কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দারিদ্র্য বৃদ্ধির পূর্বাভাস ও আমাদের করণীয়

ড. মতিউর রহমান। সূত্র : শেয়ার বিজ, ০৪ মে ২০২৫

দারিদ্র্য বৃদ্ধির পূর্বাভাস ও আমাদের করণীয়

 বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনটি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি কঠিন সতর্কবার্তা বহন করে এনেছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আরও প্রায় ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে নিপতিত হবে। এটি কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি লাখো মানুষের জীবনে নেমে আসা অন্ধকারের পূর্বাভাস, যা বিগত কয়েক দশকে দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছানোর এই আশঙ্কা দেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।

 

 

চরম দারিদ্র্য বলতে বোঝায় দৈনিক মাত্র ২ দশমিক ১৫ ডলার বা তারও কম আয়ে জীবনধারণ করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে জাতীয় দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে মাসিক ন্যূনতম ৩ হাজার ৮২২ টাকা ব্যয়ের ভিত্তিতে, সেখানে এই পূর্বাভাস একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমান অর্থনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দেশে চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৫৮ লাখে। এর সঙ্গে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মোট মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখে। এই বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা চরম অনিশ্চয়তায় পড়ার ঝুঁকি দেশের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

 

 

এই সংকট হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি; এর পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি জটিল এবং পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কারণ। এর মধ্যে সবচেয়ে সরাসরি এবং বিধ্বংসী কারণটি হলো জনগণের প্রকৃত আয়ের ধারাবাহিক পতন। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ বিদ্যমান। প্রায়শই এটি ১০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে মজুরি বৃদ্ধির হার এই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এই প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে যেখানে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, সেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর অর্থ হলো, মানুষ যে মজুরি পাচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম তার চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যা তাদের জীবনযাত্রার মানকে নিম্নমুখী করছে।

 

 

এই লাগাতার মূল্যস্ফীতি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য একটি ‘অদৃশ্য কর’-এর মতো কাজ করছে। এটি তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার সামর্থ্যকে প্রতিনিয়ত ক্ষয় করে চলেছে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা- এই অপরিহার্য প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য তাদের সংগ্রাম কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। যারা দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে অবস্থান করছিলেন, তাদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সামান্য মূল্যবৃদ্ধিও বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা বাধ্য হচ্ছেন খাবারের পরিমাণ কমাতে, পুষ্টিকর খাদ্য কেনা বাদ দিতে, সন্তানদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে অথবা উচ্চ সুদের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়তে। যখন মানুষের হাতে থাকা টাকার মূল্য কমে যায় এবং তারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হিমশিম খায়, তখন তাদের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে এবং পুরো পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব শুধু শহর নয়, গ্রামের মানুষের জীবনেও পড়ছে, বিশেষ করে যারা নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

 


কেবল মূল্যস্ফীতিই নয়, দুর্বল শ্রমবাজারও দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং নীতিগত চ্যালেঞ্জসহ একাধিক কারণ দায়ী। দেশের অর্থনীতির মূল সূচকগুলো, যেমনÑ রাজস্ব আহরণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগÑ ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার বিশাল রাজস্ব ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ঘাটতি মানে হলো সরকারের হাতে উন্নয়নমূলক প্রকল্প এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যয়ের জন্য কম অর্থ থাকছে। এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি কমে যাচ্ছে বা অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

 

 

এডিপি বাস্তবায়ন গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। উন্নয়ন ব্যয়ে এই স্থবিরতা সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগকে সংকুচিত করছে। কারণ সরকারি বিনিয়োগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও স্থবির হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগ করতে বা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্যাংক ঋণপ্রবাহ কমে গেছে, নতুন ব্যবসা উদ্যোগ স্থাপন কঠিন হয়ে পড়েছে এবং বিদ্যমান অনেক ব্যবসা টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। এসব পরিস্থিতি সম্মিলিতভাবে শ্রমবাজারকে সংকুচিত করেছে, যা বিশেষ করে নিম্নআয়ের এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ওপর চরম আঘাত হেনেছে। দিনমজুর, ছোট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন অথবা তাদের আয় কমে যাচ্ছে। কাজের সুযোগ কমে যাওয়া এবং আয়ের অনিশ্চয়তা দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

 

 

অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আয়-উপার্জনের সুযোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি সমাজে বৈষম্য আরও গভীর হয়েছে। এই সংকট ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধানকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। যারা সমাজের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত স্তরে রয়েছেন, তারা তাদের সম্পদ, সঞ্চয় এবং বিকল্প আয়ের উৎস ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কিছুটা হলেও মোকাবিলা করতে পারছেন। কিন্তু যারা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি বাস করছেন অথবা দিন এনে দিন খাচ্ছেন, তাদের জন্য টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা একের পর এক দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে যাচ্ছেন। এই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক সমস্যাই নয়, এটি সমাজে অস্থিরতা ও বিভেদ বাড়ায় এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও সামাজিক সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যখন সমাজের একটি বৃহৎ অংশ অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

 

 

এই দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রভাব কেবল তাৎক্ষণিক নয়, বরং এর দীর্ঘমেয়াদি এবং প্রজš§গত ভয়াবহ পরিণতি রয়েছে। চরম দারিদ্র্যে বেড়ে ওঠা শিশুরা অপুষ্টি, স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং শিক্ষার অভাবে ভুগতে বাধ্য হয়। পুষ্টিহীনতার কারণে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিক্ষার সুযোগ না থাকায় তারা ভবিষ্যতে উন্নত জীবন ও ভালো চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে দারিদ্র্যের চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এক প্রজšে§র দারিদ্র্য পরবর্তী প্রজšে§ও সংক্রমিত হয়, যা একটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। একইসঙ্গে, ক্রমে সংকুচিত হওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি দেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি উদ্বেগের কারণ। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভোক্তা ব্যয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমা মানে সামগ্রিক চাহিদা কমে যাওয়া, যা অর্থনীতিকে আরও মন্দাগ্রস্ত করে তুলতে পারে। এছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা তৈরি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই শ্রেণির দুর্বল হয়ে পড়া সামগ্রিকভাবে দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার জন্য নেতিবাচক।

 

 

বাংলাদেশে দারিদ্র্য কেবল আয়ভিত্তিক সমস্যা নয়; এটি একটি বহুমাত্রিক এবং জটিল সামাজিক সমস্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য একটি বহুমাত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেখানে আয় ছাড়াও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, বাসস্থান, স্যানিটেশন, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি ও আর্থিক পরিষেবার মতো প্রায় ১১৯টি সূচক বিবেচনা করা হয়। এর অর্থ হলো, একজন ব্যক্তি যদি আয়-রোজগার করেও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে ভোগেন, নিরাপদ পানি না পান, মানসম্মত শিক্ষা না পান অথবা উপযুক্ত বাসস্থান না থাকে, তবে তিনি বহুলাংশে দরিদ্র বলে গণ্য হতে পারেন। দারিদ্র্য বোঝাতে কেবল টাকার অঙ্ক নয়, সুযোগ-সুবিধা এবং মানবাধিকারের বঞ্চনাকেও গভীরভাবে বিবেচনা করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসটি মূলত চরম আয়ভিত্তিক দারিদ্র্যের ওপর জোর দিয়েছে, কিন্তু এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বহুমাত্রিক দারিদ্র্যও একইভাবে উদ্বেগজনক।

 

 

এই কঠিন এবং গভীর সংকট মোকাবিলায় জরুরিভিত্তিতে সমন্বিত ও সাহসী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদৃঢ় আর্থিক নীতি গ্রহণ করতে হবে। বাজারে খাদ্য ও জ্বালানির সরবরাহ ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের কারসাজি রোধ করে বাজার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নিম্ন আয়ভুক্ত ও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বাড়ানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে পোশাক শিল্প এবং অন্যান্য বড় শ্রমঘন খাতে, একটি জরুরি পদক্ষেপ হতে পারে। একইসঙ্গে, বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলো (যেমন- বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিএফ প্রভৃতি) সম্প্রসারণ করতে হবে এবং সুবিধাভোগীর সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বর্তমান মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়াতে হবে। এই কর্মসূচিগুলো দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষের জন্য একটি জীবন রক্ষাকারী জাল হিসেবে কাজ করে। বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ প্রণোদনা এবং নীতি সহায়তা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।

 

 

শ্রমবাজারকে পুনরুদ্ধার করা এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য অপরিহার্য। এজন্য সবার আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি, যা দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দ্রুত এবং কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে যেসব প্রকল্প গ্রামীণ উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়ায়। এই খাতগুলোতে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরাসরি ভূমিকা রাখে এবং দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাহায্য করে। এই কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উৎস নিশ্চিত করতে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে। করের আওতা সম্প্রসারণ, কর ফাঁকি রোধ এবং পুরো কর ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ ও জনবান্ধব করা প্রয়োজন।

 

 

দীর্ঘমেয়াদে, বাংলাদেশকে একটি আরও টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধু পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর না করে অর্থনীতির বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি, হালকা প্রকৌশল এবং পর্যটন শিল্পের মতো নতুন খাতগুলোতে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে উৎসাহিত করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্প্র্রসারণ করা অর্থাৎ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক পরিষেবা সহজলভ্য করা তাদের সঞ্চয় ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়কে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে হবে, যাতে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশকে অর্থনৈতিক আঘাত থেকে রক্ষা করা যায়। বিশেষ করে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে, যাতে উন্নয়নের ধারায় ‘কেউই পেছনে পড়ে না থাকে’।

 

 

বিশ্বব্যাংকের এই সতর্কবার্তা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক, সুশীল সমাজ এবং সমগ্র জাতির জন্য এক কঠিন পরীক্ষার মুহূর্ত। গত কয়েক দশকে দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ যে সাফল্য অর্জন করেছে, সাহসী এবং কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া তা বিলীন হয়ে যাওয়ার চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। লাখ লাখ মানুষের চরম দারিদ্র্যে নিপতিত হওয়া কেবল একটি মানবিক সংকটই নয়, বরং এটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও এক গভীর হুমকি। এটি বাংলাদেশের নেতৃত্বকে প্রমাণ করার সময় যে তারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং জনগণের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ।

 

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বাংলাদেশ বহুবার দুর্যোগ, সংকট এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। আজকের এই দারিদ্র্য সংকটও হয়তো তেমনই একটি চ্যালেঞ্জ, যা অতীতের মতোই সাহস, দূরদৃষ্টি এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে মোকাবিলা করা সম্ভব। চ্যালেঞ্জ অনেক এবং পথ কঠিন, তবে সঠিক নীতি গ্রহণ, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই সংকটকেও বাংলাদেশের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই উন্নয়নের একটি নতুন সুযোগে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। এখনই সময় সমন্বিতভাবে কাজ করার, যাতে দারিদ্র্যের ভয়াল থাবা থেকে লাখো জীবনকে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়।

 

 

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী