ব্রেক্সিট-ট্রাম্প যুগে ইউরোপ : ভূ-রাজনীতির নতুন সমীকরণ
খন্দকার আপন হোসাইন । সূত্র : ডেল্টা টাইমস্ , ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিশ্ব রাজনীতি এক মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকে না। নতুন নতুন মোড়, আকস্মিক চুক্তি, কিংবা অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত সবকিছুই নির্ধারণ করে ভবিষ্যতের গতিপথ। তবে কখনো কখনো কিছু ব্যক্তির উপস্থিতি বিশ্বকে এক দিক থেকে অন্য দিকে প্রবাহিত করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তেমনই একজন। তিনি হোয়াইট হাউসে থাকুক বা না থাকুক তাঁর ছায়া বিশ্ব রাজনীতির সর্বত্র বিরাজমান। বিশ্ব রাজনীতি অদ্ভুত এক ঝুঁকির পথে হাঁটছে। একদিকে বিশাল শক্তির নায়কদের সমাবেশ। অন্যদিকে বিপন্ন ছোট ছোট দেশগুলোর উদ্বেগ। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হতে না হতেই পুরো ইউরোপজুড়ে কাঁপন শুরু হয়েছে। ইউরোপের ভবিষ্যত এখন তাঁর হাতে। কেমন হবে ইউরোপের ভবিষ্যৎ? কীভাবে তারা ঘুরে দাঁড়াবে এই বিপদ থেকে?
ইউক্রেন প্রসঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী ট্রাম্প। আলোচনার স্থান হতে পারে সৌদি আরবের রিয়াদ। ট্রাম্পের এমন ঘোষণায় ইউরোপের আকাশে অস্থিরতার মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কেন এসেছে? কারণ ট্রাম্পের কৌশল বরাবরই ইউরোপের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। ইউরোপের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আজ উদ্বিগ্ন ও দ্বিধাগ্রস্ত। কৌশলগতভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ ঠিক করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তারা। প্রথমবারের মতো ইউরোপ এরকম এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। তাদের শক্তির কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তিত হচ্ছে।
একসময় যুক্তরাষ্ট্রই ছিলো ইউরোপের শক্তির অন্যতম উৎস। এখন কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকা ইউরোপের ঐতিহাসিক মিত্র হতে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। ট্রাম্পের পলিসি ইউরোপের জন্য একধরণের অজানা অন্ধকারের মতো। ইউরোপের জন্য ট্রাম্প পলিসির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি। অর্থাৎ আমেরিকা কেবল আমেরিকার জন্য। ইউরোপের প্রতি মার্কিন মনোযোগ কমিয়ে নিজস্ব স্বার্থে মনোযোগ বৃদ্ধিই ট্রাম্পনীতি। এই নীতিটিই ইউরোপের জন্য ঝুকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকা পাশ থেকে সরে গেলে ইউরোপের দেশগুলোর একক নিরাপত্তা ও অর্থনীতির কী হবে?
বিশ্ব রাজনীতির আধুনিক ইতিহাসে ২০১৬ সালটি অস্বাভাবিক একটি বছর ছিল। ওই বছরেই দুটি ঘটনা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিসরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। একটি হলো ব্রেক্সিট এবং অন্যটি হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ। এসব ঘটনায় ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। নতুন মোড়ের প্রভাব এতটাই গভীর ছিল যে আজকের বিশ্ব পরিস্থিতি পূর্বপ্রভাবের পুনর্গঠিত রূপ। ২০১৬ সালের ২৩ জুন যুক্তরাজ্য জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তে যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠে আসে। ব্রেক্সিটের পেছনে মূল কারণ ছিল—দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপ, অভিবাসন সংকট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক নীতির প্রতি অসন্তোষ। এর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে।
প্রশ্নটি হলো ইউরোপের দেশগুলো কি তাদের ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে একত্রিত হতে পারবে? ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম শক্তিশালী সদস্যকে হারায়। এটি ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুরো ইউরোপকে একে অপরের থেকে আরও আলাদা করেছে। ইইউ কে একটি নতুন সংকটের সম্মুখীন করেছে। ফলে শুরু হয় ইউরোপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির নতুন আলোচনা। ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী নীতি ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত অবস্থান ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করছে। ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন আমেরিকার এককভাবে কাজ করার মানসিকতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করছে।
ব্রেক্সিট এবং ট্রাম্প উভয়ই ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এই দুটি ঘটনা ইউরোপের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কের নতুন ভিত্তি তৈরি হয়েছে। আবার ট্রাম্প নীতির কারণে আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে সম্পর্কের অবস্থা আরও জটিল হয়েছে। ইউরোপের জন্য এখনও সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। ব্রেক্সিটের পর ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে নতুন ধরনের সহযোগিতা এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
নিজেদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন সম্ভব হলে ইউরোপ পুনরায় একত্র হতে পারবে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সামনে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারবে। নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে এক নতুন অবস্থানে দাঁড়াতে পারবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একক প্রভাব বিস্তার রোধ করতে পারবে। আর সেজন্য ইউরোপের দেশগুলোর একে অপরের সাথে সহযোগিতা ও সম্পর্কের সমন্বয় প্রয়োজন। এই সংকটের অবসান হলে ইউরোপ অবশ্যই নতুন শক্তি হিসেবে উত্থিত হতে পারবে। যা তার নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপের জন্য অনেক বড় একটি সামরিক চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেন যুদ্ধ মানেই অস্তিত্বের প্রশ্ন। ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ইউরোপ এখন পর্যন্ত বিপুল অর্থ, অস্ত্র এবং কূটনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে। আমেরিকা এই যুদ্ধে সমর্থন কমিয়ে দিলে ইউরোপকে একা একাই রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ন্যাটো এবং ইইউ বরাবরই আমেরিকার সামরিক ও কূটনৈতিক ছায়ায় থেকেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকার নেতৃত্বে ইউরোপ তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এসেছে। কিন্তু ট্রাম্পের "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতি ইউরোপকে কঠিন বাস্তবতার উত্তাল ঢেউয়ে ফেলে দিয়েছে। ইউরোপের কর্তাব্যক্তিদের একাংশ মনে করছে আমেরিকার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা দরকার। আমেরিকার মনোযোগ ধরে রাখার জন্য তাদের কিছু ছাড় দিতে হবে। যেমন— ট্রাম্পকে খুশি করতে ইউরোপকে আমেরিকান গাড়ির ওপর শুল্ক কমিয়ে দেওয়া।
আমেরিকা থেকে বেশি বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করা ইত্যাদি। ইউরোপের কয়েকটি দেশ অবশ্য ইতোমধ্যেই আমেরিকা থেকে উন্নত অস্ত্র ক্রয় করছে। পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র এবং রোমানিয়া আমেরিকার তৈরি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার জন্য চুক্তি করেছে। ইউক্রেনও এই তালিকায় রয়েছে। কিন্তু ইউরোপের আরেকটি অংশ মনে করছে আমেরিকার ওপর অতি নির্ভরশীলতা আর নিরাপদ নয়। তারা বলছে, ইউরোপের এখন স্বনির্ভরতা বাড়াতে হবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে কথা বলে আসছে। ইউরোপের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সামরিক স্বনির্ভরতা। ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মূল স্তম্ভ এখনো আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ন্যাটো। ফ্রান্স ও জার্মানি স্বতন্ত্র ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করতে চায়। তবে সেটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
বর্তমানে ইউরোপের সামরিক ব্যয় বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তাদের সেনাবাহিনী এখনো বিভক্ত। প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমেরিকার তুলনায় পিছিয়ে। ইউরোপের প্রতিরক্ষা শিল্প বড় হলেও বিভিন্ন দেশ নিজেদের আলাদাভাবে পরিচালনা করে। ফলে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট। ফ্রান্স ইউরোপীয় সেনাদের ইউক্রেনে পাঠানোর পক্ষে। কিন্তু জার্মানি এই পদক্ষেপকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে। জার্মানির ইতিহাসগত কারণে তারা সামরিক আগ্রাসন পছন্দ করে না। সর্বোপরি ইউরোপকে স্বনির্ভর হতে হবে।
স্বনির্ভর হতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন- এক. সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি: ন্যাটোর নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি সদস্য দেশকে তাদের জিডিপির কমপক্ষে ২/৩% প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করতে হবে। কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশ এই নিয়ম মানছে না। দুই. প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ: ইউরোপকে নিজেদের উন্নত যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। তিন. রাজনৈতিক ঐক্য গঠন: ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিতে ঐক্যমত্য গড়ে তুলতে হবে। চার. ইউরোপের অর্থনৈতিক বাস্তবতা: ইউরোপের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানির উচ্চমূল্য, মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১.২%। ২০২৩ সালে ছিল ৩.১%। অর্থাৎ ইউরোপের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়ছে। রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কমিয়ে ইউরোপ এখন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু আমেরিকান নীতি পরিবর্তন হলে ইউরোপের জন্য ধাক্কাটা আরও বড় হবে। ইউরোপের সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে। এক পুরোপুরি আমেরিকার ওপরই নির্ভরশীল থাকা। এতে ইউরোপ স্বল্পমেয়াদে নিরাপত্তা পেলেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি বাড়বে। দুই স্বাধীনভাবে নিজেদের কৌশল নির্ধারণ করা। এটি কঠিন হলেও দীর্ঘমেয়াদে ইউরোপ শক্তিশালী হবে। ইউরোপ হয়তো সম্পূর্ণভাবে আমেরিকার ছায়া থেকে বের হতে পারবে না। তবে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করবে। বিশেষ করে বাণিজ্য ও প্রযুক্তি খাতে ইউরোপ আমেরিকার উপর আর নির্ভর করবে না।
বিশ্ব রাজনীতির চাকা প্রতিনিয়ত ঘুরছে। ট্রাম্প, পুতিন, বাইডেন সবাই এই সমীকরণের অংশ। মাঝখানে ইউরোপ আছে উভয় সংকটে। একদিকে রাশিয়ার হুমকি অন্যদিকে আমেরিকার অসহযোগিতা। সময় এসেছে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের। ইউরোপ কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সক্ষম হলে ট্রাম্পের ছায়ার মধ্যেও নিজেদের পথ তৈরি করতে পারবে। এই পথে অদেখা ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ এর অভাব নেই। বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাথে পাল্লা দিয়ে ইউরোপকে অবশ্যই নতুন দিগন্তের মুখোমুখি হতে হবে। সমাধান ও সম্ভাবনার জানালা উন্মুক্ত করতে হবে। বৈশ্বিক সম্পর্কগুলো পুনর্নির্মাণ করতে হবে। বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, এবং আরববিশ্বসহ অন্যান্য শক্তির সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে হবে। সম্মিলিতভাবে একযোগে কাজ করতে পারলে ট্রাম্পের ছায়ায় থেকেও তারা শক্তিশালী, স্বাধীন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গড়তে সমর্থ হবে।
লেখক : শিক্ষক, গবেষক ও সংগঠক