ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও আমাদের করণীয়
রাকিব হাসান সেলিম । সূত্র : কালবেলা, ২০ জানুয়ারি ২০২৫

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে একটি দৈনিকে ‘আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা প্রসঙ্গে’ শিরোনামে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটির মাধ্যমে আমি তরুণ প্রজন্মের বর্তমানের নিরিখে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ছয় বছর পর এসে সেই সম্ভাবনার বাস্তবতা আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
ডিভিডেন্ড শব্দটি শুনলে প্রথমে আমাদের মনে হতে পারে পুঁজিবাজার বা শেয়ারবাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয়। কোম্পানির ডিভিডেন্ড মানে লভ্যাংশ, যা বছর শেষে ওই কোম্পানির বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়; যার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সুবিধা গ্রহণ করেন। আর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড মানে একটি দেশের জনসংখ্যার বর্ধিতাংশ, যার মাধ্যমে একটি দেশের উন্নতি সাধন করা সম্ভব হয়। মূলত কর্মক্ষম জনসংখ্যা ব্যবহার করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করাই হলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি) সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কোনো দেশের কর্মক্ষমহীন মানুষের চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি থাকে এবং সেটা যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তখনই তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ হলো ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা, যা জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তন যেখানে কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪ বছর) নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে) ছাড়িয়ে যায়। জনমিতির হিসাবে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে একটি রাষ্ট্রের জন্য উৎপাদনশীল, কর্মমুখী ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সক্রিয় বিবেচনা করা হয় এবং একটি দেশের মানবগোষ্ঠীর এ পর্যায়কে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মানবপুঁজি হিসেবে দেখা হয়।
মূলত একটি দেশকে, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক মুনাফায় প্রবেশের আগে থেকেই সম্ভাব্য অধিক কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। অধিকাংশ রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ২০০৭ সালে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করেছে। আবার কিছু রিপোর্ট অনুসারে ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে অবস্থান করছে। একটি দেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থান করে ৩০-৩৫ বছর।
সে হিসাবে মোটামুটি ২০৪০ সাল পর্যন্ত আমরা এই সুবিধা পাব। কিন্তু বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা কি এ সুবিধাকে কাজ লাগাতে পেরেছি? অথবা যদি না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে কি পারব? উত্তর হলো, রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে আর ভবিষ্যতে পারব কি না, তা নির্ভর করছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকারের পলিসি ও কর্মকাণ্ডের ওপর। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগিয়েই জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া আজ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের বিগত সরকার যদি এই সুবিধা কাজে লাগাতে পারত, তাহলে তরুণ প্রজন্ম কর্মসংস্থান কিংবা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি নিয়ে আন্দোলন করত না কিংবা ছাত্রদের কোটা মুক্তির আন্দোলন বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে হতো না। আসলে এ অবস্থা কেন সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ কম-বেশি আমরা সবাই জানি। যে ভয়াবহ দুর্নীতি রাষ্ট্রকে উন্নয়নের নামে গ্রাস করেছে, লুটপাটের মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে; যেখানে সব সিস্টেম দুর্নীতিবাজদের কারণে প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছিল, সেখানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিয়ে ভাবার মতো বিষয়টি ঈশপের গল্পের মতোই মনে হতে পারে।
যেখানে সিঙ্গাপুর, জাপান জনসংখ্যাতাত্ত্বিক মুনাফায় প্রবেশের সময় থেকে দক্ষ জনশক্তি তৈরির ওপর জোর দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের ৩৫-৪০ শতাংশ ব্যয় করে, সেখানে বাংলাদেশের গত ১০ বছরের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১৮-২০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। এই দুই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকার কারণে কর্মক্ষম শিক্ষিত এবং দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
এই অদক্ষতার নেতিবাচকতা প্রবাসী জনগোষ্ঠীদের দিকে লক্ষ করলেই বোঝা যায়। একটি রিপোর্টে দেখা যায়, প্রায় ১ কোটি মানবসম্পদ রপ্তানি করে বছরে যেখানে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় শুধু ১ হাজার ৬০৩ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত একই সংখ্যক মানবসম্পদ রপ্তানি করে আয় করছে ৭ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের উপস্থিতিতে ৪টি দৃশ্যমান ফলাফল প্রকাশিত হবে। যথা এক. বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে শ্রম বিতরণ সিস্টেম উন্নত হবে; দুই. দেশে সামগ্রিক সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে; তিন. মানবপুঁজি শক্তিশালী হবে এবং চার. অভ্যন্তরীণ বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে। কিন্তু এর প্রতিফলন বিগত সময়গুলোয় আমরা কতটুকু দেখেছি? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই আপনিও খুঁজছেন?
তত্ত্ব ও তথ্যগত আলোচনার পর এবার বাস্তবতার আলোকে এবং ভবিষ্যতের নিরিখে কিছু বিষয় তুলে ধরছি। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে হলে এ মুহূর্তে আমাদের হাতে সর্বোচ্চ সময় আছে ১৫ বছর। অর্থাৎ যে সময় আছে এর মধ্যেই পরিকল্পনা মাফিক দ্রুত এটা বাস্তবায়ন করতে হবে। আগেই বলেছি, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে হলে আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ওপর।
এ দুটি খাতে সরকারকে সর্বোচ্চ বাজেট নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিতে হবে কর্মমুখী ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এ ক্ষেত্রে বিগত সরকারের আমলে ২০১২ সাল থেকে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার প্রভৃতি আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে আমাদের কর্মসংস্থানের করুণ বাস্তবতা উঠে এলে বিগত সরকার কর্মমুখী ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু অব্যাহত দুর্নীতির কারণে বিষয়গুলো সে অর্থে আলোর মুখ দেখেনি।
আমাদের দেশের বিভিন্ন কোম্পানির ম্যানেজেরিয়াল পোস্টের জন্য বিদেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে। এর মূল কারণ আমাদের দক্ষতার অভাব। অনেক শিক্ষিত মানুষ আছে; কিন্তু তারা দক্ষ নয়। তাই যদি পরিকল্পিত উপায়ে ভাগ ভাগ করে সেক্টরওয়াইজ চিন্তা করি, সেভাবে টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাহলে আমরা খুব দ্রুত এর সুফল পাব। এ ক্ষেত্রে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে হলে দুই ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
একটি হলো বিদেশ, অন্যটি দেশে। আমাদের দেশের যেসব লোক বিদেশে যেতে চায়, তাদের জন্য দূতাবাসগুলো ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। পৃথিবীর কোন দেশে কত লোক লাগবে, এটা তারা বের করতে পারে। আর সে আলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি দক্ষ লোক পাঠানো যায়, তাহলে বেশি পরিমাণে অর্থ আমাদের দেশে আসবে; দেশ সমৃদ্ধ হবে। আর দেশের জন্য দক্ষ লোক তৈরির একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষাব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন।
আমরা যদি আমাদের ছেলেমেয়েকে হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তুলি, তাহলে দেশে কোনো বেকার থাকবে না। সবাই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে—এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্কুল লেভেল থেকেই যদি একটি শিশু হাতে-কলমে শিক্ষার জ্ঞান পেয়ে যায়, তাহলে সে সহজে তার লক্ষ্যটাও নির্ধারণ করে ফেলতে পারে। টেকনিক্যাল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।
এজন্য প্রথম শ্রেণি থেকে কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুলে একজন বা দুজন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, যারা ছাত্রছাত্রীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেবেন। এর মাধ্যমে দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি হবে। আমাদের দেশে শিক্ষিত অনেক লোক আছেন; কিন্তু দক্ষ লোকের অভাব। আর কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই একজন মানুষ দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
‘আমাদের দরকার এমন একটি মন্ত্রণালয়, যা দেশের প্রত্যেক মানুষকে স্বাস্থ্যচর্চার উদ্যম, আনন্দ ও উৎফুল্লতার মধ্যে প্রজ্বলিত করে তুলতে পারবে। তার কাজ হবে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, স্বাস্থ্য পিপাসুদের হাজার হাজার উন্মুখ উৎসাহী দল গড়ে তোলা। তাদের ভেতর নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে এমন সব খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলা যেতে পারে, যাতে ব্যয় কম, জায়গা কম লাগে; কিন্তু অনেক মানুষ খেলাধুলার সেই অনাবিল আনন্দের মধ্যে জড়ো হতে পারে। যেমন টেবিল টেনিস। প্রতিটি পাড়ায় কেবল নয়, ঘরে ঘরে এ খেলা চালু করে সারা দেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে এবং হাজার হাজার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে সারা জাতিকে এই খেলায় উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এতে একটি বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্যচর্চার সজীব আনন্দের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।’
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন টেকসই নীতি প্রণয়ন এবং সফল বাস্তবায়ন। সঠিকভাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা দেশের স্বার্থে কাজে লাগাতে আরও প্রয়োজন ১. দেশের মোট ভূমি, ২. পুঁজি, ৩. কৃষি ও শিল্পে উন্নত প্রযুক্তি, ৪. মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ৫. বেকার সমস্যার যৌক্তিকভাবে নিরসন।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০৪৭ সালে বাংলাদেশ একটি প্রবীণ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে। তাই কর্মক্ষম জনসংখ্যার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল জনসংখ্যা নিয়ে এখন থেকেই আমাদের ভাবতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, মোট জনসংখ্যার মধ্যে তরুণদের এই বিপুল অংশ যে কোনো দেশের জন্য বড় সম্ভাবনার সুযোগ হিসেবে গণ্য হবে, যদি সেই দেশের কর্মক্ষম প্রতিটি মানুষকে উপযুক্ত কাজ দেওয়া যায়। বিশেষ করে প্রতি বছর কর্মবাজারে প্রবেশ করে এমন তরুণদের যদি ঠিকঠাকমতো কাজে লাগানো যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, পাশাপাশি সচেতনতা প্রয়োজন ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের।
কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, একটি জাতির জীবনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই আসে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, হাজার বছরে একটি জাতির জীবনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা আসে। তাই সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে মহাকালের এ সুযোগকে কাজে লাগাতে।
লেখক: সদস্য, আলোর ইশকুল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, প্রবা (প্রবীণবান্ধব বাংলাদেশ চাই)