বড় একটা পরিবর্তনের ম্যান্ডেট পেয়েছেন ট্রাম্প
ইমতিয়াজ আহমেদ প্রকাশ : দেশ রূপান্তর, ১০ নভেম্বর ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। সম্প্রতি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এক ইতিহাস গড়লেন। ট্রাম্প গত ১২০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করার পর নির্বাচন করে বিজিত হলেন। মার্কিন নির্বাচন ও তার ফলাফল বৈশ্বিক পরিসরে নানান প্রভাব তৈরি করে।
সার্বিক বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরীদেশ রূপান্তর : ট্রাম্পের ব্যাপকভাবে ফিরে আসাকে কীভাবে দেখছেন আপনি?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এখানে কয়েকটা জিনিস আছে। একটা তো অর্থনীতি। যদিও ডেমোক্র্যাটরা বলে আসছিল, অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। কিন্তু একটু ঘাঁটলে দেখা যায় যে রিচ এবং নট সো রিচের মধ্যে বিশাল তফাৎ তৈরি হচ্ছিল। হিসাব করলে সেখানে কয়েকটা বিষয় দেখা যাবে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের কয়েকটা বিষয়ে ডিফারেন্স দেখলে কতগুলো জিনিস বের হয়ে আসে। ৩টা বিষয় দেখলেই বোঝা যাবে কী অবস্থা। যে রকম, ফুড সিকিউরিটি ২০২১ থেকে ২০২৪-এ ৪০% বেড়েছে। তারপর পোভার্টি ২০২১ থেকে ২০২৪-এ ৬৭% বেড়েছে, হাউজহোল্ড-ফুডকস্ট এটা খুব ইম্পর্টেন্ট, এটা ২০২১ থেকে ২০২৪-এ ৩৫% বেড়েছে। অন্য কথায় লোয়ার ইনকাম বা লোয়ার মিডল ক্লাস এরা প্রচ-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটার ব্যাপারে কোনো ডেমোক্র্যাটরা গুরুত্ব দেয়নি, তার ওপর ডেমোক্র্যাটরা বড় আকারেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। একটা হচ্ছে ইউক্রেনে, তারা জেলেনস্কিকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢালছিল সেখানে। তারপর আবার গাজার জেনোসাইডের সঙ্গে তারা রীতিমতো জড়িত হয়ে গেছে। এতে আমেরিকার ইতিহাসে যেটা হয় না যে, ইয়াং পপুলেশন থেকে সিনিয়র সিটিজেন এমনকি মাইনোরিটি সবাই বিপক্ষে চলে গেছে। যে ৭টা সুইং স্টেট আছে সেখানে মাইনোরিটির ভোট ইম্পর্টেন্ট, এখানে মাইনোরিটি বলতে আরব-আমেরিকান থেকে শুরু করে ইন্দো-আমেরিকান, মুসলিম বা অন্যান্য যারা আছে দেখা গেল তাদের বড় অংশ রিপাবলিকানকে ভোট দিয়েছে। কারণ গাজার যে জেনোসাইড সেটা ডেমোক্র্যাটরা থামাতে তো পারেইনি বরং কমলা হ্যারিসও ইসরায়েলের পক্ষে যেসব কথা বলেছেন সেগুলো কোনোভাবেই আমেরিকার জনগণ গ্রহণ করেনি। এমনকি জিউস পপুলেশনের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, এরা তো যুদ্ধ বন্ধে রাস্তায় তো বেরিয়েছিল, আইভি লিগের যে প্রটেস্ট দেখেছি সেখানে প্রচুর জিউসরা ইনভলভ ছিল। অন্যদিকে জিউসদের নামেই নেতানিয়াহুর চালানো এই জেনোসাইডকে জো বাইডেন সরাসরি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু মার্কিন অর্থনীতিতে চলছে মন্দা। সব মিলিয়ে রিপাবলিকানদের বিশাল জয়।
দেশ রূপান্তর : মাইনোরিটির প্রসঙ্গ তুললেন। অনেকের এনালিসিসে আসছে যে ওখানে জনমিতি নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে হোয়াইটদের ভেতরে। যাদের মাইনোরিটি বলছি তাদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এই জায়গা থেকে একরকম হোয়াইট রেসিজম গ্রো করছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ : এটাই তো হলো ইন্টারেস্টিং। মানে এমনিতেই তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট ভোটই পাওয়ার কথা। কিন্তু এই ইলেকশনে হোয়াইট ভোট তো পেয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু হোয়াইট ভোটের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে মাইনোরিটির ভোটগুলোও পেয়ে যাচ্ছে, এটাই হলো ইন্টারেস্টিং বিষয়। না হলে সুইং স্টেটগুলোর ৭টিই রিপাবলিকান হয়ে যাবে এটা আগে কখনো হয়নি। যদিও ডেমোক্র্যাটরা সেভাবেই প্রচার করছিল। আমি মনে করি অনেকটা ভুল করে ডেমোক্র্যাটরা এই হোয়াইট ভোটদের আকর্ষণ করার জন্যই কিন্তু ইসরায়েলের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দেখা গেল যে এটা ব্যাকফায়ার করেছে।
দেশ রূপান্তর : এবারের মার্কিন নির্বাচনে ইউক্রেন এবং গাজা যুদ্ধ বড় আলোচনায় ছিল। একটা ধারণা হচ্ছে যে ট্রাম্প এলে পৃথিবীর যুদ্ধক্ষেত্রগুলো কমবে। আপনার কী মনে হয়? আসলেই মার্কিন যুদ্ধনীতি বদলাবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : কথা হচ্ছে ট্রাম্প ভোটারদের যে ম্যান্ডেটটা পেয়েছেন সেই ম্যান্ডেটটা পরিষ্কার হলো যুদ্ধবিরোধী, শান্তির পক্ষে। যদি আজ অর্ধেক অর্ধেক হতো, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো, সাতটা সুইং স্টেটের মধ্যে একদিকে ৪টা, অন্যদিকে যদি ৩টা আসত, তাহলে বলা যেত যে, আমেরিকার জনগণ ইউক্রেনের ব্যাপারে, গাজার ব্যাপারে খুব ডিভাইডেড, এমনকি অর্থনীতির ব্যাপারেও। কিন্তু এবারকার ভোটে স্পষ্টতই তারা ম্যান্ডেট দিয়েছে। এখন ম্যান্ডেটটা কার্যকর হবে কি না সেটা দেখতে হবে সামনে। মানে ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর জন্য তো ডোনাল্ড ট্রাম্প সবসময়ই বলে এসেছেন যে, তিনি থাকলে এই যুদ্ধটাই হতো না। রিপাবলিকানদের কিছু দিক যেটা প্রচার হয় না, রিপাবলিকানদের সবসময় নেগেটিভলি দেখা হয়, বাংলাদেশে আরও বেশি দেখা হয়। আমি জানি না কেন। কিন্তু কথা হলো যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে রিপাবলিকানরা বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একটা হলো যে তালেবানের দোহা রাউন্ড, এটা তো রিপাবলিকানই করেছে। এটা তো ট্রাম্পেরই করা। যদিও তিনি শেষটা দেখতে পারেননি এবং যে দুই মাস সময় পেয়েছিলেন ইলেকশন হারার পরে, তখনো কিন্তু তিনি চেষ্টা করেছিলেন আফগানিস্তান থেকে উইথড্র করার জন্য। কিন্তু তার আশপাশে যারা ছিলেন, তারা সেটাকে অ্যালাউ করল না, যেহেতু আমরা ইলেকশনে হেরে গেছি এটা নেক্সট প্রেসিডেন্টের ওপরে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন তারা। এবং আমরা দেখলাম নেক্সট প্রেসিডেন্ট এক বছরের মধ্যে তড়িঘড়ি করে সেটা উইথড্র করে ক্রেডিট নিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এটা মূলত করেছে রিপাবলিকানরাই। ইতিহাসের অন্যতম বড় যেটা উইথড্রল ভিয়েতনাম থেকে, সেটাও তো রিপাবলিকানরা করেছে। এটার একটা কারণ হলো যেহেতু তারা কনজারভেটিভ, তারা যদি ওই ধরনের একটা স্টেপ নেয় ফরেন পলিসিতে, তখন ওটা নিয়ে আর এত সমালোচনা হয় না। মানে তাদের কেউ প্রশ্ন করে না, যে তারা আমেরিকাকে বিপদে ফেলছে কেন। তো সেই জায়গায় তো সুযোগ তৈরি হয়েছে, আর ম্যান্ডেটও ক্লিয়ার। আমেরিকার জনগণ এত বড় ম্যান্ডেট দিয়েছে শান্তির পক্ষে কোনো সন্দেহ নেই। ইকোনমি তো আছেই, কিন্তু শান্তির ব্যাপারে বিষয়টা তো স্পষ্ট। কারণ, এই আরব আমেরিকান, মুসলিম ভোট এমনকি ইন্ডিয়ান আমেরিকান কিংবা হিন্দু ভোট এগুলো কিন্তু সবগুলোই ট্র্যাডিশনালি ডেমোক্র্যাটরা পেয়ে থাকত। এবার সেটা হয়নি। যুদ্ধ বন্ধ হবে কি না, কত সময় লাগবে সেটার জন্য স্বাভাবিকভাবে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদি না হয় তখন আরেকটা সমালোচনা আসবে।
দেশ রূপান্তর : আরেকটা বিষয় বলি। আফগানিস্তানের কথা তো আপনি বললেনই, তালেবানরাও কিন্তু এবার দেখলাম ট্রাম্পকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় গাজা ইস্যুতে একটু ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ আছে। এখানে ট্রাম্পকে কম আগ্রাসী মনে হয় না। কারণ ট্রাম্প জেরুজালেমে গিয়ে ইসরায়েলের যে বিতর্কিত রাজধানী, সেটার উদ্বোধন করে দিয়ে এসেছিলেন, তাদের ইউএস অ্যাম্বাসি প্রতিষ্ঠা করে এসেছিলেন।
ইমতিয়াজ আহমেদ : মানে সবাই তা-ই ভাবছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে জো বাইডেন বা তার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটা জেনোসাইডের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে, এটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না। সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্প হননি, এটা বলতে চাচ্ছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে হবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, হতেও পারেন, তিনি করতেও পারেন, তাই না? কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি জড়িত না হয়ে আছেন। তার সময়ে তো আর গাজায় জেনোসাইডটা হয়নি। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, প্যালেস্টাইনের ওপর জেনোসাইড তো সেই ১৯৪৮ থেকে হচ্ছে এবং তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই জেনোসাইডটা আমরা লাইভ দেখেছি, টেলিভিশনেও দেখছি। এটার সঙ্গে ট্রাম্প জড়িত না, এটার সঙ্গে জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস জড়িত। তো সেই জায়গায় অনেকেরই আশা আছে যে এবং আমি অনেকবার বলেছি যে, ইসরায়েলকে যদি কেউ বশ করতে পারে বা সিজফায়ার বা শান্তি যদি কেউ আনতে পারে সেটা রিপাবলিকানরাই পারবে, ডেমোক্র্যাটরা পারবে না। কারণ ডেমোক্র্যাটরা পেঁচিয়ে এমন একটা কিছু করবে যেটা বিল ক্লিনটনও করেছিলেন। তিনি একটা এগ্রিমেন্ট করেন কিন্তু এগ্রিমেন্টে অনেক প্যাঁচ থাকে যার ফলে সেটাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। সেই জায়গায় এখন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প পারবেন কি না দেখতে। তবে ম্যান্ডেট একদম ক্লিয়ার যে, আমেরিকার জনগণ একটা শান্তি চাচ্ছে, তারা যুদ্ধ চাচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : আপনার কি মনে হয় যে, ন্যাটোর প্রভাব একটু দুর্বল হবে ট্রাম্প আসার ফলে? ইউক্রেন প্রসঙ্গ পর্যন্তও আলাপটা টানা যেতে পারে...
