দারিদ্র্য দূরীকরণ কৌশল প্রসঙ্গে
আব্দুল বায়েস। সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন সংক্রান্ত নীতিমালা ও কৌশল প্রসঙ্গ এলে বিখ্যাত সেই উক্তিটি মনে পড়ে, “যখন কোনো গরিবকে আমি খাদ্য দিই, তারা ভাবে আমি একজন ‘সাধু’। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করি গরিব কেন খেতে পায় না, তারা ভাবে আমি একজন কমিউনিস্ট।” স্বাধীনতার শুরু থেকে বেশ কিছুকাল দারিদ্র্য বিমোচনের কাজটি ছিল প্রধানত দান ও দয়া নির্ভর। এর দার্শনিক দৃষ্টিকোণ ছিল নৈতিক ও ধর্মীয়।
অতএব গরিবের সেবায় ‘সাধু’র ভূমিকায় নেমেছিল সরকার, এনজিও ও দাতাগোষ্ঠী এবং তাদের সঙ্গে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য ছিল খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্য। বেশ কিছুকাল গেল, গরিব কিন্তু দারিদ্র্যরেখার ওপরে উঠে আসতে পারল না। অচিরেই দারিদ্র্য বিমোচনের এই মিনস ও এন্ড-এর মধ্যকার অসংগতি ধরা পড়ে যায় এবং এ নিয়ে প্রচুর প্রশ্ন উঠতে থাকে। অনুধাবন করা গেল যে দান ও দয়া নির্ভর কর্মসূচির মাধ্যমে যত সহজে দরিদ্রের সাময়িক স্বস্তি মেলে, তত সহজে তার টেকসই অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটে না।
সুতরাং গরিব কেন খেতে পায় না—এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হলো। পরিশেষে বের হয়ে এলো টেকসই অস্তিত্বের জন্য (এবং বিশেষত দারিদ্র্যরেখার ওপরে উঠে আসার জন্য) গরিবের যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে সম্পদপ্রাপ্তি এবং সেই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে আয়বর্ধন। বোধ করি তখন থেকে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়, যার মর্মবাণী হচ্ছে ভিক্ষা ও ভক্ষণের হাতকে সৃষ্টির হাতিয়ারে রূপান্তর করা। সেই ধারণার সূত্র ধরে পরিবর্তন ঘটল ভিজিএফ থেকে ভিজিডি, ভক্ষক থেকে উৎপাদক এবং সাধু থেকে কমিউনিস্ট।
দুই.
এটি আজ আর কারো অজানা নয় যে দারিদ্র্যের ধারণা যেমন বহুমাত্রিক, দারিদ্র্য বিমোচনের কৌশলও তেমনি বহুধাবিস্তৃত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে কোনো ‘ম্যাজিক বুলেট’ নেই। অনেক উপাদানের অবদানে দারিদ্র্য বাড়ে বা কমে। যা হোক, দারিদ্র্য হ্রাস সংক্রান্ত নীতিমালা সুপারিশ করার আগে দু-একটি বিষয়ের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, শুধু দরিদ্রের স্বার্থে দারিদ্র্য নিরসন করতে হবে এমনতর নৈতিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বিষয়টির অর্থনৈতিক তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে।
জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির (এবং সেই সূত্রে সবার জীবনকুশলতা বৃদ্ধির) স্বার্থেই বিষয়টি দেখা জরুরি। এমন উপলব্ধির পেছনে অর্থনৈতিক তাৎপর্য হলো, ধরা যাক যে উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে না পেরে একজন গরিব না খেয়ে থাকে। কিন্তু এ কথাও ভাবতে হবে যে ওই ব্যক্তিটির অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে উৎপাদন হ্রাস ঘটবে এবং উৎপাদন ঘাটতির জন্য হয়তো আরো কিছু লোকের না খেয়ে থাকার আশঙ্কা থেকে যায়। ২০০৭ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গরিব শ্রেণি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও বিশুদ্ধ পানি না পেলে জাতীয় পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ এবং তা স্বাস্থ্য বাজেটের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি।
বলা বাহুল্য, এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে নিরাপত্তাজাল কর্মসূচির পরিধি দ্বিগুণ করা যায়। দ্বিতীয়ত, বাজারকে দরিদ্রের ‘ভিলেন’ হিসেবে না দেখে তার ‘ভরসা’ হিসেবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। একজন লোক দরিদ্র থাকবে কি না, তা মূলত নির্ভর করে তার দেয় সম্পদ থেকে উৎসারিত লাভের হার বা প্রাপ্তির ওপর। বাজারের আকৃতি বড় হলে গরিব কিছু না কিছু করে খেতে পারে। বাজারবান্ধব অবকাঠামোগত সুবিধা (যথা—রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পরিবহন) দিয়ে সরকারের উচিত বাজারের বিনিময় প্রক্রিয়ার বিকৃতি রোধ করে এই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিযোগিতামূলক করে গড়ে তোলা। তৃতীয়ত, দুর্নীতি নামক ব্যাধিটি গরিব জনগোষ্ঠীর অর্থ ও সম্পদ লোপাট করে। দুর্নীতি একসঙ্গে গরিবের দুশমন। দুর্নীতি নির্মূল তাই আশু প্রয়োজন। দুর্নীতির বিস্তৃতি প্রতিবছর জিডিপির ২-৩ শতাংশ কেড়ে নেয়, যার প্রভাব পড়ে দারিদ্র্য হ্রাসে। আইনের কঠোর অনুশাসন গরিবের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। সার্বিকভাবে সুশাসন এবং দারিদ্র্য মাত্রার যোগসূত্রতা আজ সর্বত্র সুবিদিত।
তিন.
(ক) সামাজিক, জনমিতিক ও মানবসম্পদ ঘিরে দারিদ্র্য নিরসনে সুপারিশ হতে পারে নিম্নরূপ : জনসংখ্যা কমছে—এই আপ্তবাক্যে আশ্বস্ত হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কারণ এখনো প্রতিবছর ২০ লাখ নতুন মুখ যোগ দিচ্ছে ‘মানব মহাসাগরে’।
উচিত হবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রচলিত কর্মকাণ্ডগুলোকে আরো বেগবান করা এবং এনজিও, সরকারি ও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ‘ছোট পরিবারের’ আর্থ-সামাজিক তাৎপর্য যথার্থভাবে তুলে ধরা। প্রয়োজনে বিদ্যালয় ও খামারে অবস্থানের সময় সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে, যাতে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়ে শিক্ষাকে খামারে কাজ করার ‘বিকল্প’ হিসেবে না দেখে ‘সহায়ক’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেদের জন্যও বিশেষ বৃত্তি প্রদান অথবা সম্ভব হলে অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রধান সম্পদ। সে জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে দরিদ্রের প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধিকল্পে রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। আবার উভয় ক্ষেত্রেই গুণগত উৎকর্ষ সাধনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
(খ) কৃষি ও অ-কৃষি সম্পদ নিয়ে ভাবতে হবে : অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা নগরায়ণপ্রক্রিয়ায় সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে চাষযোগ্য জমি যথাসম্ভব কম ব্যবহৃত হয়।
যেহেতু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্বণ্টিত ভূমি সংস্কার কর্মসূচি আপাতত সম্ভবপর নয়, তাই দেশের আনাচকানাচে বিদ্যমান খাসজমি ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণ করা যায় কি না, তা ভেবে দেখার দাবি রাখে।
ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের প্রয়োজনে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবে দেখতে হবে এই ভর্তুকি যাতে প্রকৃত চাষিদের দ্বারে পৌঁছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভর্তুকি কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বর্গাবাজার সম্পর্কিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডে সংস্কার সাধন করা যায় কি না, তা ভেবে দেখার যথেষ্ট অবকাশ আছে। সংস্কারের মূল লক্ষ্য হবে, গরিব চাষি ও জমি মালিকের জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়ার শর্ত যাতে উৎপাদনশীল হয় এবং বর্গাচাষির পক্ষে থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা। ফসলবহির্ভূত কৃষিকাজে প্রণোদনা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার ও এনজিওগুলোকে ঋণ, বাজারজাতকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামে বিরাজমান আয়বৈষম্য কমিয়ে আনতে হলে ভৌত, মানব ও আর্থিক পুঁজিতে দরিদ্রের প্রবেশগম্যতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে এনজিও ও সরকারি পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অত্যন্ত জরুরি।
(গ) তেমনি চাই পরিবর্তিত অ-কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবিকা : খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড যাতে গ্রামাঞ্চলে অধিকতর গতিশীলতা সঞ্চার করতে পারে সে জন্য রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া এবং সবচেয়ে জরুরিভাবে চলমান পুঁজি ও বিনিয়োগের নিমিত্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি করতে হবে, বিশেষত যেখানে ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণের সীমাবদ্ধতা ব্যাপক। একই সঙ্গে প্রয়োজন রয়েছে গ্রামীণ বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নীতকরণের এবং সেবামূলক কর্মকাণ্ড দক্ষতার সঙ্গে বিতরণের।
কৃষি-খাদ্য সংস্থানে গরিববান্ধব কৌশল গ্রহণে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সরকার একদিকে সেবাদান এবং অন্যদিকে তদারকির কাজটি করতে পারে।
নগরায়ণপ্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে খামারবহির্ভূত কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। এগুলোর বৃদ্ধি শহর-গ্রাম অভিপ্রয়াণ কমিয়ে শহরের চাপ কমাতে এবং পরিবেশ উন্নয়নে সহায়তা দিতে পারে।
অ-কৃষি কর্মকাণ্ড থেকে আসা আয় গ্রামে বৈষম্যের বাহক। এই বৈষম্য দূর করতে হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং ঋণের বাজারে প্রবেশগম্যতা ও গরিবদের সুযোগ বৃদ্ধিকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
চার.
তা ছাড়া ধান চাষে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রসার; যেমন—বৃষ্টিস্নাত অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সংগতি রেখে আধুনিক বীজ উদ্ভাবন এবং কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মধ্যকার সংযোগ শক্তিশালী করা প্রয়োজন রয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ এবং গ্রামীণ জীবিকা উন্নয়নে সরকারি কিংবা এনজিওর মাধ্যমে ঋণের বাজার সম্প্রসারিত এবং প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা জরুরি। বিভিন্ন খাতের জন্য গ্রামবাংলায় ঋণের বিপুল চাহিদা বিদ্যমান এবং ব্যাংক ও এনজিওর উচিত হবে বড় আকারের ঋণ দিয়ে এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল রাখা। স্মরণীয় যে পরোক্ষভাবে প্রযুক্তির প্রসার ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমেও সুদের হার কমানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি ভর্তুকির কোনো প্রয়োজন নেই। এনজিওর উচিত হবে ‘দারিদ্র্য নিরসনে ঋণ’ এই স্লোগানকে কম গুরুত্ব দিয়ে ‘দারিদ্র্য নিরসন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে ঋণ’ এই স্লোগান তুলে ধরা। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকৃতির শিল্প ও ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করা।
পাঁচ.
কৃষকের লাভ-লোকসান চিন্তা না করলে দারিদ্য নিরসন সহজ হবে না। কারণ বর্তমান বাংলাদেশে বেশির ভাগ কৃষক প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক। যে দেশে ব্যাপক ভূমি সংস্কার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্ভব নয়, সে দেশে বর্গাবাজারের সংস্কার ও ঋণের বাজারে এসব কৃষকের প্রবেশগম্যতা বাড়িয়ে কল্যাণমুখী উদ্দেশ্য সাধন করা যেতে পারে। বিশেষত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রা নির্ধারণে কৃষকদের জন্য অব্যাহত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। অন্যদিকে কৃষি মজুরির ঊর্ধ্বগতির প্রেক্ষাপটে কৃষি যান্ত্রিকতাকে বিভিন্ন নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে উৎসাহ প্রদান করা প্রয়োজন।
সরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে পারলে এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে সময়ের ব্যাপ্তিতে বাজারজাত করতে পারলে ভোক্তা ও কৃষকের পর্যায়ে মূল্যের ব্যবধান কমবে। ফলে একদিকে যেমন পণ্যের চাহিদা বাড়বে, অন্যদিকে তেমনি কৃষকের আয় বাড়বে। আবার বহুজাতিক কম্পানির সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টির মাধ্যমেও এসব পণ্যের দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যায়।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়