বৈশ্বিক হুমকি প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলা করতে হলে
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক । সূত্র : বণিক বার্তা, ০৪ মার্চ ২০২৫

স্টিক দূষণ এমন একটি বৈশ্বিক হুমকি, যা পৃথিবীর কোনো স্থানকেই ছাড় দেয়নি। মরুভূমি থেকে কৃষিজমি, পাহাড়-পর্বত থেকে গভীর সমুদ্র, গ্রীষ্মপ্রধান (ট্রপিক্যাল) ল্যান্ডফিল থেকে আর্কটিকের বরফ, সবখানেই প্লাস্টিক দূষণের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্লাস্টিক দূষণ তখনই পরিবেশে জমা হয় যখন এর প্রবাহ প্রাকৃতিক অপসারণ প্রক্রিয়া বা পরিষ্কার কার্যক্রমের তুলনায় বেশি হয়। প্লাস্টিক অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী, যার প্রাকৃতিক অপসারণে দশক থেকে শতাব্দী পর্যন্ত সময় লাগে। দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকাগুলোয় এ দূষণ পরিষ্কার করা প্রায় অসম্ভব। ফলে এটি অপ্রত্যাবর্তনযোগ্য দূষণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।
২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে প্রতি বছর ৯-২৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক নদী, হ্রদ ও সমুদ্রে পৌঁছে যাচ্ছে। স্থলভাগেও এর দূষণ কম নয়, প্রতি বছর প্রায় ১৩-২৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক জমা হচ্ছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সংকট মোকাবেলায় বাসেল সম্মেলনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়া উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও প্লাস্টিক দূষণের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ দূষণ যদি প্রভাবের সীমা অতিক্রম করে, তবে তা এমন নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে যা সহজে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তাই প্লাস্টিক দূষণের প্রবাহ কমানোর জন্য তাৎক্ষণিক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
মানুষের সরাসরি ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সড়কপথ, সমুদ্রতট, নদীতীর এবং শহুরে জলাভূমির মতো জায়গাগুলোয় স্পষ্ট প্লাস্টিক দূষণ দেখা যায়। এ ধরনের দূষণ, তাত্ত্বিকভাবে, স্থানীয় পর্যায়ে পরিষ্কার কার্যক্রম ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিকে পরিণত হলে, যা খালি চোখে দেখা যায় না, এ দূষণ প্রাকৃতিকভাবে অপসারণের ক্ষেত্রে প্রায় অপ্রত্যাবর্তনযোগ্য হয়ে পড়ে।
পৃথিবীর দূরবর্তী উপকূল এবং মহাসাগরের পৃষ্ঠ, বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণ প্যাসিফিক, উত্তর ও দক্ষিণ আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগরের পাঁচটি গায়ার (মহাসাগরের বিশাল ঘূর্ণাবর্ত), ভাসমান প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রধান জমার স্থান হিসেবে পরিচিত। সরাসরি পরিমাপ এবং দূর-সংবেদন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ গায়ারগুলোর প্লাস্টিক দূষণ পরিমাপ করা হয়েছে। মহাসাগরের পৃষ্ঠে বর্তমানে আনুমানিক দশমিক ৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক ভাসছে, যা প্রতি বছর নদী, হ্রদ ও মহাসাগরে প্রবেশ করা আনুমানিক ৯-২৩ মিলিয়ন টনের একটি ক্ষুদ্র অংশ। এ তুলনামূলক কম পরিমাণ ভাসমান প্লাস্টিককে কখনো কখনো হারিয়ে যাওয়া প্লাস্টিক বলা হয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, আবহাওয়ার প্রভাব (যেমন টুকরো হয়ে যাওয়া) এবং ডুবে যাওয়ার মাধ্যমে পৃষ্ঠে থাকা প্লাস্টিক দ্রুত জলস্তম্ভ এবং গভীর সমুদ্রতলে স্থানান্তরিত হতে পারে।
ভর ব্যালান্স মডেলিং অনুযায়ী, প্লাস্টিকের একটি বড় অংশ জলস্তম্ভে স্থির থাকে, যা জৈবিক প্রক্রিয়ায় ও স্থির পরিবেশে দ্রুত অবক্ষিত হয় না। সমুদ্র, সাগরতল ও মাটি প্লাস্টিক দূষণের প্রধান ভাণ্ডার হয়ে উঠছে, যেখানে প্লাস্টিকের ৯৯ দশমিক ৮ শতাংশ সমুদ্রের পৃষ্ঠের নিচে জমা থাকে। সাগরতলও প্লাস্টিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চিত স্থান, যেখানে এটি দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। মাটি, বিশেষত কৃষি এলাকায়, প্লাস্টিকের পরিমাণ সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে বেশি হতে পারে এবং এর অবক্ষয় খুবই ধীর। এ প্লাস্টিক দূষণ মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে এবং টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জমা হতে পারে, বিশেষত ন্যানোপ্লাস্টিক কণাগুলোর কারণে। দূরবর্তী উপকূলীয় এলাকায় জমা হওয়া প্লাস্টিকের আয়ু ভাসমান প্লাস্টিকের চেয়ে দীর্ঘ এবং এটি অপসারণ করা আরো কঠিন। মহাসাগরে প্লাস্টিক দূষণ রোধে নির্গমন কমানো অত্যন্ত জরুরি হলেও বর্তমানে তা অর্জন করা কঠিন। ফলে মহাসাগরের পৃষ্ঠ এবং উপকূলীয় অঞ্চলের প্লাস্টিক দূষণ প্রায় অপ্রত্যাবর্তনযোগ্য।
কৃষি মাটিতেও প্লাস্টিক দূষণ হয়, যার উৎস হলো প্লাস্টিক আবর্জনা, গাড়ির টায়ার থেকে আসা এবং বায়ুমণ্ডল থেকে পড়া মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা। কৃষি মাটিতেও প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, যেমন পলিথিন ফিল্ম দিয়ে মাটি মুড়িয়ে দেয়া। এ প্লাস্টিকের পরিমাণ ১ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। প্লাস্টিক মাটিতে ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়, তবে এটি খুবই ধীর গতিতে ঘটে, ফলে মাটিতে প্লাস্টিক দূষণও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি।
প্লাস্টিক দূষণ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে বৈশ্বিক কার্বন চক্রকে প্রভাবিত করতে পারে। সরাসরি প্রভাব হলো প্লাস্টিকের মাধ্যমে জীবাশ্ম কার্বনের এক অংশ শিল্পগতভাবে গ্যাসে রূপান্তরিত হয়, যা গ্রিনহাউজ গ্যাসের সৃষ্টি করে। পরোক্ষ প্রভাব হলো প্লাস্টিকের কারণে মহাসাগরের কার্বন পাম্পের ওপর প্রভাব পড়ে, যা খাদ্যশৃঙ্খলা এবং কার্বন শোষণের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, ফলে পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়। অতিরিক্ত প্লাস্টিক জমে থাকার কারণে মাটি ও সমুদ্রের খাদ্যচক্রে প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে অক্সিজেনের ঘাটতি বাড়তে পারে।
এছাড়া প্রকৃতিতে প্লাস্টিক দূষণের জীববৈচিত্র্যে নানা ধরনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সামুদ্রিক জীবজন্তু যেমন মাছ, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী ও সামুদ্রিক কচ্ছপের মতো প্রজাতি প্লাস্টিকের জাল বা কণা খাওয়ার কারণে বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। প্লাস্টিকের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামুদ্রিক প্রাণী আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থার লাল তালিকায় রয়েছে। এছাড়া প্লাস্টিকের পৃষ্ঠে জীবাণুর কলোনি তৈরি হওয়ার ফলে নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীর শরীরের মধ্যে পরিবহন হতে পারে, যা রোগ সৃষ্টিকারী প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া আক্রমণের জন্য সুবিধা তৈরি করে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের কারণে শারীরিক আঘাত, বৃদ্ধি, প্রজনন ও অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষতি হতে পারে। প্লাস্টিকের অ্যাডিটিভগুলো পরিবেশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যেমন টায়ার রাবারের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের কারণে স্যামন মাছের মৃত্যু ঘটছে।
প্লাস্টিক দূষণকে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হয়। প্লাস্টিক একটি দৃশ্যমান দূষণকারী এবং প্লাস্টিক-সংযুক্ত রাসায়নিক যেমন বিসফেনল এ নিয়ে জনসাধারণের উদ্বেগের কারণে ব্যাপকভাবে চিন্তা করা হচ্ছে। এ উদ্বেগের কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিক মোকাবেলার জন্য নীতি উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, কিন্তু এ দূষণের দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া এবং অন্য প্রভাবগুলোর ওপর পর্যাপ্ত গবেষণা প্রয়োজন। প্লাস্টিক দূষণের কারণে দীর্ঘস্থায়ী বিষক্রিয়া হতে পারে এবং দেরিতে দেখা দেয়া বিষক্রিয়া মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ভবিষ্যতে আরো গুরুতর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলার জন্য গবেষণায় জোর দেয়া জরুরি, যাতে এটি পরিবেশে কীভাবে প্রভাব ফেলে এবং জীববৈচিত্র্য, মাটি ও জলপথের খাদ্যশৃঙ্খলা এবং কার্বনচক্রের ওপর কী প্রভাব ফেলছে তা বোঝা যায়। একটি কার্যকর কৌশল হবে প্লাস্টিক উৎপাদন এবং ব্যবহার দ্রুত ও ব্যাপকভাবে কমানো, পাশাপাশি আরো পরিবেশবান্ধব বিকল্প উপকরণের উদ্ভাবন এবং পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা। এর পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য রফতানির নিয়মকানুন বাড়ানো এবং প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের জন্য সঠিক অবকাঠামো তৈরি করা দরকার।
প্লাস্টিক বর্জ্য বর্তমানে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মাটির উর্বরতা নষ্ট করে, ভূগর্ভস্থ পানিতে লিচিংয়ের প্রভাব ফেলে, ড্রেন বন্ধ করে দেয় এবং পুড়িয়ে ফেলা হলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে। বাংলাদেশে দৈনিক প্রায় ১৫ হাজার ৩৪২ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা কার্যকর ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিবেশে দূষণ বাড়ায়। এ সমস্যা সমাধানে পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং), ইনসিনারেশন এবং ল্যান্ডফিল পদ্ধতি সঠিকভাবে ব্যবহার করা দরকার। ইনসিনারেশন পদ্ধতিতে প্লাস্টিক পুড়িয়ে শক্তি উৎপন্ন করা সম্ভব হলেও মিশ্র প্লাস্টিক থেকে ডাইঅক্সিন নির্গত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তি সাশ্রয়, গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য 4R ধারণা বা নীতি (Reduce, Reuse, Recycle, Recover) কার্যকর হতে পারে। এটি প্যাকেজিং কমানো, পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করা, রিসাইক্লিং প্রযুক্তি উন্নত করা এবং শক্তি পুনরুদ্ধারকে উৎসাহিত করে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যাকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে সমাধান করা সম্ভব।
উন্নয়নশীল দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন কার্যকর প্রযুক্তি প্রস্তাবিত হয়েছে, যার মধ্যে প্লাজমা পাইরোলাইসিস প্রযুক্তি, ফাস্ট পাইরোলাইসিস, পলিমার-ব্লেন্ডেড বিটুমিন এবং সিমেন্ট কিলনে সহপ্রক্রিয়াকরণ উল্লেখযোগ্য।
প্লাজমা পাইরোলাইসিস প্রযুক্তি: এ প্রযুক্তিতে ৮৫০-১০৫০°C উচ্চ তাপমাত্রায় প্লাস্টিক বর্জ্য ভেঙে মিথেন, হাইড্রোজেন ও কার্বন মনোক্সাইডে রূপান্তরিত হয়, যা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। এতে প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথক্করণের প্রয়োজন নেই এবং ক্ষতিকর গ্যাস নির্গমনের ঝুঁকি থাকে না। উৎপন্ন সিংগ্যাস টারবাইন, গ্যাস ইঞ্জিন বা জ্বালানি কোষে ব্যবহৃত হতে পারে।
ফাস্ট পাইরোলাইসিস: ৪৫০-৬০০°C তাপমাত্রায় দ্রুত গরম করার মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে তরল জ্বালানি, টার ও চারকোলে রূপান্তর করা হয়। প্রক্রিয়াটি সহজ এবং এতে বিভিন্ন ধরনের অব্যবহৃত, অগোছালো বা কঠিন পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করা যায়। বাংলাদেশে গবেষণা ও পাইলট প্রকল্পে এটি সফলভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সম্ভাবনাময় সমাধান।
সিমেন্ট কিলনে সহপ্রক্রিয়াকরণ: এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিক বর্জ্য জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিমেন্ট কিলনের ৮৫০-১৮০০°C তাপমাত্রায় প্লাস্টিক সম্পূর্ণ দহনে রূপান্তরিত হয়, যা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমায়। এতে অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিকও সরাসরি ব্যবহার করা যায় এবং ভারী ধাতু ও সালফার আটকানো হয়। এটি পরিবেশবান্ধব এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করে।
পলিমার-ব্লেন্ডেড বিটুমিন: এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিক বর্জ্য রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ, পরিষ্কার এবং ২-৪ মিমি আকারে কেটে গরম পাথরের সঙ্গে ১৬০-১৭০°C তাপমাত্রায় মিশিয়ে বিটুমিনের মতো মিশ্রণ তৈরি করা হয়। ভারতে পরীক্ষামূলকভাবে, ১০ বর্গমিটার রাস্তা তৈরিতে ৩ কেজি বিটুমিন সাশ্রয় করার জন্য ৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে গবেষণায়ও এ পদ্ধতির ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে, যা পরিবেশবান্ধব এবং খরচসাশ্রয়ী।
