চীন, জিসিসি ও আসিয়ানের সম্মিলিত যাত্রা
ড. সুজিত কুমার দত্ত [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০২ জুন ২০২৫]

বৈশ্বিক অর্থনীতির পটভূমিতে যখন অস্থিরতা, বাণিজ্যযুদ্ধ আর ভূ-রাজনৈতিক টানাপড়েন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, তখন আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ও কৌশলগত সংহতি এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি এবং চীনের মধ্যে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো এবং রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিগুলো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে আসিয়ান, জিসিসি এবং চীনের মধ্যে এই কৌশলগত সহযোগিতা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। দেশগুলোর সম্মিলিত যাত্রার মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যের অস্থিরতা সত্ত্বেও নিজেদের স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করা।
আসিয়ান (ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম) একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যদিকে জিসিসি (বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদক এবং বৈশ্বিক জ্বালানি সুরক্ষায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আর চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে তার বিশাল উৎপাদনক্ষমতা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এই তিন অঞ্চলের সম্মিলিত জিডিপি প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্ব অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ।
আসিয়ান কৃষিপণ্য, খনিজ সম্পদ এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন শিল্পের জন্য পরিচিত। জিসিসি দেশগুলো বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও গ্যাস রিজার্ভ ধারণ করে, যা চীনের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অপরিহার্য।
অন্যদিকে চীন উন্নত প্রযুক্তি, অবকাঠামো এবং বিশাল উৎপাদন সক্ষমতার অধিকারী। এই বৈচিত্র্যময় সম্পদ এবং ক্ষমতা একত্র হয়ে একটি শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল এবং স্থিতিশীল সাপ্লাই চেইন তৈরি করতে পারে, যা বৈশ্বিক অস্থিরতা থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, জিসিসি চীনকে তার মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সরবরাহ করে, যা চীনের শিল্প চাকার অবিরাম ঘূর্ণনের জন্য অপরিহার্য।
মার্কিন শুল্কের হুমকির মুখে আসিয়ান ও জিসিসি দেশগুলোকে তাদের বাণিজ্য বহুমুখী করার সুযোগ দেবে। একক বাজারের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে একাধিক শক্তিশালী বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলে বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ঝুঁকি হ্রাস পাবে।
এটি দেশগুলোকে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার প্রতি আরো আস্থাশীল করে তুলবে।
অর্থনৈতিক শক্তি ছাড়াও এই দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে চীন আসিয়ানের কাছে নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। অন্যদিকে জিসিসি দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখলেও তারা চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী, যা তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি ইঙ্গিত। আসিয়ান, জিসিসি এবং চীন তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে এমন একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে, যা আরো সংযুক্ত, আরো স্থিতিস্থাপক এবং আরো সমৃদ্ধ। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও এই দেশগুলোর সম্মিলিত প্রভাব বহুগুণ বৃদ্ধি করবে।
চীন আসিয়ানের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার এবং দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে চীন আসিয়ানের কাছে নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করছে। এটি কেবল বাণিজ্যের মাধ্যমেই নয়, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের আদান-প্রদানের মাধ্যমেও প্রতিফলিত হচ্ছে। চীনের বিশাল পুঁজি এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আসিয়ানের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের বিনিয়োগ তাদের অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণে, শিল্পায়নপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি আনতে সাহায্য করবে। একইভাবে জিসিসি দেশগুলো চীনের বিশাল জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সক্ষম, যা তাদের অর্থনীতির জন্য একটি স্থিতিশীল রপ্তানি বাজার নিশ্চিত করে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘চার্ম অফেনসিভ’ সত্ত্বেও জিসিসি দেশগুলো চীনের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে জিসিসি দেশগুলো অর্থনৈতিক সুযোগের প্রতি বেশি মনোযোগী এবং তারা বৈশ্বিক বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চায়, তা যেকোনো দেশের সঙ্গেই হোক না কেন। এই ভারসাম্য রক্ষার কৌশল তাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে।
চীন, জিসিসি ও আসিয়ানের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইনি কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং পরিবেশগত প্রভাবের মতো বিষয়গুলোকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা এবং নিয়মিত আলোচনার প্রয়োজন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হুমকির মুখে বৈশ্বিক বাণিজ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা মোকাবেলায় চীন, জিসিসি ও আসিয়ানের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তাদের পারস্পরিক সহযোগিতা শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই আনবে না, বরং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতাকেও জোরদার করবে। এটি সহযোগিতার এমন একটি মডেল তৈরি করবে, যা অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোকেও পারস্পরিক সুবিধার জন্য একত্র হতে উৎসাহিত করবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়