো বাহিনীই দেখাতে পারেনি। তাদের শিক্ষা, স্কুল নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, শিশুদের শিক্ষা প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের নমুনা শেখার মতো। তাই শিখছে, অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। উপলব্ধি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি সদস্যরা কেবল অস্ত্রধারী সৈন্য নয়, মানবতার সৈনিকও। এরও একটা নেপথ্য প্রেক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ আরো শক্তিশালী হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামরিক কূটনীতিতেও সবিশেষ মনোযোগ বাংলাদেশের জন্য বিশ্বে মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

 

 

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট