কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে

ড. মো. আবু হাসান [সূত্র : ইনকিলাব, ১৮ আগস্ট ২০২৫]

চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে

ইতোপূর্বে আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির ঐতিহাসিক প্রবণতা এবং ভারত ও পশ্চিমা শক্তির দ্বারা সৃষ্ট শোষণ ও পরনির্ভরশীলতার ফাঁদ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি, কীভাবে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং লুটেরা পুঁজিবাদের কাঠামো এই শোষণকে আরও সহজ করেছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ক্রমাগত হুমকির মুখে ফেলেছে। আজ আমরা এই শোষণের চক্র ভাঙার একটি সম্ভাব্য পথ অর্থাৎ, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং এর ‘উইন-উইন’ সহযোগিতার মডেল নিয়ে আলোচনা করব। চীনের দিকে একটি কৌশলগত বাঁক কেবল একটি অর্থনৈতিক পছন্দ নয়, বরং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং প্রকৃত উন্নয়ন সাধনের জন্য একটি ভূরাজনৈতিক অপরিহার্যতা। এই বাঁক কীভাবে বাংলাদেশের জন্য সার্বভৌমত্বের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে, তা নিয়েই এই বিশ্লেষণ।

 

 

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর দ্বিমেরু বিশ্ব নয়, বরং এটি বহু-মেরু এবং জটিল, যেখানে বিভিন্ন শক্তি ব্লক তাদের প্রভাব বিস্তারে সক্রিয়। নতুন ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্লকের উত্থান ঐতিহ্যবাহী জোট নিরপেক্ষতাকে অপ্রচলিত করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের সমন্বয়ে ‘কোয়াড’ একটি সরাসরি সামরিক জোট, যা স্পষ্টভাবে চীনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে গঠিত। এই জোটের সামরিকীকরণ এবং এর চীন-বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করে যে, বৈশ্বিক রাজনীতি এখন আর নিরপেক্ষতার সুযোগ দেয় না। বিপরীতভাবে, ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) এবং চীনের বিআরআই নতুন অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সারিবদ্ধতাকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা ঐতিহ্যবাহী পশ্চিমা-প্রভাবিত কাঠামোর বাইরে উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিকল্প পথ প্রস্তাব করে। এই ব্লকগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পশ্চিমা প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সহায়তা করছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’। সবার সাথে বন্ধুত্ব’ নীতিগতভাবে মহৎ বটে, তবে বৈশ্বিক শক্তিগুলি যখন সক্রিয়ভাবে একচেটিয়া ব্লক গঠন করে এবং জিরো-সাম কৌশল অনুসরণ করে তখন এটি একটি দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়। এমন পরিবেশে, প্রকৃত নিরপেক্ষতা অসম্ভব; নিষ্ক্রিয়তাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয় এবং একটি জাতি তার ভাগ্য গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হওয়ার পরিবর্তে বাহ্যিক চাপের নিষ্ক্রিয় প্রাপক হয়ে ওঠে। উপরন্তু, যখন অভ্যন্তরীণ শাসন ‘অনুগত’ অভিজাত গোষ্ঠীতন্ত্র দ্বারা আপসকৃত হয়, তখন এই নিষ্ক্রিয় জোট নিরপেক্ষতা বিদেশি শক্তিগুলিকে উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ ছাড়াই জাতিকে শোষণ করার জন্য অবাধ সুযোগ দেয়, কারণ কোনও স্পষ্ট কৌশলগত দিকনির্দেশনা বা শক্তিশালী জাতীয় স্বার্থ নীতিকে পরিচালিত করে না। এটি কেবল একটি পররাষ্ট্রনীতিগত মতবাদের সমালোচনা নয়, বরং বাহ্যিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ শাসন ঘাটতি উভয় ক্ষেত্রেই এর ব্যবহারিক ব্যর্থতার একটি অভিযোগ। ক্রমবর্ধমান খ-িত ও প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক ব্যবস্থায় ছোট দেশগুলোর উচিত জাতীয় স্বার্থকে সক্রিয় ও কৌশলগতভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া; কারণ, নিষ্ক্রিয় নিরপেক্ষতা একাধিক পরাশক্তির ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতার দ্বারা শোষিত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে।

 


চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশকে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, যা ভারত ও পশ্চিমের সাথে শর্তযুক্ত এবং প্রায়শই শোষণমূলক সম্পর্কের বিপরীতে একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। চীনের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একটি ‘উইন-উইন’ কৌশল প্রস্তাব করে। চীনের এই উদ্যোগ কেবল অবকাঠামো নির্মাণেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অংশ, যা অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সাথে পারস্পরিক সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি করে।

 

 

চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অবকাঠামো উন্নয়নে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সক্ষমতাকে নতুন মাত্রা প্রদান করছে। বিশেষ করে চীন বিআরআই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার সরাসরি বিআরআই প্রকল্পের জন্য এবং ১৪ বিলিয়ন ডলার যৌথ উদ্যোগের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত চীন ৩৫টি প্রকল্পের জন্য ৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। চীনের বিনিয়োগ মূলত বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীভূত, যেমন সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ ও শক্তি, জলবিজ্ঞান এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি। উদাহরণস্বরূপ, পদ্মাসেতুর রেল লিঙ্ক, পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, ডিজিটাল কানেক্টিভিটি প্রকল্প এবং পাওয়ার গ্রিড শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে চায়। চীনের অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মোট জিডিপি ১.২ থেকে ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে বলে অনুমান করা হয়। এই মেগা প্রকল্পটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করছে, যা আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সংযোগ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থান এবং শিল্পোন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। চীন বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, যার মধ্যে রয়েছে ১২টি হাইওয়ে ও ২১টি সেতু প্রকল্প, যা বাংলাদেশকে আধুনিক সিল্ক রোডের অংশ হিসেবে পরিগণিত করে। এছাড়া তিস্তা মহাপরিকল্পনা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিভিন্ন শক্তি ও বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত। এসব প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড় জিডিপি ২ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার সম্ভাবনা বহন করে।

 

পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণেও চীনের প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই বন্দর ভারতের উপকূলের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক ও সামরিক কৌশলগত অবস্থানকে মজবুত করে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশটির অংশগ্রহণ বাড়ায় এবং বিদেশি বন্দরের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আঞ্চলিক অর্থনীতিতে দেশের প্রভাব বাড়ায়। পায়রা বন্দর বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অর্থনৈতিক করিডোর সৃষ্টি করবে, যা সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদারে এবং বঙ্গোপসাগরে দেশের কৌশলগত উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২,৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি প্রায় ৩০% কমিয়ে দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এটি রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত, তবে এটি দেশের জ্বালানি ও শক্তি নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য এবং পশ্চিমা শর্তযুক্ত সাহায্যের বাইরে একটি বিকল্প শক্তি অবকাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রকল্পগুলো চীনের একটি ভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মডেল উপস্থাপন করে, যা জাতীয় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও ভূরাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা দাবি করার ওপর জোর দেয় এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

 

 


বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যে বর্তমানে বড় ব্যবধান থাকলেও সম্ভাবনা বিস্তৃত ও তাৎপর্যপূর্ণ। চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আমদানি উৎস, যেখানে বাংলাদেশের মোট আমদানি ব্যয়ের প্রায় ২৬-২৮ শতাংশ চীন থেকে হয়। তবে বাংলাদেশের চীনে রপ্তানি মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি, যার ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে প্রচুর ঘাটতি আছে। চীন ২০২০ সাল থেকে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশের পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে আসছে এবং ২০২২ সালে তা বেড়ে ৯৮ শতাংশ হয়েছে। এরপর থেকে চীন বাংলাদেশসহ এলডিসি দেশগুলোর জন্য ১০০ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করেছে, যা ২০২৮ সাল পর্যন্ত থাকবে। এ সুবিধার মাধ্যমে বাংলাদেশ চীনের বিশাল বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। তবে বাস্তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি, কারণ বাংলাদেশের পণ্যের বৈচিত্র্য কম, বিশেষত চীনের বাজারে তৈরি পোশাকে প্রবেশ সীমিত। চীনের বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক হওয়ায় মানসম্মত পণ্য উৎপাদন করা এবং সঠিক বিপণন কৌশল নিতে হবে। বাংলাদেশ চীনের বৃহৎ বাজারে প্রবেশে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হিসেবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ইলেকট্রনিক্স, হালকা প্রকৌশল ও সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কৃষিপণ্য, ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা ও ই-কমার্স ক্ষেত্রেও সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের উদ্যোগে চায়নিজ ইকোনমিক জোন নির্মাণসহ বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, যা শিল্প স্থানান্তরের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক হবে। সার্বিকভাবে, চীনের বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি ও বাজার বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সঠিক নীতি, বিনিয়োগ ও প্রস্তুতির মাধ্যমে বাংলাদেশ চীনের বাজারে প্রবেশ করে রপ্তানি বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের বাইরে বৈচিত্র্যময় ও মানসম্মত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে কাজ করলে বাংলাদেশের চীন বাণিজ্যের ঘাটতি অনেকটা কমবে এবং অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আসবে। বর্তমানে চীনের মোট আমদানির মাত্র ০.৪ শতাংশ আসে বাংলাদেশ থেকে; এটি ১% হলে চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি দাঁড়াবে ২৬ বিলিয়ন ডলার।

 

 


১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে দারুণ উত্থান পেয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে উঠে এসেছে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো ও শিল্প খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ সম্পাদিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারিত্বের পর্যায়ে গড়ে উঠেছে এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের আওতায় পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ও সহযোগিতা আরও মজবুত হচ্ছে। এ বছরই বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হতে যাচ্ছে। চীন বাংলাদেশকে প্রতিবেশী কূটনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচনা করে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা ও মানবিক বিনিময় বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একাধিক উদ্যোগ ও প্রস্তাব চীনের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। সার্বিকভাবে, বাংলাদেশ-চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক আজ শক্তিশালী, বহুমাত্রিক এবং ভবিষ্যৎপ্রাপ্তির জন্য সম্ভাবনাময়। চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একটি বিকল্প পথ তৈরি করে, যা দেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

 

 


বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উপলব্ধি করা জরুরি যে, সঠিক কৌশল নির্ধারণ না করার ব্যর্থতা এবং অভ্যন্তরীণ শাসনের দুর্বলতার জন্য বিদেশি প্রভাব অবাধে প্রবেশ করে দেশের সার্বভৌমত্বের মূল ভিত্তি দুর্বল করে দিতে পারে। তাই, চীনের দিকে কৌশলগত বাঁক নেওয়ার সময় বিশেষভাবে নি¤œলিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখা উচিত।

 

১. অবকাঠামো চুক্তি পুনর্গঠন: ভবিষ্যৎ বিআরআই প্রকল্পগুলোর জন্য, বাংলাদেশকে শর্তাবলি পুনর্গঠন করতে হবে যাতে স্থানীয় শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তি, উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং কঠোর পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন নিশ্চিত করা যায়। এটি কেবল বিদেশি-নেতৃত্বাধীন প্রকল্পগুলো গ্রহণ না করে স্থানীয় সুবিধা সর্বাধিক করবে, অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা তৈরি করবে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। দায়িত্বশীল ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত করাই বিআরই প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের মূল চাবিকাঠি। এই পদক্ষেপগুলো নিশ্চিত করবে যে বিদেশি বিনিয়োগ দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে অবদান রাখছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে।

 


২. বহুমুখী কূটনীতি: চীনের দিকে বাঁক নেওয়ার সময়, বাংলাদেশকে একই সাথে রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্কের মতো অন্যান্য উদীয়মান শক্তিগুলোর সাথে সমান্তরাল সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। এই বহুমুখী কূটনৈতিক পদ্ধতি কোনো একক শক্তির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা হ্রাস করবে, কৌশলগত নমনীয়তা বজায় রাখবে এবং বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াবে। এটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য আনবে এবং দেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনকে পাশে পেতে বাংলাদেশকে সক্রিয় ও কৌশলগত কূটনীতি চালাতে হবে। এজন্য দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা, চীনের সঙ্গে মানবিক সহায়তা ও পুনর্বাসন উদ্যোগে অংশীদারিত্ব বাড়ানো এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের গুরুত্ব চীনকে বোঝানো জরুরি।

 


৩. অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব: অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্জনের পথে বাংলাদেশে ২০২৫ সালে ব্যাংক খাতকে মুষ্টিমেয় কিছু শক্তিশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ব্যাংকক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, সম্পদের গুণগত মূল্যায়ন, নিরীক্ষা এবং ঋণ খেলাপির নিরীক্ষণসহ তিনটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করা হয়েছে। এছাড়া ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫’ অনুমোদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই সংস্কারগুলো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুরক্ষা বহুগুণ বৃদ্ধি করবে এবং বিদেশি প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ দুর্বৃত্তের প্রভাব থেকে ব্যাংকখাতকে মুক্ত করবে। তবে এই সংস্কার বাস্তবায়নে সফলতার জন্য ‘রাজনৈতিক নেতৃত্বের আলোকিত সমর্থন’ অপরিহার্য, কারণ প্রকৃত অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব তখনই অর্জন সম্ভব যখন কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে কঠিন সংস্কার নেওয়া হয়। বিনিয়োগের ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, উচ্চ সুদের হার ও দুর্নীতি সংস্কারের পথে বড় বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে এ বাধাগুলো অতিক্রম করা দরকার। অর্থনৈতিক সংস্কারে দীর্ঘমেয়াদি সফলতার জন্য রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, কর কাঠামোর আধুনিকায়ন, ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশন বৃদ্ধি, সরকারি প্রকিউরমেন্টে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য এবং জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাটাও সংস্কারকে টেকসই করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সার্বিকভাবে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংস্কার এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এই উদ্যোগগুলো যদি রাজনৈতিক সংকল্প ও যথাযথ বাস্তবায়ন পায়, তবে তা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করে তুলবে এবং দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়নের ভিত্তি গড়ে তুলবে।

 

 


৪. সামরিক-কৌশলগত চুক্তি: ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য, বাংলাদেশের চীনের কাছ থেকে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি যেমন রাডার সিস্টেম এবং ড্রোন প্রযুক্তি আমদানি বিবেচনা করা উচিত। এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াবে, একটি কৌশলগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রদান করবে এবং ঐতিহ্যবাহী সামরিক সরবরাহকারীদের উপর নির্ভরতা হ্রাস করবে যাদের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডা ভিন্ন হতে পারে। এই সামরিক সহযোগিতা বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 

 

বাংলাদেশের জন্য জোট নিরপেক্ষতা এখন শুধুই বিলাসিতা। ভারত ও পশ্চিমা শোষণ মোকাবেলায় চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বই একমাত্র কার্যকর পথ। তবে, এই পদক্ষেপ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে গ্রহণ করতে হবে; লক্ষ্য ‘বিদেশি প্রভুদের অনুগত গোবেচারা’ হওয়া নয়, বরং ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ফার্স্ট’ নীতিগ্রহণ করা। এর অর্থ হলো, বাহ্যিক চাপ নির্বিশেষে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বকে সবার উপরে অগ্রাধিকার দেওয়া। এই কৌশলগত বাঁকের সাফল্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। এর জন্য শক্তিশালী ‘রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি’ এবং ‘প্রশাসনিক দুর্নীতি’ প্রতিরোধের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলো মোকাবেলা না করলে, যেকোনো কৌশলগত পুনর্গঠন কেবল এক ধরনের নির্ভরতাকে অন্য ধরনের নির্ভরতা দিয়ে প্রতিস্থাপন করার ঝুঁকি বহন করে। যদি বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংকল্প প্রদর্শন করতে পারে, কার্যকরভাবে দুর্নীতি রোধ করতে পারে এবং কু-রাজনৈতিক অর্থনীতির জটিল জাল ছিন্ন করতে পারে, তবে এই কৌশলগত পরিবর্তন উন্নত দেশে রূপান্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে। সময় সচেতন হওয়ার। সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার; যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এবং দেশকে প্রকৃত সার্বভৌমত্বের পথে নিয়ে যাবে।


লেখক: অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক