বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতির সংস্কার করতে হবে
ড. মো. আসাদুল ইসলাম । সূত্র : আমাদের সময়, ০৬ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগগুলোর মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে কীভাবে এফডিআই আকর্ষণ করা যায়, তাতে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। ড. ইউনূসের দরিদ্রবান্ধব অর্থনৈতিক দর্শন ও বৈশ্বিক জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এফডিআই আকর্ষণ এবং তা দিয়ে দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে।
যদিও দুই দশক ধরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬-৭ শতাংশ বজায় রেখেছে। তবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ প্রবাহের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এ দেশগুলো সফলভাবে বিপুল পরিমাণে এফডিআই আকর্ষণ করেছে গত দুই দশক ধরে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে একরকম ব্যর্থ বলা যেতে পারে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের (আংকটাড) অনুমান অনুসারে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের এফডিআই প্রবাহ ছিল প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। এই পরিমাণ এশিয়ার অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির তুলনায় এবং বিশাল মানবসম্পদে পরিপূর্ণ এ দেশের জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বর্তমানে দেশের বিনিয়োগ খাত মূলত টেক্সটাইল, পোশাক, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, অবকাঠামোসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত দ্বারা প্রভাবিত। বিশেষ করে টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে, যা রপ্তানি আয়ে ৮০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে। এই খাতগুলোও ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদার জোগান না পাওয়ায় ধুঁকছে!
বাংলাদেশে প্রধান বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশের মধ্যে রয়েছে জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ কোরিয়া। এ ক্ষেত্রে জাপান অবকাঠামো ও উৎপাদনে বিনিয়োগে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তৈরি পোশাক খাত এবং প্রযুক্তিচালিত উদ্যোগগুলোতে মনোনিবেশ করেছে। বিশেষ করে চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, সেতু, মহাসড়ক ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্পে অর্থায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া উৎপাদন ও টেলিযোগাযোগে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও বৈচিত্র্যময় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিপুল শ্রমশক্তি এবং কম উৎপাদন খরচসহ একটি প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ এফডিআই আকর্ষণে পিছিয়ে আছে উল্লেখযোগ্য কিছু বাধার কারণে। প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে একটি হলো আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও অদক্ষতাÑ যার ফলে অনেক দীর্ঘায়িত অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বাধা তৈরি করে। উপরন্তু দেশের দুর্বল আইনকাঠামো, চুক্তি প্রয়োগ এবং ইন্টেলেকচুয়াল সম্পত্তি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রচণ্ড অসুবিধা সৃষ্টি করে, যা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো অপর্যাপ্ত পরিবহন নেটওয়ার্ক, দুর্বল সরবরাহ সুবিধা এবং জ্বালানি সরবরাহের অপ্রতুলতা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তবু বৃহৎ পরিসরে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য আরও ব্যাপক উন্নয়ন প্রয়োজন।
এফডিআইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলোর মধ্যে একটি হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। বিশেষ করে উৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিষেবার মতো খাতে এফডিআই আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ ৩৫ বছরের কম বয়সী হওয়ায় বাংলাদেশে একটি তরুণ ও গতিশীল কর্মী বাহিনী রয়েছে, যারা বিদেশি বিনিয়োগ থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা কেবল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে না বরং দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও চালু করে, যা আমাদের দেশের অদক্ষ কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
বৈদেশিক বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো তৈরির কারণে ভিয়েতনামে স্যামসাং ও এলজির মতো কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। তাই দেশটি এখন ইলেকট্রনিকস উৎপাদনের জন্য একটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশ যদি একইভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগবান্ধব ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে ভিয়েতনামের মতো বৃহত্তর শিল্প প্রতিযোগিতা অর্জন ও অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণ করতে পারত।
শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশকে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতের বাইরেও তার রপ্তানি বৈচিত্র্য আনতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্য আনতে হলে আমাদের ইলেকট্রনিকস, ওষুধ, সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ ও অটোমোবাইলের মতো শিল্পগুলোকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, এ ক্ষেত্রে দেশীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের পাশাপাশি স্বচ্ছ এফডিআই নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন।
স্বচ্ছ এফডিআই নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। প্রথমেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা উন্নত করার জন্য কৌশলগত সংস্কার শুরু করা। দেশের বিদেশি ব্যবসা নিবন্ধন ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং প্রকল্প দূরত্ব অনুমোদনের ব্যবস্থা করে আমলাতান্ত্রিক বাধাগুলো দূর করতে হবে। নিবন্ধন সহজীকরণ বিদেশি ব্যবসাগুলোর জন্য কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করা সহজ করবে, তবে সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। বীমা ব্যবস্থার উন্নয়ন করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের ঝুঁকি হ্রাস করার ব্যবস্থাও করতে হবে। এতে করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
দ্বিতীয়ত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং ওষুধের মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোতে কর ছুটি এবং হ্রাসকৃত শুল্ক প্রদান ব্যবস্থা করে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় বিনিয়োগের গন্তব্য করে তোলা যেতে পারে। বিশ্বমানের অবকাঠামোসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) সম্প্রসারণ ত্বরান্বিত করতে হবে। ভিয়েতনামে ২০২২ সালে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি এফডিআই আকর্ষণের অন্যতম হাতিয়ার ছিল তাদের উন্নত এসইজেডের ব্যবস্থা। তাদের সাফল্য আমাদের দেশ একটি প্রতিলিপি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। তৃতীয়ত, শক্তিশালী এফডিআই সুরক্ষা আইন এবং দ্রুত বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা কমানো এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা যেতে পারে।
চতুর্থত, গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির দেশ যেমনÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, চীন ইত্যাদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি জোরদার করা। উপরোক্ত সংস্কারের মাধ্যমে আমরা এই দেশগুলোর বিনিয়োগকারীদের আমাদের দেশে নিমন্ত্রণ করতে পারি। এতে করে আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হব বাংলাদেশ কীভাবে একটি বিনিয়োগবান্ধব গন্তব্য। তাহলে আমাদের বর্তমান এফডিআই প্রবাহ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারব। পঞ্চমত, আমাদের স্থানীয় মানবসম্পদকে বৈচিত্র্যময় খাতের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উচ্চ বেতনের পশ্চিমা কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজন না হয়। এর ফলে আমাদের নিজস্ব লোকদের ওপর নির্ভর করা সম্ভব হবে, যা মেধা ও দেশীয় মুদ্রা পাচার থেকে দেশকে রক্ষা করবে।
তবে এসব সংস্কারে বর্তমান সরকার অনেক বাধার সম্মুখীন হতে পারে। তাই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কীভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় তা নিয়ে এখন আলোকপাত করব। প্রথমত, একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, যা নিবন্ধন, বিনিয়োগ অনুমোদন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে ধীর করে দেয়। দীর্ঘ অনুমোদন প্রক্রিয়া বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে, যার ফলে মূলধন বহির্মুখী প্রবাহ ঘটে। তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) যুগে ডিজিটাইজড অনুমোদন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোকে সহজতর করতে হবে; যার ফলে এ দেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা ও শুরু করা সহজীকরণ হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দুর্বল অবকাঠামোর দ্রুত উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলভিত্তিক রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে হবে, যাতে করে বিদেশি ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের জন্য উদ্বেগের বিষয়, কারণ ক্রমাগত বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন এবং সুশাসনের অনিশ্চয়তার ঝুঁকি তৈরি করে। তাই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সুরক্ষা আইন এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক নীতির মতো নীতি ধারাবাহিকতার নিশ্চয়তা প্রদান বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে পারে।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের অভাবে ভুগছে। প্রশিক্ষিত শ্রমিকের অভাবে ভারী ও প্রযুক্তিজাতীয় বিদেশি ব্যবসাগুলো এ দেশে বিনিয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। তাই এখনই সময় আমাদের অদক্ষ শ্রমিকদের দ্রুত দক্ষ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার। এ ক্ষেত্রে ভারী ও প্রযুক্তি শিল্পকেন্দ্রিক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সম্প্রসারণ খুব কাজে লাগতে পারে। প্রয়োজনীয় দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত এ দেশের মানবসম্পদ বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে পারে।
এভাবেই এ দেশ হয়ে উঠতে পারে বৈদেশিক বিনিয়োগের এক অনন্য শক্তিশালী সম্ভাবনাময় অঞ্চল, যে অঞ্চলে মানবসম্পদের কোনো অভাব নেই। তাই এই সম্পদকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হলে এই সরকারকেই বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগ নীতির দ্রুত সংস্কার করতে হবে।
ড. মো. আসাদুল ইসলাম : সানওয়ে বিজনেস স্কুল, সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া