ইমতিয়াজ আহমেদ : বড় আকারে ন্যাটোর পরিবর্তন হওয়ার এবার একটা সুযোগ আছে। এটার দুটো কারণ আছে। একটা তো ডোনাল্ড ট্রাম্প আগের বারই চেষ্টা করেছিলেন ন্যাটোকে অন্যভাবে দেখতে। কারণ তিনি বলছেন যে, আমরা কেন বা আমেরিকা কেন এত টাকা ঢালবে ন্যাটোর দিকে, ইউরোপিয়ানরাই তো তাদের নিজের ডিফেন্স করতে পারে; এখানে আমরা ঢালছি কেন? সেখানে টাকা ঢালতে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে, আমাদের রাস্তাঘাট ঠিক নেই, আমাদের ইনফ্রাস্ট্রকচার ঠিক নেই, কারণ টাকা নেই। এটাই তো ছিল তার যুক্তি যে, আমি কেন জার্মানিতে ১১৯টা মিলিটারি বেইস রাখব, জার্মানির নিজেরই তো পয়সা আছে এটা রাখার। আমার কথা হচ্ছে সেখানে একটা বড় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর সেকেন্ড পয়েন্ট হলো যে ইউরোপেও কিন্তু একটা রাইট উইং ফোর্স ক্ষমতায় চলে আসছে। এবং আমরা জানি যে অলরেডি জার্মানিতে নতুন ইলেকশনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সও জোড়াতালি দিয়ে ডানপন্থিদের ঠেকিয়ে রেখেছে এ রকম অবস্থা। তো একটা সম্ভাবনা আছে, কোনো সন্দেহ নেই ইউরোপের যে কাঠামোটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে দেখে আসছি সেখানে একটা বড় পরিবর্তন হওয়ার একটা ম্যান্ডেট কিন্তু আছে। কারণ এ ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু পরিষ্কার ছিলেন যে, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধে থামাবেন। তো জনগণও মনে করে যে, তিনি ঠিক কথার মধ্যেই আছেন।
দেশ রূপান্তর : দেখা যাচ্ছে বিশ্ব জুড়ে একটা রাইট অ্যালায়েন্স তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে মোদি, শি এবং পুতিন ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন বলে মনে হয়েছে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ইমতিয়াজ আহমেদ : আমার মনে হয়েছে যে, আমেরিকা বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের সময়ে যেটা দেখলাম তারা কোনোভাবেই মাল্টিপোলার পৃথিবী মানতে রাজি না। ফলে পৃথিবীর যে একাধিক ক্ষমতাবলয় রয়েছে এবং সবার সঙ্গে যে সম্পর্ক রাখা সেটা হচ্ছে না। বরং তারা মনে করেছে যে, যেহেতু তাদের মিলিটারি বাজেট বিশাল, এই সামরিক বাহিনীর মাধ্যমেই ইউনিপোলারিটি তারা ধরে রাখবে। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে, এটা করতে গিয়ে আমেরিকার মধ্যে একটা বড় ডিভিশন তৈরি হয়ে গেছে বিটুইন দ্যা রিচ অ্যান্ড নট সো রিচ। মানে রিচ বিকেন সুপার রিচ, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিশাল জনগণ, যেটা ওয়ার্কিং ক্লাস বলা হয়, বলতে গেলে তাদের অবস্থা শোচনীয় অবস্থায় চলে গেছে। যেটার পপুলিস্ট ফোর্স হলো ডোনাল্ড ট্রাম্প। মানে ট্রাম্প ওই পপুলিস্ট ভাষায় কথা বলতে পারেন। এখন কথা হচ্ছে যে সামরিক কাঠামো দিয়েই আমি আমেরিকা গ্রেট হব না, উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রেট হব ট্রাম্প এই পরিবর্তন আনেন কি না। ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ এই সেøাগানের মধ্যে যতটা না মিলিটারি তার চেয়ে কিন্তু ডেভেলপমেন্টটা বেশি। তিনি বলছেন না যে আমি সব জায়গায় গিয়ে খবরদারি করব, সেটা কিন্তু তার কথা না। তার কথা হচ্ছে, ব্যবসায় আমি আবার সেই বিরাট ইকোনমিক ফোর্স হয়ে দাঁড়াব। এখন সেটা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে তিনি চেষ্টা করবেন, বিভিন্ন ট্যারিফ বাড়িয়ে দেবেন যেন আমেরিকার জনগণের এমপ্লøয়মেন্ট বাড়তে থাকে।
দেশ রূপান্তর : ট্রাম্প, মোদি, শি, পুতিন, কিম এলায়েন্স কি বিশ্বকে মাল্টিপোলার জায়গায় নিতে পারে নাকি সেটা কর্তৃত্বপরায়ণ ক্যাপিটালিজমের রূপ নিয়ে আসবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এটা গুড কোয়েশ্চেন। কথা হচ্ছে যে, রাশিয়া, চায়না আর ইন্ডিয়ার যে অ্যালায়েন্সটা হচ্ছে সেটা তার জন্য একটু অস্বস্তিকর, তাই না? সেটার পরিবর্তে যদি ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ার সঙ্গে তো তিনি ডেফিনেটলি চেষ্টা করবেন তা না বোঝার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সেখানে ইন্ডিয়া কতখানি যাবে সেটাও প্রশ্ন। চার বছর আগের ইন্ডিয়া এবং এখনকার ইন্ডিয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। আবার ৪ বছর আগের চায়না এবং এখনকার চায়নার মধ্যে পার্থক্য আছে। চায়নাও আমি মনে করি প্রস্তুত আছে যে, ট্যারিফ ওয়্যার যদি বাড়িয়ে দেয় তাহলে চায়নার কী করতে হবে সেটা এই চার বছরে সে হোমওয়ার্ক করে ফেলেছে। আমাদের যেটা দেখা দরকার, পার্টিকুলার ইউক্রেনকে নিয়ে, ইউক্রেনে যদি পরিবর্তন আনতে পারেন তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে ইউনিপোলার থেকে মাল্টিপোলারের দিকে অ্যাটলিস্ট তার একটা গ্রিন সিগন্যাল থাকছে। যেটা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে। ডেমোক্র্যাটরা মনেই করেছিল ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়াকে একেবারে বধ করে ফেলছে, তারপর চায়নাকে ধরবে। আমার মনে হয় এই ছিল তাদের স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু সেটা তো হয়নি। রাশিয়া দুর্বল হয়নি, বরং আরও ওপরে উঠে এসেছে। তারপর আবার রাশিয়া, চায়না, ইন্ডিয়া মিলে একটা অ্যালায়েন্স হয়েছে। তো চ্যালেঞ্জ বড় আকারেই আছে। কিন্তু ইউক্রেনের ব্যাপারে, ন্যাটোর ব্যাপারে আমি মনে করি যে বড় একটা পরিবর্তনের ম্যান্ডেট তিনি পেয়েছেন। এখন সেটা তিনি কীভাবে করবেন, তাকে করতে দেবে কি না সেটাও একটা ব্যাপার আছে।
দেশ রূপান্তর : ইরান এবং ইসরায়েল মুখোমুখি এখন। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প কি ইরান এবং ইসরায়েলকে সামলাতে পারবেন? আমরা দেখছি যে বাইডেনের কথা কিন্তু পাত্তা দিচ্ছেন না নেতানিয়াহু...।
ইমতিয়াজ আহমেদ : ট্রাম্পের পার্সোনালিটি যেটুকু বুঝি মনে রাখতে হবে ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসলেন, তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিমের সঙ্গে সরাসরি দেখা করে। এটা তো বিশাল ইভেন্ট। একেবারে নর্থ কোরিয়ার বর্ডারে গিয়ে দেখা করা এবং নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে ওই সম্মান দেওয়া এটা তো আনথিংক্যাবল ছিল। সেটাও তো তিনি করেছেন, তাই না? তো আমার মনে হয়েছে যে, তার যে ক্যারেক্টার, যে পার্সোনালিটি সেখানে সে নেতানিয়াহুকে সহ্য করবেন বলে আমার মনে হয় না। এটা আমার পার্সোনাল ধারণা। বাইডেনের এই সময়টাতে তো মনে হয় যে, নেতানিয়াহু এমন একটা অবস্থায় গেছেন এখন যে তিনি আমেরিকার ফরেন পলিসি ঠিক করছেন। বাইডেনের সময়ে তাই বলা হচ্ছিল যে, ইসরায়েলই আমেরিকার ফরেন পলিসি ঠিক করছে। এটা ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনোভাবে সহ্য করার মানুষ না। তিনি দেখাবেন যে, তিনিই হিরো। সেই জায়গায় যেটা দেখা দরকার গাজায় সিজসাফার হচ্ছে কি না, বড় কথা হচ্ছে যুদ্ধ থামাতে পারছেন কি না আর নেতানিয়াহুকে বশ করতে পারছেন কি না। নেতানিয়াহুকে বিদায় নিতেও হতে পারে।
দেশ রূপান্তর : ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের সম্পর্ক কেমন হবে? এর মধ্যেই অনেক আলোচনা হচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টার একটা বক্তৃতা ভাইরাল হয়েছে। নির্বাচনের প্রচার চলাকালে ট্রাম্পের একটা টুইট বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নেতিবাচকভাবেই এসেছে। সবমিলিয়ে...
ইমতিয়াজ আহমেদ : একটা ব্যাপার, গত দুই সপ্তাহে আমরা দেখছিলাম যে বাইডেন প্রশাসনও নির্বাচনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলা শুরু করেছিল। ট্রাম্পের প্রশাসন জানুয়ারির ২০ তারিখে ফর্মালি বসবে। আমার মনে হয় তারা খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার দেখতে চাইবে। ডেমোক্রেটিক পার্টি হয়তো এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কিছুটা স্পেস দিত, যেহেতু চিফ অ্যাডভাইজারের সঙ্গে ডেমোক্র্যাট পলিসি মেকারদের একটা ভালো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল বা আছে। এটা ট্রাম্পের না জানার কোনো কারণ নেই। তিনি ভালো করেই জানেন এই বিষয়টা। সেখানে আমি মনে করি যে, মূলত নির্বাচনের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন পুরো ম্যাপিংটা চাইবে, যে ভোট কবে হবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া বড় আকারে লেনদেনও শুরু করবে বলে মনে হচ্ছে না। বাইডেন প্রশাসনও এজন্য নির্বাচন নিয়ে কথা শুরু করেছিল, না করারও কোনো উপায় ছিল না, কেননা কাঠামোগত বিষয় আছে।
দেশ রূপান্তর : বাইডেন প্রশাসনের ক্ষেত্রে দেখলাম যে দিল্লির চোখ দিয়ে ঢাকাকে দেখতে চাচ্ছে না ওয়াশিংটন। এখানে কি ট্রাম্প ফের দিল্লির চোখ দিয়ে দেখা শুরু করবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এটার দুটো দিক আছে। একটা হলো টুইটে যেহেতু ট্রাম্প অলরেডি বলেছেন যে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তিনি বড় সম্পর্ক করবেন এবং যেহেতু মোদির সঙ্গে তিনি বড় সম্পর্ক করবেন তাতে বর্তমান যে অ্যাটেনশনটা ডেমোক্রেটিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দিয়েছে সেখানে ভাটা পড়তে পারে। সেটা বলা যেতে পারে। কারণ যেহেতু তিনি বড় আকারেই ভারতের নরেন্দ্র মোদির প্রতি অ্যাটেনশন দেবেন। আর দ্বিতীয়টা হলো বাংলাদেশের অ্যাটেনশন পাওয়ার বিষয়টা কিন্তু বাংলাদেশেরই করতে হবে। বাংলাদেশের পলিসি মেকাররা যদি দেখাতে পারেন যে বাংলাদেশও একটা মার্কেট, এখানেও একটা ভবিষ্যৎ আছে, এখানেও একটা ইনভেস্টমেন্টের বড় একটা কাঠামো তৈরি হয়েছে এবং ভালোভাবে যদি তারা দেখাতে পারে যে বাংলাদেশও রাইজিং ইকোনমিক পাওয়ার এই এরিয়াতে তাহলেই আমার মনে হয় বর্তমানের ধারাবাহিকতাটা কিছুটা থাকবে। যদি বাংলাদেশ ভালো করতে পারে তাহলে আমার মনে হয় না খুব একটা ঝামেলা হওয়ার কথা।
দেশ রূপান্তর : অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
ইমতিয়াজ আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
অনুলিখন : মোজাম্মেল হৃদয়