দ. এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন মেরু
[সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫]

কয়েক দশক ধরেই দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি ভারতকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তবে সম্প্রতি এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের কয়েক দশকের বৈরিতা এখন চরমে। গত মে মাসে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ চার দিনের বিমান যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, যা তাদের সম্পর্ককে আরও তলানিতে নিয়ে গেছে। আবার গত বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির সম্পর্কও মারাত্মক অবনতি হয়েছে। পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে নয়াদিল্লি।
অন্যদিকে, ভারতকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র যে নীতিতে এশিয়ার আরেক পরাশক্তি চীনকে মোকাবিলা করত সেই প্রচেষ্টাতেও ছেদ পড়েছে অনেকটাই; কেননা ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সেই দহরম মহরম এখন অতীত বলেই মনে হচ্ছে। আর এমন প্রেক্ষাপট চীনের জন্য বড় সুযোগ হয়ে আসতে পারে। সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার এই টালমাটাল অবস্থার কারণে বিকল্প জোটে চোখ দিয়েছে পাকিস্তান। সম্প্রতি দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ, চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগটি কেবল এই তিন দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং এতে অন্যান্য আঞ্চলিক দেশ এবং এর বাইরের রাষ্ট্রগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।
গত বুধবার ‘ইসলামাবাদ কনক্লেভ’ ফোরামে তিনি বলেন, আমরা জিরো-সাম (এক পক্ষের লাভ মানে অন্য পক্ষের ক্ষতি) ধারণার বিরোধিতা করি এবং সংঘাতের পরিবর্তে সবসময় পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে, এই প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে দক্ষিণ এশিয়াকেন্দ্রিক একটি বিকল্প জোট গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে চীনকে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার তীব্র উত্তেজনার কারণে এই অঞ্চলের প্রধান জোট ‘সার্ক’ (সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন) কার্যত অকেজো হয়ে পড়েছে। গত জুন মাসে চীন, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কূটনীতিকরা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনজীবনের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন। সে সময় তারা উল্লেখ করেছিলেন যে, এই সহযোগিতা কোনো তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত নয়।
প্রশ্ন উঠছে, দক্ষিণ এশিয়ার সার্কের অন্য সদস্য দেশগুলো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান এবং আফগানিস্তান কি এমন কোনো নতুন জোটে যোগ দিতে সম্মত হবে, যার মূল লক্ষ্য ভারতকে বাদ দেওয়া বা অন্তত এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব খর্ব করা?
পাকিস্তানের প্রস্তাবটি কী : ইসহাক দার বলেছেন, বাংলাদেশ ও চীনের সঙ্গে তাদের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের লক্ষ্য হলো অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে ‘পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা’। তার ভাষ্য, অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রযুক্তি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলোতে পরিবর্তনশীল কাঠামোর ভিত্তিতে বিভিন্ন গ্রুপ বা জোট হয়ে ওঠা। পরোক্ষভাবে ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব জাতীয় উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকারগুলো কারও একগুয়েমি বা অনড় অবস্থানের কাছে জিম্মি থাকতে পারে না এবং আপনারা জানেন, আমি কাদের কথা বলছি। ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যকার উত্তেজনার বিষয়ে দার উল্লেখ করেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ‘কাঠামোগত সংলাপ’ প্রক্রিয়াটি গত ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। অন্য আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোরও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চড়াই-উতরাইয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার দেশ এমন এক দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে যেখানে ‘বিভেদের জায়গা নেবে সংযোগ ও সহযোগিতা, অর্থনীতিগুলো সমন্বিতভাবে বিকশিত হবে, আন্তর্জাতিক বৈধতা অনুযায়ী শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি হবে এবং যেখানে মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে শান্তি বজায় থাকবে। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ (সিএসএসপিআর)-এর পরিচালক রাবিয়া আখতার আলজাজিরাকে বলেন, এই পর্যায়ে প্রস্তাবটি বাস্তবায়নযোগ্য হওয়ার চেয়ে বেশি আকাক্সক্ষা-নির্ভর বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, তবে এটি সার্ক-এর স্থবিরতার সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে নতুন করে সাজানোর এবং বৈচিত্র্য আনার বিষয়ে পাকিস্তানের সদিচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।
