কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা ও কূটনীতির টানাপোড়েন

বিদায় নেওয়া বছরের চেয়ে ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেশি অস্থিরতার আলামত দেখা যাচ্ছে। এসব অঞ্চলের রাজনীতি–অর্থনীতি–কূটনীতি নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ। সূত্র : প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা ও কূটনীতির টানাপোড়েন

যেকোনো গণ–অভ্যুত্থান লম্বা এক অস্থিরতার কাল নিয়ে আসে। নতুন বছরে জুলাই আন্দোলনের পাঁচ মাস পূর্তির সময়ও বাংলাদেশ সেই অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়েই যাচ্ছে। হয়তো এ পথের আরও ক্ষতবিক্ষত অংশ দেখা বাকি। একই ধরনের অবস্থার ছাপ আছে আশপাশের অনেক দেশে। আবার অনেক জনপদে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কলাকৌশল ও আকাঙ্ক্ষার ছাপ পড়ছে।

বাংলাদেশর মতোই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সন্ধানে আছে এ মুহূর্তে প্রতিবেশী মিয়ানমার, বিশেষভাবে আরাকান। পশ্চিমবঙ্গও মৃদুপায়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথে হাঁটছে। মণিপুরের সহিংসতা মিজোরামকে জাতিগতভাবে আন্দোলিত করছে। মণিপুর, মিজোরামসহ আশপাশের জাতিগুলো নতুন প্রশাসনিক বন্দোবস্ত চাইছে।


কাছের অবস্থা ছাড়িয়ে দূরে চোখ ফেরালেও তেমনই দেখা যায়। নেপালে মাওবাদীদের উত্থান রাজনৈতিক কাঠামোয় যে নাড়া দিয়েছিল, সে অবস্থা এখনো থিতু হয়নি। পাশের দুই বড় প্রতিবেশীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ছাপ কাঠমান্ডুর রাজনীতির মেরুকরণে এখনো বেশ নজর কাড়ে।

শ্রীলঙ্কায় গণ–অভ্যুত্থান রাজপক্ষেদের হটিয়ে দিলেও রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক ধরন পাল্টানোর পথ খুঁজছে। চীন-ভারতের ছায়া এখনো এড়াতে পারছে না মালদ্বীপ। বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে পাকিস্তান। তুমুল সংঘাত বেধেছে তাদের সঙ্গে পাশের আফগান পশতুদের।

সম্ভাবনার হাতছানি চট্টগ্রামের দিকে
বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তসূচক দিনটি গত ৬ আগস্টের বদলে ৫ আগস্ট কেন এগিয়ে আনা হয়েছিল, সেটা ঢাকায় এখনো ভালো করে জানাজানি হয়নি বলেই মনে হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই অভ্যুত্থানের ভূরাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখে আরাকানিরা বাধ্য হয়েছিল তাদের গেরিলা ‘টাইম-লাইন’ লক্ষ্য এগিয়ে আনতে। কারণ, ৫ আগস্টের পরপরই গণচীন মিয়ানমারে তার এত দিনের কৌশল অনেক পাল্টে ফেলেছিল।

২০২৫ সালে আরাকান ও চিন প্রদেশ ক্রমে যত বেশি স্বায়ত্তশাসিত চেহারা নেবে, তত বাংলাদেশ দেখবে দক্ষিণ-পূর্বে সম্পূর্ণ নতুন কয়েক জনপদের সঙ্গে তাকে সম্পর্ক গড়ার বন্দোবস্তে নামতে হচ্ছে। ঢাকায় বুদ্ধিমত্তা ও স্থিরতার কাল এলে সহজেই ক্যাম্প ভিক্টোরিয়া, আইজল ও আকিয়াব চট্টগ্রামের নতুন দিগন্ত হয়ে উঠতে পারে। মণিপুর দাঙ্গার স্থায়িত্ব যত বাড়ছে, তত দক্ষিণ-পূর্বের জনপদগুলো অপার এক সম্ভাবনার আকুতি নিয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে।

গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত মিয়ানমারে আরও নাটকীয় কোনো অবস্থা বাংলাদেশের সামনে ‘অভিভাবকসুলভ’ ভূমিকার দাবি নিয়ে হাজির হতে পারে নতুন বছরে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের খোঁজে ব্যস্ত থাকা ঢাকার নীতিনির্ধারক ভরকেন্দ্রগুলো তার জন্য কতটা প্রস্তুত, সে প্রশ্নও আছে। ভূরাজনীতিতে সম্ভাবনা হাতের মুঠোয় নিতে না পারলে সেটা ঝুঁকিতে পরিণত হয়।

পশ্চিমবঙ্গ-আসাম-ত্রিপুরায় বাংলাদেশবিদ্বেষের বাড়বাড়ন্ত
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-আরএসএসের উত্থান নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের জন্য সতর্ক প্রস্তুতি দাবি করছে। আর ১৪-১৫ মাস পর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হবে। পরের দুই বছরে হবে আসাম ও ত্রিপুরায়। বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থানকে ঘিরে আরএসএস-বিজেপির প্রচারযুদ্ধ মূলত এই তিন নির্বাচনকে লক্ষ্য করেই।

এর ভেতর পশ্চিমবঙ্গ দখল বিজেপির জন্য দিল্লি দখলের পরই দ্বিতীয় গুরুত্বের টার্গেট। গত বিধানসভা নির্বাচনে তারা ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এখানে, যা আগের নির্বাচনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ২০১৬ সালে তারা এখানে ৩টি আসন পায়। ২০২১ সালে পায় ৭৭টি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে ব্যবহার করে আসন ও ভোট বৃদ্ধির এই গতিকে ভবিষ্যতে রীতিমতো ঝড়ে পরিণত করতে চায় বিজেপি। ঢাকা থেকে অনেকে বুঝে, না-বুঝে বিজেপির ‘গেম প্ল্যানে’ ইতিমধ্যে যথেষ্ট জ্বালানি জুগিয়ে দিয়েছেন।

‘মিনি বাংলাদেশ’ বলে কথিত সেন্ট্রাল কলকাতার মির্জা গালিব স্ট্রিটের মার্কেটগুলোর ফাঁকা ফাঁকা দশায় বাংলাদেশে অনেকেই উল্লসিত। তাঁরা এটা হয়তো খেয়াল করছেন না, দুই দিকে যেভাবে ভীতি ও ঘৃণার জাগরণ ঘটানোর প্রকল্পগুলো কাজ করছে, তাতে ভবিষ্যতের ঝামেলার আগুন পোড়াবে অনেক কিছু।


আরএসএসপন্থী মিডিয়ার চলতি লক্ষ্য স্পষ্ট; বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল ও সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ একটা রাষ্ট্র হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্তের মনে ভীতিকর করে তোলা। ইতিমধ্যে তার বিরক্তিকর ছাপ পড়েছে কলকাতা ও আশপাশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনে অভূতপূর্ব কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থায়। বইমেলা থেকে বাংলাদেশকে বাদ রাখার চেষ্টায়।

একই ধরনের লক্ষ্যে কিছুটা ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে আরএসএস পরিবার আসাম ও ত্রিপুরায়। বাংলাদেশের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষীর বাস এই তিন রাজ্যে। বরাবরই এখানকার বাংলাভাষীদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশ তাদের সংস্কৃতির রাজধানী হয়ে উঠুক। কিন্তু বাংলাদেশের গণ–অভ্যুত্থান কোনো কারণ ছাড়াই তাদের বাড়তি গেরুয়া বিপ্লবের ঝুঁকিতে ফেলেছে।

বাংলাদেশের তরুণ ‘সংস্কারবাদীরা’ ওই সব অঞ্চলের প্রগতিশীল শক্তিগুলোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক মৈত্রী গড়ার কৌশলের বদলে নয়াদিল্লির শাসকদেরই পুরো ‘ভারত’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাঁরা সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করায় নাগপুরে আরএসএস সদপর দপ্তরের বেশ সুবিধাই হলো। উত্তর ভারতে ভাটার টানের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে তারা এখন ভারতীয়দের মনোযোগ টানছে। শ্রীলঙ্কার জেভিপি অবশ্য এ রকম ভুলের ফাঁদে পড়েনি।