কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন, নাকি অর্থনৈতিক উপনিবেশায়ন?

আনু মুহাম্মদ [সূত্র : নয়া দিগন্ত, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫]

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন, নাকি অর্থনৈতিক উপনিবেশায়ন?

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের চরিত্র দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নের মুখে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেই গোপনীয়তা, তড়িঘড়ি আর অস্বচ্ছ শর্ত আরোপ যেন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। এখন সেই পুরনো প্রবণতার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ঘিরে সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ। আশ্চর্যজনকভাবে, যখন সরকার নিজেই বলছে তারা অস্থায়ী, কয়েক মাসের বেশি থাকবে না, তখনই তারা দেশের সবচেয়ে কৌশলগত স্থাপনার ওপর বহু দশকের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সই করেছে এবং আরও করতে যাচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে- এ এমন কোন দায় বা তাগিদ যে একটি অস্থায়ী সরকারও দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত প্রণেতা হয়ে উঠতে চায়? এই সময়েই কেন? তাড়াহুড়াই বা কিসের?

 

 

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। দেশের মোট আউটবাউন্ড ও ইনবাউন্ড বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে এই তা প্রায় ৯৮ শতাংশ। একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ক্ষমতা আজকের বিশ্বে অনেকটাই নির্ভর করে তার বন্দর ব্যবস্থাপনার ওপর, বিশেষত তা যখন প্রধান বা প্রায় একমাত্র বন্দর হয়। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর কোনো সাধারণ বাণিজ্যিক স্থাপনা নয়- এটি জাতীয় নিরাপত্তা, কৌশলগত ভূরাজনীতি এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কেন্দ্রবিন্দু। এমন অবস্থায় এই বন্দরকেই বিদেশি অপারেটরের হাতে তুলে দেওয়ার যে অপচেষ্টা চলছে, সেটি নিছক উন্নয়ন বা বাণিজ্যগত সিদ্ধান্ত নয়- এটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্ন।

 

 

১৭ নভেম্বর, একটি অস্বাভাবিক দিনে, সরকার চট্টগ্রামের লালদিয়া এলাকায় নতুন কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও ৩০ বছরের জন্য পরিচালনার চুক্তি করে ডেনমার্কভিত্তিক APM Terminals নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এ ছাড়া বন্দরের সবচেয়ে কর্মচঞ্চল ও লাভজনক কৌশলগত স্থাপনা, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (NCT), বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে চলছে।

 

 

এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কিন্তু জনগণ জানে না চুক্তির শর্ত কী, বাংলাদেশের লাভ কী, দায় কী, কোন আইন অনুসরণ করে চুক্তি হচ্ছে, কাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে এবং দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, রাজস্ব, শ্রমবাজার বা নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব কী হবে? সমাজে কোনো আলোচনা তোলা হয়নি, বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কোনো উন্মুক্ত শুনানি নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতামত নেওয়া হয়নি, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকেও অন্ধকারে রাখা হয়েছে। সাধারণভাবে বললে- যে জনগণের নামে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, তাদের কাছ থেকেই রাষ্ট্র সব তথ্য গোপন রাখতে যেন বদ্ধপরিকর।

 

 

রাষ্ট্রের এই গোপনীয়তা উদ্বেগজনক, বিপদের পূর্বাভাস। কারণ অতীতে আমরা দেখেছি- রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, আদানি চুক্তি, মাতারবাড়ী প্রকল্প, পায়রা বন্দর- এগুলোই ‘বিদেশি বিনিয়োগ বা উন্নয়ন’ শব্দে মোড়া ছিল। কিন্তু প্রকৃত পরিণতিতে এসব প্রকল্প অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি, অতিরিক্ত ব্যয়, পরিবেশ বিপর্যয় ও জাতীয় অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রকল্পে বিদেশি কোম্পানির লাভ হয়েছে, কমিশনভোগী-মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভ হয়েছে, কিন্তু জনগণ পেয়েছে ঋণের বোঝা, ব্যয়ের ভার, পরিবেশ-ঝুঁকি এবং দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরতা।

 

 

এবারের পরিস্থিতি আরও গভীর। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো দেশের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেত্র অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে বিদেশিদের হাতে গেলে তারা শুধু টার্মিনাল পরিচালনা করবে না; অর্থনীতির মূল স্নায়ুব্যবস্থাটির ওপর তাদের পূর্ণ নজরদারি তৈরি হবে। একটি দেশের শক্তি শুধু তার সেনাবাহিনী বা ভূখণ্ড দিয়ে নয়- তার বাণিজ্যিক প্রবাহ দিয়ে পরিমাপ করা হয়। আর সেটি যদি অজানা চুক্তিতে অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে যায়- তাহলে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বও ঝুঁকিতে পড়ে।

 

 

সরকার যেটি বলছে- এগুলো ‘কনসেশন’, মালিকানা থাকবে বাংলাদেশের- এ যুক্তি প্রতারণামূলক। মালিকানা কাগজে থাকলেই তা বাস্তবে থাকে না; নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনক্ষমতাই প্রকৃত মালিকানা। তাই ৩০/৪০ বছরের জন্য নিয়ন্ত্রণক্ষমতা হস্তান্তর মানে ওই স্থাপনাটির ওপর জাতীয় নিয়ন্ত্রণ হারানো। বিশ্বের কোনো দায়িত্বশীল দেশ তার প্রধান বন্দরকে এভাবে বিদেশিদের হাতে তুলে দেয় না। সিঙ্গাপুরের পিএসএ, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস- এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিজেদের সক্ষমতার বিকাশ ঘটিয়ে আজ বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হয়েছে। আর আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব সময়ই কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। তাদের সক্ষমতা বাড়াতে রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয়নি; বরং কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে নিজেদের অক্ষমতার সংস্কৃতিকে স্থায়ী করে তোলা হয়েছে।

 

 

এটা খুবই বিস্ময়কর যে, যে সরকারের আয়ু কয় মাস, তারা কাউকে না জানিয়ে বহু দশকের চুক্তির দায় নিয়েছে। যে সরকারের উপদেষ্টা, আমলা, নীতিনির্ধারকরা আন্তর্জাতিক চাপ, দেশীয় ব্যবসায়িক লবিং এবং রাজনৈতিক দালালচক্রের কাছে দায়বদ্ধ, দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহির বাইরে- তারা দেশের কর্তৃত্ব বণ্টনের দায়িত্ব নিচ্ছে। এতে বোঝা যায়, এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রকে ঘিরে থাকা জটিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আগ্রাসী পরিকল্পনার। আর সবচেয়ে বড় বিষয়- এই চুক্তিগুলোর যাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে, সেই জনগণকেই আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছে।

 

 

প্রধান বন্দরের ওপর গোপন চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি নিয়ন্ত্রণ শুধু অর্থনীতি নয়, নিরাপত্তাঝুঁকিও বাড়ায়। বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি এখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র-জাপান- প্রত্যেকেরই এই অঞ্চলে নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর বিদেশি নিয়ন্ত্রণ মানে এই দেশগুলোর প্রতিযোগিতার অংশ হয়ে পড়া। এটি কেবল বাণিজ্য বা শুল্কের প্রশ্ন নয়; এটি সামরিক, গোয়েন্দা এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার প্রশ্নও। বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক রাষ্ট্র এসব স্ট্র্যাটেজিক খেলায় অবুঝভাবে জড়ালে তার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হওয়ার পথই খুলে যায়।

 

 

এ অবস্থায় জনগণই শেষ ভরসা। সরকার কিংবা প্রশাসন যখন জবাবদিহির বাইরে চলে যায়, তখন দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষায় জনগণের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে এখন যে প্রতিরোধ, যে প্রশ্ন, যে উদ্বেগ বাড়ছে- এটি স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। কারণ এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি বন্দরের আধুনিকায়ন নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি, শ্রম, নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।

 

 

রাষ্ট্র কোনো বিদেশি কোম্পানি বা তার দালালচক্রের সম্পত্তি নয়; রাষ্ট্র জনগণের। তাই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণের কাছ থেকে তথ্য লুকানোর অধিকার কোনো সরকারের নেই- অস্থায়ী বা স্থায়ী, কেউই নয়। সরকার নয়, রাজনৈতিক দল নয়- একটি ভুল চুক্তির পরিণতি বহন করে দেশ ও জনগণ।

 

 

তাই প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জনপরামর্শ, নীতিগত জবাবদিহি এবং এই চুক্তিগুলোর পূর্ণ প্রকাশ। উন্নয়ন মানে গোপনে চুক্তি করে বিদেশিকে জায়গা ছেড়ে দেওয়া নয়; উন্নয়ন মানে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো, নিজের মানুষের দক্ষতা বাড়ানো, নিজের সম্পদের ওপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। এই পথ ভুল হলে তার মূল্য অনেক প্রজন্মকে দিতে হবে। তাই চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বর্তমান সরকারের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুধু অধিকার নয়- এটি এ দেশের নাগরিকদের দায়িত্ব।

 

 

আনু মুহাম্মদ : অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা