চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনা কোন পথে
ড. সুজিত কুমার দত্ত [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৫ জুন ২০২৫]

লন্ডনের কেন্দ্রে অবস্থিত সুবিশাল ল্যাঙ্কাস্টার হাউস সম্প্রতি আবারও বৈশ্বিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক শক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিরা যখন বাণিজ্য আলোচনার জন্য নতুন করে সেখানে সমবেত হলেন, তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের সতর্ক আশাবাদ ছড়িয়ে পড়ল। মাসব্যাপী পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপ, কড়া সমালোচনা এবং চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মধ্যে একটি ফোন কল এই আলোচনার পথ খুলে দেয়, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ আশার আলো নিয়ে আসে। মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিকের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী মার্কিন প্রতিনিধিদল এবং চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী হি লাইফেংয়ের নেতৃত্বে চীনা প্রতিনিধিদল এই বৈঠকে অংশ নিয়েছিল।
তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতির মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসন করা; যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছিল। বিশ্ববাসী গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছিল কিভাবে এই বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল, বিনিয়োগকে স্থবির করে তুলছিল এবং কয়েক দশকের সমৃদ্ধির ভিত্তি স্থাপনকারী বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। এই আলোচনার মাধ্যমে লন্ডন অন্তত কিছু সময়ের জন্য সেই উত্তেজনা প্রশমনের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
গত মাসেই সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আলোচনা একটি সংক্ষিপ্ত স্বস্তি এনেছিল, যার ফলস্বরূপ একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে ‘সম্পূর্ণ নতুন সূচনা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই মে মাসের চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর তার শুল্ক কমিয়ে ৩০%-এ নামিয়ে আনে, যেখানে বেইজিং মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক ১০%-এ নামিয়ে আনে। এই চুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল চীনের পক্ষ থেকে অত্যাবশ্যকীয় খনিজ রপ্তানির ওপর বিদ্যমান বাধা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি, যা বিরল খনিজ নিয়ে আমেরিকার উদ্বেগকে প্রশমিত করার জন্য ছিল। এই খনিজগুলো স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য।
একটি ৯০ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে উভয় পক্ষকে একটি ব্যাপক বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করার কথা ছিল। তবে সেই ‘সম্পূর্ণ নতুন সূচনা’ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুইস চুক্তিতে কালি শুকানোর আগেই ওয়াশিংটন এবং বেইজিং একে অপরের বিরুদ্ধে অ-শুল্ক প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। বেইজিং বিশেষ করে বেশ কিছু অভিযোগ উত্থাপন করে। এর মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনা কম্পানিগুলোর কাছে কম্পিউটার চিপ ডিজাইন সফটওয়্যার বিক্রি বন্ধ করা, চীনা প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ের তৈরি চিপ ব্যবহার না করার বিষয়ে সতর্কতা জারি করা এবং চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করা।
চীন যুক্তি দিয়েছিল যে এই পদক্ষেপগুলো যুদ্ধবিরতির মূল চেতনার পরিপন্থী এবং একটি গভীর প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রকাশ করে, যা বাণিজ্য বিরোধের আড়ালে বিদ্যমান। এই ধরনের অভিযোগগুলো গভীর অবিশ্বাস এবং চুক্তি বাস্তবায়নে বিদ্যমান জটিলতাগুলো তুলে ধরে। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি চিনপিংয়ের মধ্যে একটি ফোনালাপ হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে খুব ভালো আলোচনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং এই সরাসরি যোগাযোগের লাইনটি একটি স্থবির প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা যোগ করেছে বলে মনে হচ্ছে।
লন্ডনের দুদিনের তীব্র আলোচনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে একটি ‘চুক্তি’ হয়েছে। তিনি বলেছেন, চীনের পক্ষ থেকে মার্কিন কম্পানিগুলোকে ম্যাগনেট এবং বিরল খনিজ সরবরাহ করা হবে, আর যুক্তরাষ্ট্র চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের হুমকি থেকে সরে আসবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ৯ জুলাইয়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চতর শুল্ক পুনরায় আরোপের যে সময়সীমা ছিল, তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে, যা বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটি বড় স্বস্তি। মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিকও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে এই চুক্তির মাধ্যমে বিরল খনিজ ও ম্যাগনেটের ওপর আরোপিত বিধি-নিষেধগুলোর সমাধান হওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের একটি ব্যাপক ও চূড়ান্ত সমাধান এখনো একটি কঠিন কাজ, যা ঐতিহাসিক বোঝা এবং ভূ-রাজনৈতিক জটিলতায় পূর্ণ, তবে উত্তেজনা বাড়ার পর উভয় পক্ষের আলোচনার টেবিলে বসা নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ট্রাম্প ও শি-র মধ্যে ফোনালাপ যতই সংক্ষিপ্ত হোক না কেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পর্যায়ের সম্পৃক্ততা এনেছে, যা আগে অনুপস্থিত ছিল। এই ‘লন্ডনের বরফ গলা’ যদি শুধু ক্ষণিকের স্বস্তি না হয়ে একটি টেকসই প্রচেষ্টার সূচনা হয়, তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আবারও গতি ফিরে পাবে, সরবরাহ ব্যবস্থা স্থিতিশীল হবে এবং ব্যবসাগুলো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিকল্পনা করতে পারবে। বিশ্বের দুটি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে একটি আরো অনুমানযোগ্য এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়