কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার [প্রকাশিত: জনকণ্ঠ, ৩০ জুন ২০২৫]

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি

বিশ্বব্যাপী অসহনীয়ভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষের প্রযুক্তিপ্রীতি। নানা রকম প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে বাতাসে ‘গ্রিনহাউজ গ্যাস’ এর আধিক্যতা বাড়ে। বায়ুর মূল উপাদান হলো নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। এছাড়া রাতে সামান্য পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড আছে। আরও আছে জলীয় বাষ্প ও ওজোন গ্যাস। বায়ুমন্ডলের এই গৌণ গ্যাসগুলোকেই গ্রিনহাউস গ্যাস বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এসব গ্যাস ছাড়াও মনুষ্য সৃষ্ট সিএফসি (ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন), এইচসিএফসি (হাইড্রো ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন), হ্যালন ইত্যাদিও প্রিনহাউস গ্যাস। এই গ্যাসগুলোর মধ্যে গত এক শতাব্দীতে বায়ুম-লে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। একইভাবে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণও শতকরা ১৯ ভাগ এবং মিথেনের পরিমাণ ১০০ ভাগ বেড়েছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। এছাড়া অন্যান্য কারণও রয়েছে। মানুষ যেসব পণ্য (বিশেষ করে ডিজিটাল পণ্য) করে যেমন রেফ্রিজারেটর, এয়ার কন্ডিশনার, প্লাস্টিক, ফোম, এরোসল প্রভৃতির ফলেও বায়ুমন্ডলে উৎপন্ন হচ্ছে এক ধরনের প্রিনহাউস গ্যাস (এইচসিএফসি)। এই গ্যাসের কারণে বায়ুম-লের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রত হয়। বায়ুম-লের অনেকগুলো স্তর আছে। ভার মধ্যে ভূপৃষ্ঠের নিকটবর্তী ত্তর ট্রপোস্ফেয়ার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার গড় উচ্চতা ১২ কিমি। এর পরের স্তর হলো স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার। তার পরের স্তরটি হলো ওজোন স্তর, যা ২০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। ওজোন স্তর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবীর জীবজগৎকে রক্ষা করে। ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণে ভূপৃষ্ঠে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাব শতকরা পাঁচ ভাগ বৃদ্ধি পেরেছে। এটাও বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণ।

 


বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অধিক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে পরিবেশ নষ্ট করছে। তাছাড়া এসব দেশ পারমাণবিক চুল্লি ব্যবহার করে, যা থেকে প্রচুর বর্জ্য সৃষ্টি হয়। এই বর্জ্যও গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধি করছে, তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এর ভূমিকা অতি সামান্য। শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও কালো ধোঁয়া থেকেও প্রচুর পরিমাণে পারদ, সিসা ও আর্সেনিক নির্গত হয়। এটাও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ। মহাসমুদ্রকে পৃথিবীর মানব দেহের ফুসফুসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে মহাসমুদ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিক্ষেপ করার ফলে ভা দূষিত হচ্ছে এবং এ দূষিত বাষ্প বাতাসে মিশ্রিত হয়েও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশেও এক সময় বহু নদী-নালা, খাল-বিল ও হাওড়-বাঁওড় ছিল, যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। এখন এসব নদী-খাল-বিল শুকিয়ে গিয়েছে কিংবা ভরাট করে ফেলা হয়েছে। অনেক নদী ও খাল বর্জ্য ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এভাবে অনেক অনুন্নত দেশেই এসব নদ-নদীর অপব্যবহার হওয়ায় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ দূষণের পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বন উজাড়করণ। সবুজ উদ্ভিদ বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং আমাদের জন্য অক্সিজেন নির্গমন করে। কিন্তু ব্যাপকহারে বৃক্ষ নিধন বা বন উজাড়করণের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গেছে। ফলে বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী সিএফসি গ্যাস অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক হারে নগর গড়ে উঠেছে। মানুষ কাজের খোঁজে শহরে ছুটছে। ফলে শহরে জনসংখ্যার চাপ ও বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। এসব যানবাহনের নির্গত কালো ধোঁয়া হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড। তাছাড়া শিল্প-কারখানার কালো ধোঁয়াও নগরের বায়ুতে কার্বনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। এটিও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা কারণ। কৃষিতে যান্ত্রিক সেচ, নাইট্রোজেন সার, কীটনাশক প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এসবের ফলেও বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর ক্ষতি হয়, যার প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে।

 


প্রচন্ড গরমের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। এর আর্থিক মূল্য ২৮-৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রমঘণ্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম এবং বছরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা। গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে এবং এতে ১১ হাজার ৪৫০ জন মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ডলার। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফলে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতি বা অনাবৃষ্টি, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদি এখন বাংলাদেশের জন্য সাধারণ ঘটনা। তালিকায় আছে নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, হাইতি, ফিলিপাইন, মোজাম্বিক, বাহামা, পুয়ের্তোরিকা ইত্যাদি। কাজেই তাপমাত্রা কমাতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করার এখনই সময়।

 

 এ লক্ষ্যে নানা প্রযুক্তি কার্যকর হচ্ছে। তন্মধ্যে কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ক্লাইমওয়ার্কস প্রযুক্তি অন্যতম।
কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিং একটি কানাডিয়ান কোম্পানি যা সরাসরি বায়ু থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2) অপসারণের প্রযুক্তি তৈরিতে কাজ করে। এই প্রযুক্তি, যা ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (DAC) নামে পরিচিত, বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং এটিকে ভূগর্ভে জমা করে অথবা সিন্থেটিক জ্বালানিতে রূপান্তর করে। এই প্রযুক্তিতে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস ধরে এনে পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ কমায়। এটি দুটি ধাপে কাজ করে: প্রথমত, একটি বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং দ্বিতীয়ত, শোষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে প্রক্রিয়াজাত করে নিরাপদ স্থানে জমা রাখে যা পরবর্তীতে জ্বালানি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। কার্বন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রধান কাজগুলি হলো: ১. ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (DAC): বায়ুম-ল থেকে সরাসরি কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2) অপসারণের জন্য একটি স্কেলেবল প্রযুক্তি তৈরি করে। ২. সাসটেইনেবল ফুয়েল তৈরি: ক্যাপচারডকৃত কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং হাইড্রোজেনকে একত্রিত করে কার্বন-নিরপেক্ষ সিন্থেটিক জ্বালানি তৈরি  করে, যা পরিবেশবান্ধব। ৩. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে। ৪. শিল্প স্কেলে প্রযুক্তি স্থাপন: বাণিজ্যিক স্কেলে কার্বন ক্যাপচার প্ল্যান্ট স্থাপন করে, যা প্রতি বছর মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করতে সক্ষম।

 


ক্লাইমওয়ার্কস (Climeworks) একটি সুইস কোম্পানি, যারা সরাসরি বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণের (DAC) প্রযুক্তিতে কাজ করে। এই কোম্পানি, ‘ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার অ্যান্ড কার্বন স্টোরেজ’ (DACCS) প্রযুক্তির মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ফিল্টার করে এবং এটিকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করে। মূলত তারা বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং এটিকে ভূগর্ভে জমা করে রাখে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি করপোরেশন ক্লাইমওয়ার্কসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ কিনেছে, যার মধ্যে রয়েছে স্ট্রাইপ, মাইক্রোসফ্ট, সুইস রে এবং বিসিজি।

 

 

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ক্লাইমওয়ার্কসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ পরিষেবায় সাবস্ক্রাইব করা ব্যক্তির সংখ্যা ১৮,০০০ ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, ক্লাইমওয়ার্কস ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যাতে এয়ারলাইন্সের কিছু CO2 নির্গমন অপসারণ করা যায়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে, ক্লাইমওয়ার্কস মর্গান স্ট্যানলির সঙ্গে একটি অপ্রকাশিত মূল্যে ৪০,০০০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ ক্রয় চুক্তিতে প্রবেশ করে। ক্লাইমওয়ার্কস ফাস্ট কোম্পানির ‘২০২৪ সালের বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী কোম্পানি’ এর মধ্যে ছিল। এটি টাইমের ২০২৪ সালের প্রভাবশালী কোম্পানির তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ক্লাইমওয়ার্কসের কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ পরিষেবা কার্বনপ্ল্যান ডাটাবেসে ৫/৫-তারকা রেটিং পেয়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসে, ক্লাইমওয়ার্কস এবং ডিএনভি সরাসরি বায়ু ক্যাপচারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি এবং বৈধতা দেয়, যা সম্পূর্ণ তৃতীয়-পক্ষের সার্টিফিকেশনের দিকে একটি পদক্ষেপ চিহ্নিত করে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, ক্লাইমওয়ার্কস এবং কার্বফিক্স সরাসরি বায়ু ক্যাপচার এবং ভূগর্ভস্থ খনিজ সংরক্ষণের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণের জন্য নিবেদিত একটি পদ্ধতি চালু করে। এই উভয় প্রযুক্তিই বায়ু থেকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে সহায়তা করছে, যার ফলে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে থাকতে সহায়তা হচ্ছে।

 


লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়