কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বন্দর আন্তর্জাতিকায়ন : লাভ, ক্ষতি কার

মোহাম্মদ বি. রানা, পিএইচডি [প্রকাশ : সময়ের আলো, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫]

বন্দর আন্তর্জাতিকায়ন : লাভ, ক্ষতি কার
বাংলাদেশের তিনটি প্রধান কনটেইনার টার্মিনাল আন্তর্জাতিকায়নের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এক কঠোর জনমত বিভাজন তৈরি করেছে। ব্যবসায়ী মহল এই পদক্ষেপকে লজিস্টিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য বলে স্বাগত জানালেও রাজনৈতিক দল ও বন্দর শ্রমিক গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া প্রতিরক্ষামূলক, আবেগনির্ভর ও পশ্চাদমুখী।
 
 

 
প্রথম প্রকল্পটি লালদিয়ায় প্রস্তাবিত সবুজ কনটেইনার টার্মিনালকে কেন্দ্র করে, যেখানে ডেনমার্কের এপি মোলার প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গ্রিনফিল্ড এফডিআই হিসেবে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ১০০ শতাংশ সবুজ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্পটি কর্ণফুলী নদীর কাছে পতেঙ্গা অঞ্চলের অব্যবহৃত নদীচরে গড়ে উঠবে। এখানে বিশ্বমানের প্রযুক্তি, উচ্চ নিরাপত্তা মান এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির সমন্বয় থাকবে।
 
 
 
দ্বিতীয় উদ্যোগটি কর্ণফুলী নদীর তীরে নির্মিত নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালকে ঘিরে। ইতিমধ্যেই নির্মিত এ টার্মিনালটির কার্যক্রম ও সেবার ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে আধুনিক অপারেশনাল সিস্টেম স্থাপন ও হ্যান্ডলিং দক্ষতাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করবে।
 
 
 
তৃতীয় বিনিয়োগটি সুইজারল্যান্ডের এমএসসি গ্রুপের, যা ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশের পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল সম্প্রসারণ এবং পরিচালনার লক্ষ্য নিয়েছে। এর ফলে ভারী ট্রাক পরিবহনের ওপর নির্ভরতা কমে নিম্ন-নিঃসরণভিত্তিক নৌপথে পণ্য পরিবহন বৃদ্ধি পাবে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমাবে এবং লজিস্টিক দক্ষতা বাড়াবে।
 
 
 
এই তিনটি টার্মিনাল সম্মিলিতভাবে ২০৩০ সালের পর বাংলাদেশের রফতানি ইকোসিস্টেমকে আমূল রূপান্তরিত করবে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন-নিরপেক্ষ সাপ্লাই চেইন মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য আনবে।
 
 

বিতর্ক কোথায় ভুল পথে যাচ্ছে?
 

তথ্যনির্ভর যুক্তি ও দায়িত্বশীল আলোচনার পরিবর্তে আমরা রাজনৈতিক স্লোগান, আবেগঘন তর্ক এবং ভয়ের বর্ণনা শুনছি। অধ্যাপক, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলো একটিও যুক্তিসংগত একাডেমিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি যে এসব বিনিয়োগ কীভাবে দেশের ক্ষতি করবে, কিংবা এর চেয়ে উন্নত বিকল্প কী হতে পারে। তাদের অভিযোগের ধরন একই : বিদেশিরা বন্দর দখল করবে, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে, কর্মসংস্থান কমে যাবে। কিন্তু এসব দাবি কি বাস্তবতার পরীক্ষায় টিকে?
 

 
আন্তর্জাতিকায়নের যুক্তি কী?
 
 
পঞ্চাশ দশক থেকে কৌশলগত সম্পদ ও লজিস্টিক অবকাঠামোর আন্তর্জাতিকায়ন বৈশ্বিক ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি। প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত তিন কারণে বিদেশে বিনিয়োগ করে
 

১. সম্পদ/দক্ষতা আহরণ, স্বল্পমূল্যের শ্রম বা কৌশলগত সম্পদ পেতে (যেমন : বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে sourcing করে)।
 

২. কৌশলগত সুবিধা অর্জন লজিস্টিক দক্ষতা, উপযুক্ত ভৌগোলিক অবস্থান ও সবুজ সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করতে।
 

৩. বাজার সম্প্রসারণ নতুন ভৌগোলিক বাজারে প্রবেশ করে বিক্রয় বৃদ্ধি করতে।
 

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো অগ্রসর অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক প্রাধান্য এই নীতির ওপর দাঁড়িয়ে। তা হলে বাংলাদেশ কেন ভাববে, এসব বৈশ্বিক বাস্তবতা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়?
 

 
এই বিনিয়োগগুলো কেন গুরুত্বপূর্ণ
 
 
এপি মোলার একটি ১০০ শতাংশ ফাউন্ডেশন মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান প্রথাগত মুনাফাকেন্দ্রিক কোম্পানি নয়। তারা লালদিয়ায় বিনিয়োগ করছে যেন ডেনমার্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাপ্লাই চেইন ২০৩০ সালের কার্বন-নিরপেক্ষ বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। সবুজ বন্দর ও নবায়নযোগ্য লজিস্টিক সক্ষমতা না থাকলে ইউরোপীয় ক্রেতারা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে sourcing কমিয়ে দিতে বাধ্য হবে।
 

 
গুরুত্বপূর্ণ হলো এপি মোলার বাংলাদেশের কোনো জমির মালিক হচ্ছে না। বাংলাদেশ টার্মিনালের মালিকানা ধরে রাখছে এবং প্রতি কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাধ্যমে ৩০ বছর ধরে স্থিতিশীল আয় পাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপকরা অর্জন করবে বিশ্বমানের দক্ষতা যার জন্য দেশে বিনিয়োগের বোঝা পড়বে না।
 
 
ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং এমএসসির উদ্যোগের যুক্তিও একই পুরোনো ব্যবস্থাকে বদলে আধুনিকীকরণ, অদক্ষতা দূর করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর পরিচালন ব্যবস্থা চালু করা। ২১শ শতাব্দীর রফতানি অর্থনীতিতে দক্ষতা ও স্থায়িত্বই হলো প্রধান প্রতিযোগিতামূলক অস্ত্র।
 


এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দক্ষতাই প্রতিযোগিতার মাপকাঠি, আবেগ নয়। ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চাইলে আশি দশকের অপারেশনাল মানসিকতা দিয়ে তা সম্ভব নয়।
 

ভ্রান্ত ধারণার জবাব
ধারণা ১ : বিদেশিরা আমাদের বন্দর দখল করবে
 

ভুল। জমি ও সম্পদের মালিক বাংলাদেশই। বিদেশি প্রতিষ্ঠান শুধু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অপারেশন পরিচালনা করে গ্রিস, বেলজিয়াম, ভারত, মরক্কো, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসেও একইভাবে পরিচালিত হয়।
 

ধারণা ২ : জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে
নিরাপত্তা সংস্থাই কাস্টমস, নজরদারি ও গোয়েন্দা ডেটা নিয়ন্ত্রণ করে। যদি ডেটাই ঝুঁকি হয়, তা হলে ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউব কি এপি মোলার বা ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ে কম হুমকি?
 

ধারণা ৩ : শ্রমিকদের চাকরি যাবে
বরং লালদিয়া ও পানগাঁও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। উন্নত প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত কর্মীই হবে ভবিষ্যতের সম্পদ, রাজনৈতিক আনুগত্য নয়।
 

ধারণা ৪ : অন্তর্বর্তী সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না
যদি দুর্নীতি ও দলীয়করণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার সাংবিধানিক সংস্কার করতে পারে, তবে অর্থনৈতিক টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না কেন?

 
বাংলাদেশের করণীয় : এক মোড়ে দাঁড়িয়ে দেশ
 
তিনটি কৌশলগত পদক্ষেপ এখন জরুরি 
 

১. বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ও মেরিন একাডেমি/বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি যাতে প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা জ্ঞান দেশের ভেতরেই গড়ে ওঠে।
 
 

২. পরিচালন দক্ষতার ধীরে ধীরে জাতীয়করণ জোর করে নয়, শেখার মাধ্যমে-যাতে বাংলাদেশ নিজেই সবুজ টার্মিনাল পরিচালনায় সক্ষম হয়।
 

৩. ডেটা প্রোটেকশন আইন প্রণয়ন যাতে বন্দর-সংক্রান্ত সব ডেটা বাংলাদেশের সার্বভৌম সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে।
 

 
ভয়ের কারণে দরজা বন্ধ করা দেশপ্রেম নয়, তা আত্মবিশ্বাসহীনতার লক্ষণ। প্রকৃত দেশপ্রেম হলো বৈশ্বিক জ্ঞান, পুঁজি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতা বাড়ানো।
 
 
বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। আমরা হয় সবুজ লজিস্টিক ও বৈশ্বিক সংযুক্তির পথে এগোব, নয়তো বিতর্কের ফাঁদে পড়ে প্রান্তিক হয়ে পড়ব।
প্রশ্নটি সহজ : আমরা কি চাই বাংলাদেশ ইয়াংশান (চীন) ও কাই মেপে (ভিয়েতনাম) সঙ্গে প্রতিযোগিতা করুক নাকি চাই, অন্যরা এগিয়ে যাক আর আমরা তর্কে সময় নষ্ট করি? এখন সময় সঠিক সিদ্ধান্তের। স্লোগানে নয়-কৌশলে বাংলাদেশকে সবার আগে রাখি।