সার্ক কী ও কেন প্রয়োজন : ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এক শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সাতটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ ছিল বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা। ২০০৭ সালে অষ্টম সদস্য হিসেবে আফগানিস্তান এতে যোগ দেয়। সংস্থাটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, সার্কের উদ্দেশ্য হলো দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ। উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও, গত ৪০ বছরে সংস্থাটি তার উদ্দেশ্য পূরণে হিমশিম খেয়েছে। ২০১৪ সালের পর সংস্থাটির কোনো সম্মেলন হয়নি। বিশ্লেষক রাবিয়া আখতার বলেন, এই সংস্থাটি কার্যকর হওয়ার জন্য ঐকমত্য প্রয়োজন। দ্বিপক্ষীয় বিরোধকে আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে আলাদা করার জন্য দুই বৃহত্তম সদস্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সার্ক এগিয়ে যেতে পারে না। তবে বিশ্লেষকরা এও বলছেন, সার্ক বর্তমানে সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও, ভারত ও পাকিস্তান সুযোগ দিলে এই সংস্থাটির এখনো অঞ্চলের জন্য কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২৫ সাল নাগাদ সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা ২০০ কোটির বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বিশাল জনসংখ্যা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য খুবই নগণ্য, যা অঞ্চলের মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ (প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার)। এর বিপরীতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের জোট ‘আসিয়ান’-এর (জনসংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ তাদের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ২৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাণিজ্য বাধাগুলো দূর করা গেলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য লেনদেন করতে পারে, যা বর্তমানের তিনগুণ।
আঞ্চলিক সংযোগের অভাবকে এই দুর্বল বাণিজ্যের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ইউরোপের মতো গাড়ি ও ট্রাক চলাচলের জন্য ‘মোটর ভেহিকল অ্যাগ্রিমেন্ট’ সই করার দ্বারপ্রান্তে ছিল সার্ক। কিন্তু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার জেরে পাকিস্তান সেই চুক্তি এবং রেলওয়ে সহযোগিতার আরেকটি চুক্তি আটকে দেয়। আঞ্চলিক অংশীদারত্ব গড়তে সার্ককে পাশ কাটানোর চেষ্টা পাকিস্তানই প্রথম করছে না। সার্কের আঞ্চলিক পরিবহন চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল মিলে নিজেদের মধ্যে ‘বিবিআইএন’ নামে অনুরূপ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউট (এএসপিআই)-এর সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভসের পরিচালক এবং বিশ্লেষক ফারওয়ার মতে, ভারত বিমসটেকের মতো অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থারও অংশ। বিমসটেকে ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত।
পাকিস্তানের প্রস্তাব কি সফল হবে : বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, উচ্চাভিলাষী হলেও এই প্রস্তাবটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দক্ষিণ এশিয়া বারবার বাস্তবসম্মত আঞ্চলিকতাবাদ বা তথাকথিত ‘মিনিলেটারালিজম’ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে, যা মূলত নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা বা সম্ভবত রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার ফাঁদে আটকে আছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীণ ডনথি আলজাজিরাকে বলেন, তাত্ত্বিকভাবে একটি নতুন আঞ্চলিক সংস্থার জন্য সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের শীতল সম্পর্কের কারণে সার্কের নিঃশব্দ মৃত্যু দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য একটি ফোরামের জন্য শূন্যস্থান তৈরি করেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছে। তবে রাবিয়া আখতারের মতে, প্রস্তাবটি বাস্তবে কাজ করবে কি না, তা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত. প্রথাগত কাঠামো যখন স্থবির, তখন সম্ভাব্য রাষ্ট্রগুলো ছোট এবং নির্দিষ্ট ইস্যুভিত্তিক জোটের মধ্যে কার্যকর কোনো মূল্য দেখছে কি না; এবং দ্বিতীয়ত. এতে অংশগ্রহণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক মূল্য দিতে বাধ্য করবে কি না।