দক্ষিণ এশিয়ায় পানির সঙ্ঘাত
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা অপরিহার্য-মো: বজলুর রশীদ। সূত্র : নয়া দিগন্ত, ০৪ মে ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তার প্রতিবেশীদের সাথে বেশ কয়েকটি পানি বণ্টন বিরোধে জড়িত, যা আঞ্চলিক দ্ব›দ্ব ও ভূরাজনৈতিক গতিশীলতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এসব বিরোধ প্রাথমিকভাবে আন্তঃসীমান্ত নদী, যেগুলো হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে একাধিক দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান নদী হলো সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা। এসব নদী চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে। সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্রসহ এসব নদীর বেশ কয়েকটির উৎসমুখ উচ্চ অববাহিকার রাজ্য হিসেবে চীনও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও এটি দক্ষিণ এশিয়ায় চুক্তি ব্যবস্থার অংশ নয়।
পাকিস্তান-ভারত পানি বিরোধ
সিন্ধু নদী নিয়ে পানি বিরোধ ভারত-পাকিস্তান দ্ব›েদ্বর সাথে গভীরভাবে প্রোথিত, বিশেষত জম্মু ও কাশ্মিরের বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে। সিন্ধুর অনেক উপনদী নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলওসি) মধ্য দিয়ে এবং বরাবর চলে গেছে, যা ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মিরকে পাকিস্তানশাসিত অঞ্চল থেকে পৃথক করেছে। সিন্ধু নদের সম্পদ নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক জটিল হয়েছে। সিন্ধু নদ প্রণালী উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে রয়েছে সিন্ধু নদ নিজেই এবং এর উপনদীগুলো- রবি, বিপাশা, শতদ্রু, ঝিলম ও চেনাব। সিন্ধু, ঝিলম ও চেনাব ভারতে উৎপন্ন এবং পাকিস্তানের পানিপ্রবাহের ৮০ শতাংশ অবদান রাখে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সিন্ধু পানি চুক্তি, ওহফঁং ডধঃবৎং ঞৎবধঃু (ওডঞ), ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের পরে উদ্ভূত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তিতে পূর্বাঞ্চলের তিনটি নদী- রবি, বিপাশা ও শতদ্রু পানি অবাধ ব্যবহারের জন্য ভারতকে এবং পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব পাকিস্তানকে বরাদ্দ করা হয়। ভারত পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ এবং সীমিত সেচের মতো অধিকার বজায় রেখেছে তবে তাদের প্রবাহকে এমনভাবে সংরক্ষণ করছে, যা ভাটির দেশের প্রাপ্যতার ক্ষতি করে।
তথ্যবিনিময় এবং প্রকল্প পর্যালোচনা করার জন্য একটি স্থায়ী সিন্ধু কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ ও সালিসি আদালতও ছিল। বাগলিহার ও কিষানগঙ্গা বাঁধের মতো প্রকল্প নিয়ে মতবিরোধ নিরসনের জন্য এ পদ্ধতিটি প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে পানির জন্য ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে চুক্তিটি ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তান চেনাব, বাগলিহার ও ঝিলাম কিষানগঙ্গা, তুলবুল নেভিগেশন প্রকল্পের ওপর ভারতীয় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো নকশা ও স্টোরেজ ক্ষমতা নিয়ে আপত্তি তোলে। পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া গোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পানি ইস্যুকে নিরাপত্তার সাথে যুক্ত করে। ২০২৩ সালে ভারত জলবায়ু পরিবর্তন এবং জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে চুক্তিটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করেছিল। চলতি ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের কথা উল্লেখ করে ভারত চুক্তির অধীনে তার বাধ্যবাধকতাগুলো স্থগিত করার ঘোষণা করেছিল, যদিও এ চুক্তিতে একতরফা স্থগিতাদেশের কোনো বিধান নেই।
পহেলগামে পর্যটকদের ওপর আক্রমণে পাকিস্তানের সমর্থন রয়েছে এমনকি জড়িত জানিয়ে মোদি সরকার ওহফঁং ডধঃবৎং ঞৎবধঃু (ওডঞ) উপেক্ষা করে প্রথমে কোনো নোটিশ ছাড়া পানি বন্ধ করে দেয় পরে কাউকে কিছু না জানিয়ে পানি ছেড়ে দেয়া হলে পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মিরে বন্যা দেখা দেয়। এতে পাকিস্তান জবাব দেবে জানায়, ফলে পানি বিরোধ পানি যুদ্ধে পরিণত হতে চলেছে।
বাংলাদেশ-ভারত পানি বিরোধ
গঙ্গা নদী ব্যবস্থাপনা : ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গাসহ ৫৪টি নদী রয়েছে। এসব নদ-নদীর পানি বণ্টন নিয়ে নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। সীমান্তের কাছে ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য নিরসনে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে এধহমধ ডধঃবৎং ঞৎবধঃু, গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তিতে ফারাক্কায় পানি বণ্টনের একটি ফর্মুলা নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে পানির ভাগে সমতার নীতি দ্বারা সুরক্ষিত। তবে এ চুক্তিটি ব্যারাজে জলের প্রাপ্যতার ওপর উজানের পানির ব্যবহার বা জলবায়ুর প্রভাব জড়িত। ভাটিতে বন্যা ও খরার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ফারাক্কা বাঁধের সমালোচনা করেছে বাংলাদেশ। চুক্তিটি ২০২৬ সালে নবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে এবং প্রযুক্তিগত আলোচনা শুরু হয়েছে। চুক্তি সত্তে¡ও ফারাক্কা থেকে ভারত যে পরিমাণ পানি সরিয়ে নিচ্ছে, তা নিয়ে সমস্যার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা : পানি শোষণ ও ন্যায্য ভাগাভাগি নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধের আরেকটি উৎস তিস্তা নদী। ২০১১ সালে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারত একমত হওয়া সত্তে¡ও দেশটি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে, বিশেষ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছ থেকে। বাংলাদেশ বৃহত্তর অংশ চায় এবং নদীর প্রসারিত অংশে একটি বিলিয়ন ডলার প্রকল্পের বিকল্প তৈরি করতে চায় চীনের সহায়তায়। ভারত তিস্তার বেশির ভাগ পানিসম্পদ ব্যবহার করেছে এবং অসংখ্য বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ তৈরি করেছে।
নেপাল-ভারত পানি বিরোধ
নেপালের নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে- মহাকালি, কোশি ও গন্ডক। মহাকালির মতো নদী নিয়েও নেপালের সাথে চুক্তি করেছে ভারত। তবে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত মহাকালি চুক্তি নদীর জলের সমান অধিকার এবং অধিকারের কিছু নীতি অন্তর্ভুক্ত করা সত্তে¡ও এর বিধানগুলো নিয়ে নেপালে বাস্তবায়নের বাধা ও অসন্তোষের মুখোমুখি হয়েছে। এর আগে ১৯৫৪ সালের কোশি চুক্তি এবং ১৯৫৯ সালে গন্ডক চুক্তি নেপালে অন্যায্য বলে মনে করা হয়েছিল। যেখানে সেচ ও জলবিদ্যুতের সুবিধা ভাগাভাগি নিয়ে সমালোচনা চলছিল। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য চুক্তিগুলো তখন থেকে ভারতীয় সংস্থা এবং নেপালি সরকারের মধ্যে বিল্ড, ওন, অপারেট ও ট্রান্সফার বিওওটি নীতির অধীনে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তা নিয়েও সরকারে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
চীন-ভারত পানি বিরোধ
ভারত ও চীনের মধ্যে পানি বিরোধ বিদ্যমান, যা তাদের অভিন্ন নদী এবং আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা থেকে উদ্ভূত। সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান নদী ব্যবস্থা চীনের স্বায়ত্তশাসিত তিব্বত অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত। সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ এবং পাশাপাশি গঙ্গার কিছু প্রধান উপনদী চীন নিয়ন্ত্রণ করে। চীনের ওপর ভাটির দেশগুলোর এই হাইড্রোলজিকাল নির্ভরতা দক্ষিণ এশীয় অববাহিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক দিক। ভারত ও চীন উভয়ই দ্রুত অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের পথে চলছে, যার ফলে পানি ও জলবিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। উভয়ই তাদের পানির চাহিদা মেটাতে আন্তঃঅববাহিকা পানি স্থানান্তর বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে এবং তাদের জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ কর্মসূচি ত্বরান্বিত করেছে। চীন ট্রান্স-হিমালয় অববাহিকার বৃহত্তম এবং প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে উন্নত সহ-নদী তীরবর্তী দেশ।
আঞ্চলিক গতিশীলতার কারণে চীন ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টন সহযোগিতা কঠিন হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে ১৯৬৫ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর কেউ কাউকে সহজভাবে নিচ্ছে না। চীন নদীর ওপর বাঁধ এবং পানি ডাইভারশন প্রকল্প প্রস্তাব করেছে, যা প্রবাহিত হয় ২০১০ সালে, চীন আনুষ্ঠানিকভাবে তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপোতে (ভারতের ব্রহ্মপুত্র) ৫১০ মেগাওয়াট জাংমু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এই প্রকল্পে নদীর প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়া হবে। একটি উপনদীর ওপর একটি বাঁধসহ নদীর ওপর আরো পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ বিবেচনাধীন এবং গ্রেট বেন্ডে একটি মেগা বাঁধ প্রকল্প নির্মাণের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। চীনের দক্ষিণ-উত্তর নদীর ডাইভারশন প্রকল্পগুলো পানি-দুর্লভ উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করবে।
ভারতের উদ্বেগ ও অনুরূপ পদক্ষেপ : ভারতের জনমত প্রস্তাবিত চীনা পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর চীনের রান অব রিভার বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণেও আপত্তি জানিয়েছে ভারত। তবে সূত্রগুলো উল্লেখ করেছে, চীনের কার্যকলাপ ভাটির দেশগুলোর জন্য ক্ষতিকর আন্তঃঅববাহিকা স্থানান্তরের জন্য নদীগুলোতে বাঁধ দেয়া এবং সংযুক্ত করার জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রস্তাবের চেয়ে আলাদা নয়। সিন্ধু অববাহিকার বিপরীতে, বৃহত্তর গঙ্গা অববাহিকার সব সহ-নদী অববাহিকার একক বিস্তৃত চুক্তি নেই।
উল্লেখযোগ্যভাবে, চীন হেডওয়াটারগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সত্তে¡ও দক্ষিণ এশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কোনো চুক্তির অংশ নয়। চীন বা ভারত কেউই আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক বহুপক্ষীয় কাঠামো গ্রহণ করতে আগ্রহী নয় যা তাদের একতরফা পদক্ষেপ রোধ করবে। চীন ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানিপথের অ-নেভিগেশনাল ব্যবহারের আইন সম্পর্কিত জাতিসঙ্ঘের কনভেনশনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের নীতির প্রতি শ্রদ্ধার অভাব এবং উজান ও ভাটির অধিকারের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার কথা উল্লেখ করে। ভারত বাধ্যতামূলক বিরোধ নিষ্পত্তি এবং তৃতীয়পক্ষের জড়িত থাকার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে ভোটদানে বিরত ছিল।
উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি : পানি বণ্টনের আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নীতির প্রতি শ্রদ্ধার অভাব, এ অঞ্চলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং তাই সঙ্ঘাত প্রত্যক্ষ করার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন যদি তথ্য আদান-প্রদান না করে উজানে একতরফাভাবে কাজ করে, তাহলে বর্তমান ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
বৃহত্তর আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›িদ্বতা : চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) মতো বিশাল বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলজুড়ে কৌশলগত প্রকল্পগুলোতে চীনের জড়িত থাকার বিষয়টি ভারত অনুভব করেছে। একে শুধু বাঁধ নিয়ে বিরোধ নয়, এশিয়ার দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›িদ্বতাও রয়েছে। ভারত ও চীনের মধ্যে পানি বিরোধ অভিন্ন আন্তঃহিমালয় নদী, অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ফলে পানির চাহিদা বৃদ্ধি, চীনের একতরফা উজানের উন্নয়ন পরিকল্পনা, ব্যাপক বহুপাক্ষিক পানি বণ্টন চুক্তির অভাব এবং দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বতা বিরোধকে উসকে দিচ্ছে।
