দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
সিরাজুল ইসলাম। সূত্র : আমাদের সময়, ০৭ মে ২০২৫

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বহুল আলোচিত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। বলতে গেলে এটি একুশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দিন দিন জলবায়ুর পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলায় তা আমাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে গবেষণাও চলছে ব্যাপক হারে।
ভূপৃষ্ঠের কোনো স্থানের ২৫ থেকে ৩০ বছরের আবহাওয়ার গড় অবস্থাকে ওই স্থানের জলবায়ু বলা হয়। এটি মূলত কোনো স্থানের দীর্ঘদিনের বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, রৌদ্রালোক ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে নির্দেশ করে। প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন গতিশীল প্রক্রিয়া, সৌর বিকিরণের মাত্রা, অক্ষরেখার দিক পরিবর্তন, সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর অবস্থান ইত্যাদি নানা কারণে জলবায়ু স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হলেও মূলত মানবসৃষ্ট কলকারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাস, কয়লা পোড়ানো, ইটভাটার ধোঁয়া, গাছ কাটা ইত্যাদি কারণেই জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন ও বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যাপক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর এ পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দুই মেরুর বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতা বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের এবং সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ।
জাতিসংঘের কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলনের মতে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার বিষয়টি বাস্তবায়িত হলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক হবে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ-সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং নিতে হবে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ৭টি বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে, যেমনÑ বৃক্ষনিধন রোধ ও গাছ লাগানো; জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো; ইঞ্জিনচালিত গাড়ির ব্যবহার কমানো; পরিবেশ রক্ষায় রাসায়নিক পদ্ধতির ব্যবহার না করা, ব্যবহৃত জিনিস যেখানে সেখানে না ফেলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা ও তা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলা বা রিসাইকেল করা এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
আবার জার্মানিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মান ওয়াচ-এর ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এটি হয়েছে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার আধিক্য, প্লাবনভূমি, উচ্চ দারিদ্র্যের হার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অত্যধিক নির্ভরতার কারণে। জলবায়ু পরিবর্তন শুধু মানব উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে প্রভাবিত করছে না বরং মানব নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া বা আকস্মিক, মারাত্মক বিপর্যয়মূলক বন্যা হওয়া এবং তাপমাত্রার তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ক্ষয়, ঘূর্ণিঝড়, বন উজাড়, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, কৃষিজমি সংকুচিত হওয়া এবং স্থানীয় অভিবাসনের মতো নির্মম প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ।
বৃক্ষ শুধু খাদ্য নয়, আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ করে, ওষুধ, বস্ত্র ও বাসস্থান জোগায়, সুশীতল ছায়া দেয়, ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে, শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানি সরবরাহ করে, শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা করে, বন্যপ্রাণীর খাদ্য ও আশ্রয় জোগায়, সময়মতো বৃষ্টিপাত ঘটাতে সাহায্য করে, পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে, মাটির ক্ষয় ও নদীভাঙন রোধ করে এবং সর্বোপরি উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারাবিশ্বের পরিবেশ, মানুষের জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র্য চরম হুমকির সম্মুখীন। সে জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পরিবেশসম্মত উপায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র বাংলাদেশের একটি অন্যতম উন্নয়ন সংস্থা। মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন এর প্রধান উদ্দেশ্য হলেও পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণ প্রশিকার অন্যতম একটি লক্ষ্য। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্রশিকা বেশ কয়েকটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ‘সামাজিক বনায়ন ও পুনঃসৃজন’, ‘পরিবেশসম্মত কৃষি’, ‘নগর কৃষি কার্যক্রম’, ‘গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি’ ইত্যাদি কর্মসূচি অন্যতম।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রশিকা সারাদেশে পঞ্চাশ লাখ দেশীয় ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় বেশি করে গাছ লাগানোর জন্য প্রশিকার গ্রুপ সদস্যসহ জনগণের মধ্যে বৃক্ষরোপণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রশিকা ‘সামাজিক বনায়ন ও পুনঃসৃজন কর্মসূচি’র মাধ্যমে বর্ষাকালে সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ কোটি বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ রোপণ করেছে এবং দেশের উপকূলীয় জনপদকে সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বন্যা, খরা ইত্যাদি থেকে রক্ষার জন্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার এলাকায় বনায়ন করেছে এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে মোট ৮,৫০০ একরেরও বেশি পরিমাণ জায়গায় শালবন সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে। এই বনায়ন যে শুধু জলবায়ু বা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেছে তা-ই নয়, একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং তারা বনায়ন থেকে আর্থিকভাবেও লাভবান হয়েছে।
রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসারের ব্যবহার প্রশিকার বিকল্প একটি কৃষি কার্যক্রম, যা পরিবেশ রক্ষায় স্থায়িত্বশীল ও ফলপ্রসূ, জীববৈচিত্র্যের পক্ষে সহায়ক এবং রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের সম্পূর্ণ বিপরীত। দীর্ঘ সময় ধরে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা ও মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ বায়ুদূষণ ও প্রকৃতির উপকারী পোকামাকড় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাটি ও প্রকৃতির এসব উপকারী উপাদান রক্ষার জন্যই প্রশিকা পরিবেশসম্মত উপায়ে অর্থাৎ জৈবসার বা জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে কৃষি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। এই পদ্ধতিতে প্রশিকার কৃষির কার্যক্রম ফসলের মাঠ ও বসতবাড়ির আঙিনা উভয় ক্ষেত্রেই সমভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রশিকা রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহারে ১৪,৭৩৮ বসতবাড়িসহ ২,৬০,৯৩৯ হেক্টর ফসলের জমি প্রশিকার জৈব কৃষির আওতাভুক্ত করেছে এবং এর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখ্য যে, পরিবেশসম্মত কৃষি কার্যক্রমে প্রশিকার বিশেষ অবদানের জন্য ২০০০ সালে জাতীয় কৃষি পুরস্কার লাভ করেছিল। তা ছাড়া জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে দেশের ও জনগণের কল্যাণে প্রশিকা ‘গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি’ ও ‘নগর কৃষি’ নামক দুটি কর্মসূচি নিজেদের অর্থে গত অর্থবছর থেকে বাস্তবায়ন করে আসছে। কর্মসূচিগুলোর উদ্দেশ্য হলো নগরের প্রতিটি বাড়ি, স্কুল-কলেজ, প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ও এগুলোর আশপাশের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা সবুজে ছেয়ে দেওয়া এবং শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে বৃক্ষরোপণের কোনো বিকল্প নেই। বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য বসতবাড়ির আশপাশে ও বন্যামুক্ত উপযুক্ত উঁচু জমিতে বৃক্ষ রোপণ করতে হবে।
জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে সমাজকে কীভাবে আরও সবুজ করে তোলা সম্ভব সে সম্পর্কে বৃহত্তর সচেতনতা তৈরির ওপর আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। পরিবেশগত এই বিপর্যয়ের মুখে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিবেশগত, প্রতিবেশগত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে গ্রামীণ ও শহর অঞ্চলে বেশি করে গাছ লাগানোর জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে হবে। সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে এবং সুন্দর পৃথিবী নির্মাণে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।
সিরাজুল ইসলাম : প্রধান নির্বাহী, প্রশিকা