কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল পাওয়ার সক্ষমতা ও কৌশল

এম এম শহিদুল হাসান। প্রকাশ: সমকাল, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল পাওয়ার সক্ষমতা ও কৌশল

বিশ্ব বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। এটি এমন একটি সময়, যেখানে ডিজিটাল, ফিজিক্যাল এবং জৈবিক ব্যবস্থার সমন্বয়ে প্রযুক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বাংলাদেশের মতো দেশ যারা শিল্প, বাণিজ্য, পরিষেবা ও প্রশাসনে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে আছে, তারা কি এই প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে পারবে– এটাই এখন বড় প্রশ্ন।

সমাধানের জন্য জাতির সক্ষমতা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদা মেনে নীতিমালা প্রণয়নের মানসিকতা প্রয়োজন। পাশাপাশি দেশের ইতিহাস, সম্পদ ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের সঠিক ব্যবহারে জোর দিতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এবং জৈবপ্রযুক্তি– সফলভাবে কাজে লাগিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও উদ্ভাবন বাড়ানো সম্ভব। পরম্পরাগত অর্থনৈতিক পদ্ধতিগুলো একটি দেশের জন্য স্থিতিশীল ভিত্তি তৈরি করলেও সেগুলোকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে পুনর্গঠন করা বা প্রয়োজনে প্রতিস্থাপন করা অপরিহার্য। অভিযোজনশীল, উদ্ভাবননির্ভর এবং টেকসই অর্থনৈতিক মডেল এখন আর কেবল বিকল্প নয়; বরং এটি অপরিহার্য শর্ত। এটি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখার পথ দেখাতে পারে। 
বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি তার নিজস্ব প্রেক্ষাপট অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিচক্ষণ ও সঠিকভাবে পরিকল্পিত অবস্থানই দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথ উন্মোচন করতে পারে। এশিয়ার অনেক দেশ ইতোমধ্যে দেখিয়েছে, কীভাবে অভিযোজনশীল নীতিমালা গ্রহণের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশের জন্য উদ্ভাবনী ও সহনশীল অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে।


সিঙ্গাপুর একটি ক্ষুদ্র দেশ, যেখানে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তানা মানবসম্পদ উন্নয়ন ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রযুক্তি ও অর্থনীতির বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকার লক্ষ্যে তারা ‘স্মার্ট নেশন’ প্রোগ্রামের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা ডিজিটাল রূপান্তর ও সাইবার নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। পাশাপাশি গবেষণা ও উন্নয়ন এবং আজীবন শিক্ষায় ব্যাপক বিনিয়োগ করে সিঙ্গাপুর বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক থাকতে সক্ষম হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী শিল্পায়নের প্রভাব, জাপানি ঔপনিবেশিক শাসন এবং মার্কিন সহায়তায় প্রভাবিত হয়ে তাইওয়ান উৎপাদন ও ইলেকট্রনিক্স খাতে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছে। সেমিকন্ডাক্টর এবং ইলেকট্রনিক্সে বৈশ্বিক নেতৃত্বের সুবিধা নিয়ে তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চালিত করতে এআই, আইওটি এবং উন্নত উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করছে। ফরওয়ার্ড লুকিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মতো নীতিমালা প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের উন্নয়নে কেন্দ্রীভূত।

চীন তার বিশাল মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সুযোগকে সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছে। একটি দক্ষ কর্মশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশটি শিক্ষায় ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে। মেড ইন চায়না ২০২৫ নীতিমালার প্রধান উদ্দেশ্য হলো শিল্প খাতকে অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তির সহায়তায় আধুনিকায়ন করা। প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতি চীনের মনোযোগ তার দীর্ঘমেয়াদি ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

রাবার ও পাম অয়েলের মতো পণ্য রপ্তানির ওপর ঐতিহাসিকভাবে নির্ভরশীল মালয়েশিয়া উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে বৈচিত্র্য এনেছে। প্রযুক্তিনির্ভর খাতে প্রতিযোগিতার জন্য দেশটি তার মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগ দিচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রি ডব্লিউআরডি নীতিমালা মালয়েশিয়াকে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত, যা উৎপাদন খাতে ডিজিটালাইজেশন এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করছে।

ভারতের বিশাল ও তরুণ জনশক্তি এবং সমৃদ্ধ আইটি খাতই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কৌশলগত ভিত্তি। ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ ও ‘স্কিল ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রাম, স্টার্টআপ উদ্যোগ এবং উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদন নীতিমালার মাধ্যমে দেশটি দ্রুত প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এশিয়ার এ দেশগুলো দেখিয়েছে, কৌশলগত পরিকল্পনা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কীভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগানো যায়।
বাংলাদেশের প্রাচুর্যপূর্ণ মানবসম্পদ, সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, প্রচলিত শিল্প খাত এবং অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ শ্রমশক্তির প্রেক্ষাপটে একটি সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। দেশের সম্পদ এবং সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দেশের জনমিতিক লভ্যাংশের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে বড় পরিসরে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস এবং সবুজ প্রযুক্তির মতো উদীয়মান খাতে শ্রমশক্তিকে দক্ষ ও পুনর্দক্ষ করার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। স্বল্প দক্ষতানির্ভর শ্রমশক্তি শিল্পগুলোকে ধীরে ধীরে অটোমেশনের আওতায় আনা উচিত এবং এর সঙ্গে সঙ্গে কর্মীদের পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। 

প্রচলিত শিল্প খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা বাংলাদেশের দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিল্প খাতের বৈচিত্র্য আনয়ন, স্টার্টআপ এবং ক্ষুদ্র ও এসএমইর প্রসার এবং এআই, আইওটি ও সবুজ প্রযুক্তির মতো উন্নত খাতে দক্ষতা গড়ে তুলতে স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগের প্রয়োজন। উদ্ভাবনী নীতিমালার মাধ্যমে টেকসই কৃষি, দুর্যোগ সহনশীলতা এবং নগরায়ণের মতো স্থানীয় চ্যালেঞ্জ সমাধানে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা উচিত। এ ছাড়া জনসেবার খাতে যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং পরিবহন ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্তর্ভুক্তি কার্যকারিতা এবং প্রাপ্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে।

দেশের বিশাল জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবনকে ত্বরান্বিত করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা অর্জনের জন্য একটি দক্ষ কর্মশক্তি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তরমূলক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শিক্ষার পুনর্বিন্যাস, যা প্রযুক্তি ও শিল্পগত অগ্রগতির আলোকে ভবিষ্যতের কর্মশক্তিকে কার্যকরভাবে প্রস্তুত করবে। তবে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা খণ্ডিত, যা সামাজিক বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টি করছে এবং মূলধারার পেশায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঠামোগত পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হলেও, উচ্চশিক্ষা খাতে তাৎক্ষণিক সংস্কারের সুযোগ রয়েছে। তবে নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষাবিদরা এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অনেকটাই উপেক্ষা করে চলেছেন।

চতুর্থ শিল্পব বিপ্লব এমন কিছু অভিযোজনযোগ্য দক্ষতার চাহিদা তৈরি করে, যা ডিজিটাল সাক্ষরতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সৃজনশীলতা, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা এবং সহযোগিতার মতো মানসিক ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশে গুরুত্ব দেয়। এই দক্ষতাগুলো মস্তিষ্ক ও শরীরের কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আন্তঃবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি এসব চাহিদার সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি দেকার্তের যুক্তিবাদ এবং উদ্ভাবনী প্রয়োগের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করে, যা গ্র্যাজুয়েটদের গতিশীল ও অপ্রচলিত (নন-লিনিয়ার) কর্মজীবনের জন্য সুনিপুণভাবে প্রস্তুত করে।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ হারানোর ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশকে দ্রুত শিল্পের বহুমুখীকরণ, অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ শ্রমশক্তির উন্নত দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম। 

এম এম শহিদুল হাসান: প্রাক্তন উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়