আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ন্যাম সম্মেলনের সময় মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হয়। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয় এবং তাদের মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। পরিস্থিতির উন্নয়নে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের পরিমাণ বাড়ানো খুবই জরুরি বলে মনে করেন জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। অস্ত্রবিরতি হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আবার আলোচনার পথ সুগম হবে বলে জানিয়েছেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
গ্রুপ অব সেভেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৯ এপ্রিল ইতালির ক্যাপ্রিতে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তা এবং রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ওপর জোর দেন। বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সব সদস্যরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ১০ জুলাই জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৬তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের জন্য অপর্যাপ্ত ও কমে আসা আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়।
ক্যাম্প পরিদর্শন ও ত্রাণ সহায়তা
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মহাপরিচালক অ্যামি পোপ ৭ মে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা এবং মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা একটা বড় চ্যালেঞ্জ বলে বাংলাদেশ সরকারকে অবহিত করেন। ২২ মে অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সেবা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন এবং নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের পাশে থাকবে ও রোহিঙ্গাদের মানবিক সেবা কার্যক্রমে অস্ট্রেলিয়ার সহযোগিতাও অব্যাহত রাখবে বলে জানান। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট কেট ফোর্বস ৪ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এবং কক্সবাজারে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চলমান মানবিক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। ৬ জুন কারিতাস ইন্টারন্যাশনালিজের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যালিস্টার ডাটন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে বিশ্ববাসীকে রোহিঙ্গাদের জন্য আরও সহায়তার আহ্বান জানান। কারিতাস রোহিঙ্গাদের জন্য ৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফরিন আক্তার ১৭ অক্টোবর উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেন। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এ সমর্থন চলমান রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের জন্য ৭০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক। ৭০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান ও ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ। ৩১৫ মিলিয়ন ডলার অনুদানের সঙ্গে এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে আরও ৩৮৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ইউনিসেফ ও ব্র্যাক ভাসানচরে ৩৮টি ক্লাস্টারে ১৮টি স্কুলের মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীর পাঠদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন, বাণিজ্যিকভাবে সবজি উৎপাদন এবং সবজি চাষে সহযোগিতা দিচ্ছে। এসব কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৯৫০ জনকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাসিক আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নয়ন ঘটেছে। বর্তমানে ৮ হাজার ২২২টি রোহিঙ্গা পরিবারের ৩৫ হাজার ২৬ জন সদস্য সেখানে বসবাস করছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে এএ’র চলমান সংঘাতের সময় গুলি ও মর্টারশেল বিস্ফোরণে বাংলাদেশের ভেতরে দুজনের মৃত্যু ও ৯ জন আহত হয়। এপ্রিলে নাফ নদীতে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীর কাছে এসব ঘটনার পর প্রতিবাদপত্র পাঠায়। মিয়ানমার থেকে আসা গোলাগুলির কারণে ৫ জুন থেকে প্রায় ১০ দিন ধরে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাতায়াত, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায় এবং সেখানে বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিরাপত্তাহীনতাসহ খাদ্য সংকটে পড়ে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে এএ চলমান সংঘর্ষের কারণে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিজিপি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। ১৫, ২৫ এপ্রিল ও ৯ জুন তিন দফায় ৭৫২ জন বিজিপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। ১৪ আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২৩ জন বিজিপি সদস্যও পরবর্তীকালে মিয়ানমারে ফিরে যায়। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
রোহিঙ্গা-রাখাইন উত্তেজনা
রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মোতায়েন করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকারের পক্ষে লড়াই করার জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয় এবং পরিকল্পিতভাবে উত্তর রাখাইনের পরিস্থিতি জটিল করে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ানোর পরিকল্পনা করে। রাখাইনের মংডু দখলের পর জাতিগত বিদ্বেগ উসকে দেওয়ার জন্য একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মম সেনা অভিযানের আগে ফেসবুকের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল এবং এর পেছনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে জাতিসংঘের তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে। ফেসবুক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ২০২১ সালে রোহিঙ্গারা ফেসবুকের বিরুদ্ধে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মামলা করে।
সংকট নিরসনে নেওয়া উদ্যোগ
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ত্রাণ সংস্থা স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার ১৯ আগস্ট এক বিবৃতিতে রাখাইন রাজ্যে একটি মানবিক করিডর চালু করতে এবং রাষ্ট্রের সব জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য আরাকান আর্মির প্রতি আহ্বান জানায়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিনটি প্রস্তাব দেন। জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে সব স্টেকহোল্ডার নিয়ে সম্মেলন আহ্বান করে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টার থমাস অ্যানড্রুজের সঙ্গে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চান। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করছে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময়ে নেওয়া পরিকল্পনা অনুসারে রোহিঙ্গাদের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার বিষয়ে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
রোহিঙ্গাদেরও তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের শিক্ষিত করা প্রয়োজন। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের আত্মনির্ভরশীল করা গেলে তারা নিজেদের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে পারবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আগামী দিনগুলোতে মিয়ানমারে যে সরকারই আসুক, আরাকান আর্মি রাখাইনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আরাকান আর্মিকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা একজন উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন, যা একটি কার্যকর পদক্ষেপ।
তিনি গভীরভাবে এ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ও সমন্বয় করবেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারে একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরির জন্য সব অংশীজনকে একত্রে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। যে কোনো পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও আর্থিক সাহায্য চলমান রাখতে জরুরি ভিত্তিতে আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ ও রিজার্ভ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা ও নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে এএ, জাতীয় ঐক্যের সরকার এবং অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে অর্থবহ রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে হবে।
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসা এবং ডিসেম্বরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে আসায় নতুনভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২০২৫ সালে অর্থবহ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এটাই কাম্য।
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.) : মিয়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক