ছায়াঘন সাম্রাজ্যের প্রবল প্রকাশ
হাবীব ইমন। সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১১ মে ২০২৫]

রাত যত গভীর হয়, রাইফেলের শব্দ তত গর্জে ওঠে। দূরে কোনো পাহাড়ি সীমান্তে নয়, বরং হৃদয়ের গভীরে, ইতিহাসের মৃতপ্রায় পান্ডুলিপিতে, কূটনীতির শীতল বাতাস ও মানচিত্রের ক্লান্ত রেখায় সে শব্দ আঘাত হানে। যুদ্ধ কেবল বুলেটের শব্দে ঘটে না তা গড়ে ওঠে চুক্তির রক্তে, প্রটোকলের মুচড়ে যাওয়া পাতায় আর আমাদের সম্মতির অলিখিত নীরবতায়। এই মুহূর্তে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে পুরোপুরি যুদ্ধ চলছে না, তবুও যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। যুদ্ধ আসলে শব্দের খেলা, বিভ্রান্তির রাজনীতি, এক অদৃশ্য যুদ্ধশালা যেখানে প্রতিটি নাগরিক পরিণত হচ্ছে একেকজন সৈনিকে। কখনো মোবাইল স্ক্রিনে, কখনো চায়ের দোকানের বিতর্কে, কখনো আবার জাতিসংঘের কণ্ঠে।
বিশ^রাজনীতির মানচিত্রে এখন উত্তাপের রঙ গাঢ়। প্যালেস্টাইন থেকে কাশ্মীর, ইউক্রেন থেকে মিয়ানমার, মানুষ মরছে, ক্ষমতা হাসছে। সাম্রাজ্যবাদ একসময় যেভাবে বন্দুকের জোরে উপনিবেশ কায়েম করত, আজ সেই একই কৌশল চলছে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যের দাপটে। এই জটিল এবং নির্মম বাস্তবতায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অবস্থান কোন দিকে এই প্রশ্ন কেবল কূটনৈতিক নয়, একান্তভাবে রাজনৈতিক ও মানবিকও বটে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক সংঘাতের মাঝখানে, যে সংঘাত আমাদের তৈরি নয়, যার বীজ অন্যের হাতে বোনা, কিন্তু ফল আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের প্রতি অন্ধ আনুগত্য আর পাকিস্তানের প্রতি ধর্মীয় আবেগ এই দুই মেরুর মাঝে পড়েছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। ২২ এপ্রিল ২০২৫। কাশ্মীরের পেহেলগামে ২৬ জন নিহত। ভারত অভিযোগ করে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে। পাকিস্তান অস্বীকার করে। পাল্টা হামলা, বিমান ধ্বংস, সীমান্তে উত্তেজনা, নিহতের সংখ্যা ৫০-এর কাছাকাছি। কাশ্মীরের আকাশে ধোঁয়ার রেখা যখন ক্রমে অন্ধকার হয়ে আসে, একই সময়ে গাজার আকাশে ইসরায়েলের আগ্রাসনে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়। দুটি ভিন্ন মানচিত্র, দুটি ভিন্ন ভাষা তবু একটাই ছায়া : সাম্রাজ্যবাদ। সেই ছায়া যখন ঘন হয়, তখন জাতিসংঘ শুধু বিবৃতি দেয়, যুক্তরাষ্ট্র কেবল উদ্বেগ জানায়, আর চীন-মস্কো-ওয়াশিংটন সবাই হাসে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে যে রক্ত ঝরে, তা কোনো ক্ষমতাধর মানে না।
ইতিহাস কেবল ‘মিত্র’ আর ‘শত্রু’র গল্প বলে। কিন্তু মানুষ চায় জীবন। এই উত্তেজনা, এই যুদ্ধ-হুঙ্কার সবই পুরনো এক যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি, যেখানে রাষ্ট্র নামক শিকারিরা নিজেরাই জনগণকে ভয়ে রাখে, ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু আসল শিকার কে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে পৌঁছাতে হয় ১৯৪৭-এর বিভাজনে, যেখানে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন খণ্ড-বিচ্ছিন্ন করে দিল দুই ভ্রাতৃপ্রতিম জাতিকে। কেবল ধর্মের বিভাজন নয়, ছিল ভূগোলের ভাগাভাগি, ইতিহাসের বিকৃতি এবং জনগণের আত্মপরিচয় মুছে ফেলার এক নিষ্ঠুর প্রয়াস। এই বিভাজনের সুফল আজও ভোগ করছে সাম্রাজ্যবাদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক সাম্রাজ্য ন্যাটো এই উপমহাদেশের দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করছে একটি ‘ডিপ ফ্রন্টিয়ার’ হিসেবে, যেখানে অস্ত্র বিক্রি, সামরিক চুক্তি এবং ‘সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা’র নামে লালিত হচ্ছে স্থায়ী উত্তেজনা। যখন ভারত আমেরিকার সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া করে কিংবা পাকিস্তান আইএমএফের ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে, তখন আসলে কারা জয়ী হয়?
কাশ্মীর আজ কেবল একটি ভৌগোলিক সংকট নয় এক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। একদিকে রাষ্ট্রযন্ত্রের ট্যাংক, অন্যদিকে জনগণের বঞ্চিত চিৎকার। আমরা লক্ষ্য করছি, ভারত সরকার অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে সীমান্ত উত্তেজনাকে ব্যবহার করছে। যখন কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলো দমিয়ে ফেলা হয়, যখন শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, তখন জনগণের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ‘বাহ্যিক শত্রু’র দিকে। পাকিস্তানও একই কৌশল নেয়, যখন অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় মৌলবাদ কিংবা অর্থনৈতিক বিপর্যয় চাপ বাড়ায়।
কিন্তু এই দুই রাষ্ট্রের আপাত বিরোধের মাঝেই রয়েছে গভীর এক সংযোগ, উভয়েই সাম্রাজ্যবাদের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে। আমেরিকার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক’ কৌশলের প্রধান মিত্র ভারত, আর পাকিস্তান চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ পরিকল্পনায় যুক্ত। অর্থাৎ উভয়ই একটি সাম্রাজ্যবাদী জোটের মঞ্চে খেলছে, জনগণের দুঃখকে পণ্যে পরিণত করে। আজকের বিশে^ যুদ্ধ আর রাজনীতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যুদ্ধ এখন রাজনীতির ব্যাকরণ, সেখানে অস্ত্র হলো ব্যাকরণবিধি, আর কূটনীতি তার ছদ্ম-সমালোচক। ভারতের জাতীয়তাবাদ ও পাকিস্তানের ধর্মীয় জুজু, উভয়ই মূলত জনমত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার।
সাম্রাজ্যবাদের ছায়া : অর্থনীতি ও কূটনীতিযখন দুটি উন্নয়নশীল দেশ যুদ্ধ করে, তখন বিশ^ অস্ত্রবাজার নাচে, কূটনীতি নিজের লেজ চাটে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন-মিত্রপুঞ্জ হাসে। চীন প্রাচীন মিত্র পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়। শুধু আবেগ নয়, এটা কৌশল। ভারত যদি কাশ্মীর সীমান্তে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তিব্বত-মালাক্কা চ্যানেল-আন্দামান নিয়ে চীন নিশ্চিন্তে এগোতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যার একদিকে পাকিস্তান ছিল স্নায়ুযুদ্ধের মিত্র, অন্যদিকে এখন ভারত ইন্দো-প্যাসিফিকে তার কৌশলগত কেন্দ্রবিন্দু, তারা ‘দুই পক্ষের শান্তি চায়’, অথচ এফ-১৬ আর এস-৪০০-কে একসঙ্গে বাজারে রাখে।
ফিলিস্তিন : রক্তের নদী ও নীরব বিশ্ব২০২৫ সালে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, এই আগ্রাসন গণহত্যার দিকে এগোচ্ছে। ইসরায়েলের পরিকল্পনা গাজাকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা, যাতে ফিলিস্তিনিরা বাধ্য হয়ে স্থানান্তরিত হয়। এই আগ্রাসনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন স্পষ্ট।
বাংলাদেশ : অদৃশ্য ক্ষয়ের উপাখ্যান : বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র রাষ্ট্র, যার একদিকে ভারত, অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর, যেখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে।
সুতরাং ভারত-পাকিস্তান সংঘাত কেবল ‘দুই দেশের বিষয়’ নয়। এর পরোক্ষ অভিঘাত গভীরভাবে বাংলাদেশকে ছুঁয়ে যায়। অর্থনৈতিক অভিঘাত : যুদ্ধ মানে জ্বালানির দাম বাড়া, পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা। ইউক্রেন যুদ্ধ যেমন বাংলাদেশের পাটনির্ভর বাজারে ধাক্কা দিয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সংঘাতেও রপ্তানি-নির্ভর খাত, বিশেষ করে গার্মেন্টস ও ওষুধশিল্প প্রভাবিত হবে। সামাজিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি : যুদ্ধ মানে চরমপন্থার উত্থান, বিভাজনের রাজনীতি, উদ্বাস্তু প্রবাহ ও সন্ত্রাসবাদের জৈবিক উষ্ণতা। কাশ্মীরের যেকোনো অস্থিরতা বাংলাদেশে মৌলবাদী তৎপরতার অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়, ইতিহাস বলেছে তেমনই।
কৌশলগত কোণঠাসা : ভারত যদি দীর্ঘ মেয়াদে পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সামরিক ঘাঁটি ও নজরদারি বাড়ায়, তাহলে তার ছায়া বাংলাদেশে পড়বেই। সচেতনতা, সংহতি ও স্বাধীনতা : বাংলাদেশ যদি কেবল ‘কোনো পক্ষ না নেওয়া’ নীতিতে চলে, তাহলে সে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঞ্চলে গুটি হয়ে থাকবে। সময় এসেছে এক নতুন ‘আধা-অবস্থানীয় কূটনীতি’ চালুর যেখানে আমরা শুধু প্রতিবেশী নই, আমরা পথনির্দেশক হতে পারি।
নতুন কৌশলগত অক্ষ গঠন : বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা এই দেশগুলোর একটি স্বতন্ত্র জোট প্রয়োজন, যারা ‘উন্নয়ন-ভিত্তিক নিরপেক্ষতা’ চালাতে পারে।
আমাদের রাজনীতি : জনগণের একটি অংশ হিন্দুত্ববাদী মোদির পায়ের কাছে ‘বন্ধুত্ব’ রাখে, আরেক অংশ ইসলামাবাদের পেছনে ‘ভ্রাতৃত্ব’ খোঁজে। তাদের কারও নজর পড়ে না এ দেশের কৃষক, শ্রমিক কিংবা সেই বস্তির মেয়েটির দিকে যে প্রতিরাতে গুমের আতঙ্কে ঘুমায়। তাদের রাজনীতি যুদ্ধ চায়। কারণ যুদ্ধ মানে তাৎক্ষণিক জাতীয়তাবাদ। যুদ্ধ মানে ভিন্ন মতকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে দমন করা যায়। যুদ্ধ মানে দুর্নীতি চাপা দেওয়া যায় ‘অসাধারণ পরিস্থিতি’র দোহাই দিয়ে। আর সবচেয়ে বড় কথা, যুদ্ধ মানে, ক্ষমতা আরও কিছু বছর লম্বা করা।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ চায় না। মানুষ চায় নিরাপদ জীবন, বাসযোগ্য শহর, গণতান্ত্রিক আবহ। দুঃখজনক হলো, আমাদের জনগণ আজ ক্লান্ত। একদিকে পুঁজিবাদী মুনাফার চাতুরী, অন্যদিকে ধর্মীয় মৌলবাদের সংকীর্ণতা এই দুই চাকার গাড়িতে চাপিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক অজানা পথে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস উল্টো কথা বলে। আমরা ১৯৭১-এ যুদ্ধ করেছি, কিন্তু সেটা অন্য কারও হয়ে নয়, নিজের স্বাধীনতার জন্য। আমরা জেনেছি, একবার উপনিবেশ ভেঙে ফেললেই হয় না, তার ছায়া আরও দীর্ঘ হয়। সেই ছায়া আজও গণমাধ্যম, শিক্ষানীতি, এমনকি আমাদের ভোটের ব্যালটেও প্রবেশ করেছে।
এই রাজনীতি আসলে কাদের জন্য? না ভারতের, না পাকিস্তানের জন্য এই রাজনীতি তাদের জন্য, যারা চায় বাংলাদেশকে শিশু করে রাখতে। একটি দেশ, যাকে কখনই ম্যাচিউর করা যাবে না, যার কাছে সত্যিকারের পররাষ্ট্রনীতি থাকবে না, থাকবে শুধু পররাষ্ট্র-নাটক। আমরা যুদ্ধ চাই না। কোনো সাম্রাজ্যের সৈনিক হতে রাজি না। আমরা চাই স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, চাই নিজস্ব কূটনৈতিক চিন্তা, চাই আমাদের কণ্ঠস্বর যেন লন্ডন বা দিল্লির স্ক্রিপ্টে না বাঁধা পড়ে। আমরা চাই, বাংলাদেশের মাটির গন্ধে মোড়া শান্তির কণ্ঠস্বর। শান্তি আসে না হাতজোড় করে বললে। শান্তি আসে স্পষ্ট উচ্চারণে।
যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু তার ভয় শেষ হয় না। যুদ্ধের স্লোগান যারা তোলে, তারা আসলে শান্তিকে ভয় পায়। তারা চায় একটানা উত্তেজনা। তারা চায় এমন এক বাতাবরণ, যেখানে জনগণের বাস্তব দাবি হারিয়ে যাবে পতাকার নিচে। কিন্তু সেই পুরনো খেলা এবার থামাতে হবে। আমরা রাজনীতি চাই, কিন্তু তা হবে মানুষের জন্য। আমরা কূটনীতি চাই, কিন্তু সেটা হবে আত্মসম্মান রক্ষার জন্য। আমরা গণমাধ্যম চাই, কিন্তু সেটা হবে সত্য বলার জন্য। তাই আজকের স্লোগান, আজকের জোরালো কথাটি হোক : ‘তোমরা যুদ্ধ কর, আমরা করব না। তোমরা সাম্রাজ্যের মুখপাত্র হও, আমরা হব মানুষের প্রতিনিধি।
তোমরা ইতিহাসে কেবল রক্তচিহ্ন রাখ, আমরা রাখব ভাষা, গান আর প্রতিবাদ।’ যুদ্ধের এই আগুন জমি পোড়াবে, আমাদের ভবিষ্যৎ পুড়িয়ে দেবে। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। যখন সাম্যাজ্য প্রবল হয়, তখনই ছায়া ঘন হয়। কিন্তু সেই ছায়ার মধ্যেই জেগে ওঠে, প্রতিরোধের আলো। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আমরা সেই প্রতিরোধের সূচনা দেখতে চাই, যা সীমানা পেরিয়ে মানবিকতার আলো জ্বালাবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক