কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দীর্ঘ হচ্ছে উদ্বাস্তু মানুষের কাফেলা

এ কে এম আতিকুর রহমান [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২০ জুন ২০২৫]

দীর্ঘ হচ্ছে উদ্বাস্তু মানুষের কাফেলা

আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্বের সব শরণার্থীর অমানবিক জীবনযাপনের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিবছরই বিশ্বজুড়ে এই দিবসটি পালন করা হয়। শরণার্থীদের প্রতি যেন আমরা মানবিক হই, তাদের কষ্ট লাঘব করতে পাশে দাঁড়াই, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করি—এসব উদ্দেশ্যেই দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও দিবসটিকে কেন্দ্র করে জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিবছরই নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।


   
২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০১ সালের জুন মাসের ২০ তারিখ থেকে বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়ে আসছে। ওই দিনটিকে বাছাই করার পেছনে ২০০১ সালে শরণার্থীদের অবস্থা সম্পর্কিত ১৯৫১ সালের কনভেনশনটির ৫০ বছর পূর্তি হওয়ার বিষয়টিও কাজ করেছে। অন্যদিকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পালিত হওয়া আফ্রিকান শরণার্থী দিবসটিও পরবর্তীকালে ২০ জুন তারিখে বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবেই পালনের সিদ্ধান্ত হয়। মূলত বিশ্ব শরণার্থী দিবস শরণার্থীদের শক্তি ও সাহসকে সম্মান করে এবং সংঘাত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের জন্মভূমি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হওয়া শরণার্থীদের জনসচেতনতা ও সমর্থনকে উৎসাহিত করে।

 


এই দিবসটি শরণার্থীদের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতি ও বোঝাপড়া তৈরি করার এবং তাদের জীবন পুনর্নির্মাণে তাদের খাপ খাওয়ানোর শক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আর এসব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও মানসিক প্রস্তুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
এবারের বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালনের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সমাজ একটি পরাশক্তি (কমিউনিটি এজ আ সুপারপাওয়ার)। আর এই প্রতিপাদ্যে শরণার্থীদের সমর্থন ও স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে সমাজের ক্ষমতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

 


২০২৫ সালে বিশ্ব শরণার্থী দিবসের লক্ষ্য হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, শরণার্থীদের সহায়তা প্রদান এবং তাদের স্বাগত জানানোর জন্য সমাজের সব সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করা। এ ছাড়া দিবসটি বিশ্বজুড়ে যেসব জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষ বর্তমানে যুদ্ধ, নিপীড়ন, সহিংসতা, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য অনিরাপদ অবস্থার হুমকির মধ্যে বসবাস করছে, তাদের শনাক্তকরণের আশাবাদ ব্যক্ত করছে।
২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৩২ লাখে, যার মধ্যে তিন কোটি ৬৮ লাখ ছিল শরণার্থী। অন্যদের মধ্যে রয়েছে আশ্রয়প্রার্থী (৮৪ লাখ) এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা (সাত কোটি ৩৫ লাখ)। উল্লেখ্য, গত দশকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

 


দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে সিরিয়ায় (এক কোটি ৩৮ লাখ)। যেসব দেশের সবচেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে, সেগুলো হলো ভেনিজুয়েলা (৬২ লাখ), সিরিয়া (৬০ লাখ), আফগানিস্তান (৫৮ লাখ), ইউক্রেন (৫১ লাখ) ও দক্ষিণ সুদান (২৩ লাখ)। এই পাঁচটি দেশের শরণার্থীরা বিশ্বের মোট শরণার্থীর ৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জোর করে তাদের ভিটামাটি থেকে দেশছাড়া করেছে। 
দেখা গেছে, এই বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া পাঁচটি দেশ হলো ইরান (৩৫ লাখ), তুরস্ক (৩৩ লাখ), কলম্বিয়া (২৮ লাখ), জার্মানি (২৭ লাখ) ও উগান্ডা (১৮ লাখ)। বিশ্বের মোট শরণার্থীর ৩৭ শতাংশই অবস্থান করছে এই পাঁচটি দেশে। যে নামেই সংজ্ঞায়িত করি না কেন, প্রায় ১২ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে মালয়েশিয়ায়ও কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় লাভ করেছে। মোট শরণার্থীর ৪০ শতাংশ শিশু ছাড়াও ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আরো প্রায় ২৩ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে শরণার্থী হিসেবে।

 

 

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বাস্তুচ্যুতির মুখ্য কারণ এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের নিরাপদ গন্তব্যে আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করে দেখা গেছে যে (১) গত দশকে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে; (২) শরণার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে (মোট শরণার্থীর ৬৭ শতাংশ); (৩) বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ; (৪) নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বেশির ভাগ শরণার্থী (মোট শরণার্থীর ৭৩ শতাংশ) আশ্রয় নিয়েছে এবং (৫) জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির প্রধান কারণ হলো সংঘাত (রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগোষ্ঠীগত) এবং সেসব থেকে উদ্ভূত নির্যাতন ও নিপীড়ন।

 

 

প্রাপ্ত এক তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে মাত্র ১৮ লাখ শরণার্থীকে তাদের নিজেদের দেশে বা অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসন করা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘ বা বিশ্ববাসী এ ক্ষেত্রে নানা জটিল সমীকরণের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে সমাধানের পথটি আর বের করে আনতে পারে না। তাদের প্রত্যাবাসনে মূলত দুটি প্রতিবন্ধকতার উদ্ভব ঘটে—তাদের নিজ দেশের সরকারের তাদের ফেরত নিতে অনিচ্ছা এবং প্রত্যাবাসনের জন্য তাদের দেশে নিরাপদ অবস্থা বিরাজ না করা। অনেক সময় সেখানে নিরাপদ অবস্থা বিরাজ করলেও সরকার ফেরত নিতে চায় না বা নানা অজুহাতে আলাপ-আলোচনা দীর্ঘায়িত করে। এ ক্ষেত্রে ওই দেশকে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে জাতিসংঘ বা সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা বাধ্য করতেও পারে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনও তেমনি মায়ানমার সরকারের টালবাহানার শিকার হয়ে অনিশ্চিত হয়ে আছে। সর্বোপরি, মায়ানমারে সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পর এবং বর্তমানে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনিরাপদ বিধায় বিষয়টি অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। 

 

 

বাস্তবতা হলো, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যে কেউ শরণার্থী হতে পারে। এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির শিকার হয় যে মানুষগুলো, তাদের কিন্তু কোনো দোষ নেই। তারা দুর্ভাগ্যবশত তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তাই তাদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং কর্মদক্ষতা যাতে তারা কাজে লাগাতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব। এতে সমাজ বা রাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে।

 

 

শরণার্থীদের যেন দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তুচ্যুত হয়ে থাকতে না হয়, তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা দরকার। খুব কমসংখ্যক শরণার্থীকে তাদের নিজ দেশে ফিরতে দেখা যায়। তাই শরণার্থীরা যাতে তাদের নিজ দেশে তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসনের সুযোগ পায় সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। যেহেতু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোই বেশির ভাগ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, তাই তাদের ওপর থেকে চাপ কমাতে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। প্রয়োজনে তৃতীয় দেশে, বিশেষ করে যেসব উন্নত দেশে লোকবলের চাহিদা রয়েছে, সেখানে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে যত দিন বাস্তুচ্যুত মানুষ থাকবে, তা যেখানেই হোক, তাদের জন্য সাহায্য-সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে, তাদের মানুষের মর্যাদা দিয়ে বাঁচতে দিতে হবে—আজকের দিনে এই হোক আমাদের সবার অঙ্গীকার।

 

 

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব