কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দেশের উন্নয়নে নারী : নারীর উন্নয়ন

আব্দুল বায়েস [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ০৪ আগস্ট ২০২৫]

দেশের উন্নয়নে নারী : নারীর উন্নয়ন

বাংলাদেশের উন্নয়ন গল্প নিয়ে রচিত বই, গবেষণা প্রবন্ধ, পত্রিকায় লেখালেখি এবং বক্তৃতা-বিবৃতির কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। ওসবে বিধৃত ইতিবাচক বিবর্তন সম্পর্কে কোনো বিতর্ক আছে বলেও ঠাহর হয় না। তবে স্বীকার্য যে, সমাজবিজ্ঞানীদের এসব পর্যালোচনায় উন্নয়নে নারীর ভূমিকা নিয়ে তথ্যবহুল লেখা খুব কম নেই বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। অথচ শুরু থেকে উন্নয়নের নাড়িতে যে নারীও ছিল, সে গল্পটা অধরা রয়ে যায়। যেমন : নারীর অবদান স্বীকৃত নয় অন্যখানে ঘরে ত বটেই । তবে খরা কাটালেন পপুলেশন কাউন্সিলের সাজেদা আমিন-বিআইডিএস আয়োজিত এক কনফারেন্সে। তিনি তার এক গবেষণা প্রবন্ধে বাংলাদেশের সফল উন্নয়ন গল্পের প্রেক্ষিতে নারীর ভূমিকা অনুসন্ধান করেছেন। তবে ক্ষমতায়নের মতো জটিল বিষয়ে ব্যাপৃত না থেকে তিনি অন্তর্ভুক্তি এবং অংশগ্রহণকে প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সাজেদা আমীন মূলত কয়েকটি প্রশ্নের প্রায়োগিক মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছেন।

 

 

যেমন : (ক) বাংলাদেশের উন্নয়ন কি নারীদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছে? (খ) সাম্প্রতিক প্রবণতা  কি নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়? (গ) বাংলাদেশের উন্নয়ন সফলতায় কি, নারীর ক্ষমতায়ন দরকারি? প্রসঙ্গত বলে নেওয়া দরকার যে, নারীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গৃহীত উন্নয়ন কৌশলে প্রাথমিক প্রাধান্য ছিল না। তবে দেখা গেছে, ইচ্ছাকৃত বা অন্যভাবে, উন্নয়ন অগ্রাধিকার নারীকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। অনেক ক্ষেত্রে নারীর নিয়োগের পেছনে সচেতন অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্দেশ্যের চেয়ে, নারীর উপযুক্ততা কাজ করেছে বেশি। এটা সুবিধাভোগী নারী হিসেবে যেমন সত্য ছিল, তেমনি সত্য উন্নয়নের এজেন্ট হিসেবে নারীর ক্ষেত্রেও।

 


উন্নয়ন কর্মশক্তি নারীর অন্তর্ভুক্তির শুরু সত্তরের দশকে। তখন স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা ছিল উন্নয়নমূলক গুরুত্বের প্রধান জায়গা; সেবা সরবরাহের প্রধান মাধ্যম ছিল কমিউনিটি আউটরিচ এবং  বিশেষ প্রকল্পে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ দিয়ে টিকা এবং পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারে নারীদের উৎসাহিত করা। এর মধ্যে থাকত নারীদের অধিকতর প্রবেশগম্যতা প্রদানে নারী-পরিবার পরিকল্পনা কর্মী নিয়োগ দান করা। সেই সময়কার নারীদের ভূমিকা নিয়ে বলা হয় যে,  প্রধান উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নে নারী অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তবে উন্নয়ন কৌশলগুলো গুরুত্বপূর্ণভাবে নারীদের মধ্যস্থাকারী হিসেবে সুযোগ প্রদান করে। আর এই মধ্যস্থ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দায়িত্ব বা নেতৃত্বে না থাকলেও নারীদের জন্য একটা প্রধান ভূমিকা পালনে সাহায্য করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে, যেখানে  পর্দা প্রথা, শ্রমবাজারে এবং নেতৃত্বে অসম্পৃক্ততার জন্য নারী অদৃশ্যমান, সেই অবস্থায় সামাজিক পরিবর্তন বিশ্লেষণে একটা ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। নব্বই দশকের শুরুর আগ পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারে নারীদের বোঝাতে, নারী-কর্মীদের সফলতা যথেষ্ট নথিভুক্ত হয়নি এবং স্বীকৃতি পায়নি। তবে পরবর্তীকালে সফলতার সঙ্গে দুর্গম অঞ্চলে, রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশে, নারীদের আস্থা অর্জন করে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সেবা দানের কাজে পৌঁছার জন্য নারী মাঠকর্মী যে চাবিকাঠি ছিল, সে ধারণা পাওয়া গিয়েছিল অনেক আগেই। অব্যবহিত এবং স্বল্পকালীন এমন প্রভাবের বাইরে টেকসই পরিবর্তন প্রত্যাশী এমন মেয়ে এবং যুবা নারীদের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সেবায় নিয়োজিত নারী কর্মীরা রোলমডেল হিসেবে ধরা দেয়।

 

 


সত্তরের দশকের স্বাস্থ্যকর্মীদের অধিকাংশই ছিল পুরুষ, কিন্তু আশির দশকের শুরুতে ব্যাপক টিকা প্রচারাভিযানে, অপেক্ষাকৃত উন্নত এলাকায় নারীকর্মী নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে।  সমগ্র  গ্রামীণ  বাংলাদেশে ৬৪০০০ পরিবার পরিকল্পনাকর্মী যখন নিয়োগ পেল, নারীরা নিয়মিত পরিদর্শনে যেত নারীদের সেবায়। শিশুদের টিকা কর্মসূচি এই কর্মশক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল যারা ঘরে ঘরে গিয়ে শিশু নির্বাচন করত স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থা স্থাপনের জন্য। আর এমনি করে নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশে টিকা প্রদানের হার শিখরে পৌঁছায়। তেমনি, পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের সমান্তরালে, শিক্ষা খাত শনাক্ত করে বিদ্যালয়ে মেয়েদের কম অন্তর্ভুক্তি এবং নারী শিক্ষক নিয়োগকে অগ্রাধিকার প্রদান করে কোটা প্রথা প্রচলন দ্বারা শিক্ষকদের মধ্যে নারী-পুরুষ অনুপাত বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যদিও প্রারম্ভে, বয়স্ক নারীদের  শিক্ষার স্তর কম থাকায় এই হারগুলো খুব নিম্নে ছিল, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অনুপাতটি ওপরে উঠতে থাকে এবং ২০১৮ সাল নাগাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল নারী। বাংলাদেশের উন্নয়ন গল্পে নারীর অন্তর্ভুক্তি কি দরকারি ছিল? সাজেদা আমীন তার প্রবন্ধে যুক্তি দেখান যে, একটা প্রারম্ভিক দরকারি পরিবর্তন ছিল উন্নয়ন সীমানায় নারীদের বিস্তারণ ঘটানো। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পরিবার পরিকল্পনায় কর্মশক্তিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি এবং প্রাথমিক সুবিধাভোগী হিসেবে শনাক্তকরণ ছিল বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলের বৈশিষ্ট্য। এমনি করে নারী হয়ে উঠে উন্নয়নের দৃশ্যমান  ঘটক (ভিজিবল এজেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট)। অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচিতেও নারী এবং তাদের পরিবারের সম্পদ ব্যয়-অনীহা দূর করার জন্য, সম্পদের সম্প্রসারণ ঘটায়।

 

 

যেমন : শিক্ষামূলক বৃত্তি, কিছুটা পরিবহন খরচ এবং ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে সম্পদে বড়মাপের প্রবেশগম্যতা বৃদ্ধি । কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে, পরিকল্পিত সম্পদ হস্তান্তর নারীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের পথে বিশেষ বাধা অপসারণে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। ‘কিশোরী কণ্ঠ’ কর্মসূচির মাধ্যমে নগদ অর্থ হস্তান্তর করে কিশোরী ক্ষমতায়ন এবং বিলম্বিত বিবাহ, নারীর সামাজিক সম্পদ তৈরিতে নিরাপদ স্পেস সৃষ্টি ইত্যাদি পদক্ষেপ নারীর জন্য সুযোগের জানালা উন্মোচিত করে দেয়। তেমনি করে ‘বালিকা’ কর্মসূচি বিভিন্ন বিষয়ে রূপান্তরিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে নারী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তমূলক কিছু বলা না গেলেও, এতটুকু বোধ করি উল্লেখ করা যায় যে, বাস্তবায়নকারী এবং পরিকল্পিত সুবিধাভোগী হিসেবে নারীর অন্তর্ভুক্তি গুরুত্বপূর্ণ এবং সফলতা এর কেন্দ্রে অবস্থিত, বিশেষ করে যখন উন্নয়নকে দেখা হয় সামাজিক উন্নয়ন উদ্দেশ্যের আলোকে।

 

 

নারীর শিক্ষা, প্রত্যাশিত জীবন, জীবনকে প্রভাবিত করে এমন বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে উপসংহার টানা যায় যে গেল ৫০ বছরে নারী তার পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের প্রত্যাশিত আয়ু বেড়েছে ২৫ বছর, গড়পড়তা সন্তান জন্ম ছয় থেকে  দুয়ের একটু ওপরে হ্রাস, শিক্ষা সর্বজনীন এবং ছেলেদের সমকক্ষ।  অধিকাংশ নারী মনে করে যে, জীবন প্রভাবিত করে এমন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা অংশীদার এবং একই সংখ্যক এই ধারণা বাতিল করে যে,  নারী যেকোনো কারণেই মার খেতে পারে। যাই হোক, এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে নারীর মঙ্গল, বিশেষ করে মেয়েদের, আদর্শিক অবস্থান থেকে দূরে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাল্যবিবাহ। এখনও এক বিরাট অনুপাতের মেয়েদের বিয়ে হয় ১৮ বছরের নিচে যখন বয়স, নারীর পোশাকে শকুনি দৃষ্টি এবং নারীকে রশি দিয়ে ঘরে বেঁধে রাখার পাশবিক উন্মাদনা। আবার যারা নগদ অর্থের বিনিময়ে শ্রম দেয় তারা, যারা দেয় না তাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতায়িত, লাভজনক কর্মকাণ্ডে নারীর নিয়োজিত হওয়ার সম্ভাবনা পুরুষের অর্ধেক। অল্প বয়স্ক নারীরা সবচেয়ে কম বেকার।  সাধারণত বেকার নারী জীবনের প্রথম ভাগে ক্ষমতাহীন হয় এবং শিক্ষার মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হয়।  সুতরাং দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে শ্রমবাজারে তাদের প্রবেশের পথ সুগম করা, কাজ আর জীবনের মধ্যে ভারসাম্য আনয়নের সমস্যার সমাধান এবং নারীকে তার পূর্ণ প্রতিভার বিকাশে সাহায্য করা।

 

 

মোট কথা, বাংলাদেশের সফলতার গল্পে নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। উন্নয়ন কর্মী এবং উন্নয়নের সুবিধাভোগী হিসেবে তাদের অন্তর্ভুক্তি, বাংলাদেশের জন্য সফলতা সম্ভব করেছে। এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অন্য বাধাগুলো অপসারণ করা যাতে অন্তর্ভুক্তি মানে দাঁড়ায় ইতিবাচক ক্ষমতায়ন। অথচ জিডিপিতে গৃহস্থালি কাজে তাদের অবদানের কোনো স্বীকৃতি নেই।  যদিও সামাজিক গবেষকগণ বলছেন, ওই হিসাব ধরলে জিডিপিতে নারী অবদান রাখে ২৫-৩০ ভাগ। যে কারণে অনেক আগেই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গেছেন ‘বিশে^র যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।

 

 

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিবিদ্যালয়