উপরোক্ত প্রযুক্তিগুলো প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব সমাধান প্রদান করে, যা উন্নয়নশীল দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের আর্থিক সুবিধাগুলো বহু গুরুত্বপূর্ণ দিককে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। প্লাস্টিক বর্জ্যকে জ্বালানি বা বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন গ্যাস, কয়লা ও পেট্রোলিয়াম সংরক্ষণ করা সম্ভব, যা শক্তি উৎপাদনকারী শিল্পে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে ল্যান্ডফিলের আকার ছোট করা যায়, যা দূষণ, বিষক্রিয়া ও স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি হ্রাস করে। এটি অর্থনীতিকেও উন্নত করে, কারণ পুনর্ব্যবহার স্থানীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে, আমদানিনির্ভরতা কমায় এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। তাছাড়া বাতাস ও পানির দূষণ কমিয়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং মোকাবেলায় সাহায্য করে। তাই পুনর্ব্যবহার বড় পরিসরে বাস্তবায়িত হলে এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে ভারসাম্য বয়ে আনতে পারে।
বাংলাদেশ ২০০২ সালে প্লাস্টিক শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে এখনো তা বাস্তবিক অর্থে কার্যকর হয়নি। অধিকাংশ জনগণ এখনো সচেতন নয় এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কম আগ্রহের কারণে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে হচ্ছে না। ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান ২০১৬-২০৩৫ অনুযায়ী, শহরের জলাভূমি সংরক্ষণ, রিং রোড নির্মাণ এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে, তবে স্থানীয় জনগণের পূর্ণ সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততার এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে এসব উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এছাড়া পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের মান ও প্রাপ্যতা সম্পর্কে তথ্যের অভাব এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরো জটিলতা সৃষ্টি করছে। বর্জ্য সংগ্রহকারী শিশুদের সুরক্ষাসামগ্রী না থাকার কারণে সংক্রমণজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ছে এবং হাসপাতালের বর্জ্যও প্লাস্টিকের সঙ্গে মিশে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। সবশেষে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।
প্লাস্টিক দূষণ সংকট সমাধানের ওপর গবেষণা করে তিনটি প্রধান কৌশল প্রস্তাব করেছেন সমকালীন গবেষকরা। প্রথমত, কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ। এতে নিষেধাজ্ঞা এবং করের মাধ্যমে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং প্রস্তুতকারকদের তাদের পণ্যের পুনর্ব্যবহার বা সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে বাধ্য করার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির ডিপোজিট-রিটার্ন সিস্টেম পুনর্ব্যবহার বাড়াতে সাহায্য করলেও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিদীপ্ত পুনর্ব্যবহার পদ্ধতির উন্নয়ন। এটি মেকানিক্যাল রিসাইক্লিং, রাসায়নিক এবং এনজাইমভিত্তিক রিসাইক্লিংয়ের মতো আধুনিক পদ্ধতিগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এ পদ্ধতিগুলো প্লাস্টিককে তার মূল রাসায়নিক গঠন ভেঙে উন্নত মানের পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদানে রূপান্তর করতে পারে। তবে এসব পদ্ধতি এখনো ব্যয়সাপেক্ষ এবং উচ্চ শক্তি খরচের কারণে সীমাবদ্ধ।
তৃতীয়ত, নতুন উপকরণ উদ্ভাবন। উদাহরণস্বরূপ বায়োপ্লাস্টিক এবং ক্লোজড-লুপ ম্যাটেরিয়াল, যা পরিবেশবান্ধব, সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং জীবাণুমুক্ত। এছাড়া বায়োডিগ্রেডেবল সোনালি ব্যাগও নতুন উদ্ভাবিত পণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে বিকল্প পণ্য তৈরি করাও পুনর্ব্যবহারের প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে। এই তিনটি কৌশল একত্রে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে প্লাস্টিক দূষণ সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া সম্ভব।
ড. শফি মুহাম্মদ তারেক: অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ফেলো, রয়্যাল কেমিক্যাল সোসাইটি এবং চার্টার্ড পরিবেশবিদ, যুক্তরাজ্য