ভুটান-ভারত পানি বিরোধ
ভুটান জলবিদ্যুৎ উন্নয়নে ভারতীয় সহায়তা থেকে উপকৃত হয়। তবে ভুটানে ভারতের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প নিয়ে কিছু উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। নেপাল ও বাংলাদেশের সাথে ভারতের পানি বিরোধের বিপরীতে, ভুটানের সাথে এর মিথস্ক্রিয়া আরো ইতিবাচক, এটি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের পরিবর্তে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং ঝুঁকি এড়ানোর পদক্ষেপের দ্বারা চিহ্নিত। পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার জন্য দুই দেশ ১৯৬১ সাল থেকে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ, চীন ও নেপালের সাথে ভারতের পানি বিরোধ পরোক্ষভাবে ভুটানের সাথে তার সম্পর্ককে আকার দিতে পারে, যদিও ভুটানের নিজেরও পানি নিয়ে ভারতের সাথে বড় ধরনের বিরোধ নেই। ভুটান জলবিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য ভারতের ওপর নির্ভর করে, ভারত অর্থায়ন করে এবং ভুটান থেকে বিদ্যুৎ কেনে।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও ভূরাজনৈতিক ফল্ট লাইন
দুর্লভ পানিসম্পদ, বিশেষত ভাগ করা নদীগুলোর পানি নিয়ে প্রতিযোগিতা আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। পানির সমস্যাগুলো আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক ফল্ট লাইনগুলোর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে, যার মধ্যে হিমালয় ও তিব্বত মালভূমি থেকে উদ্ভূত নদীগুলোও অন্তর্ভুক্ত। এ বিরোধ পাকিস্তানের রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল প্রদেশগুলোতে বিক্ষোভ, দাঙ্গার দিকে পরিচালিত করেছে এবং অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা আঞ্চলিকভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে পানি বিরোধ দিন দিন বাড়ছে, যোগ হয়েছে সীমান্ত বিরোধ, সরকারবিরোধী ‘মব’, সেভেন সিস্টার্স নিয়ে অপপ্রচার ইত্যাদি। পাকিস্তান, বাংলাদেশের বিরোধে চীন জড়িত হলে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়বে।
এ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ও কৌশলগত প্রকল্পগুলো, যেমন- বাংলাদেশে পানি প্রকল্পে সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা এবং তিব্বতে উৎপন্ন নদীগুলোর ওপর বাঁধ নির্মাণ, যাকে ভারত সন্দেহের চোখে দেখছে সেটি আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›িদ্বতায় আরো উত্তাপ ছড়াবে। বিশ্বব্যাংক আইডবিøউটি এবং অন্যান্য আরো উদ্যোগে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করলেও অনেক চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে, যা সহজে সমাধান হওয়ার নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় পানি বণ্টন বিরোধ, ক্রমবর্ধমান ঘাটতি, উজান-ভাটির গতিশীলতা ও ঐতিহাসিক অবিশ্বাস দ্বারা চালিত, বিদ্যমান রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বতা গভীরভাবে জড়িত।
পরিশেষ
দক্ষিণ এশিয়ার পানি সঙ্ঘাত, বিশেষ করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ও চীনের সাথে ভারতের বিরোধ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি ঐতিহাসিকভাবে সহযোগিতার একটি বিরল উদাহরণ; তবে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো নিয়ে উত্তেজনা এবং পানির প্রবাহ হ্রাস সম্পর্কে পাকিস্তানের উদ্বেগ সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি করেছে। একইভাবে উজানে বাঁধ নির্মাণ ও মৌসুমি সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের সাথে ভারতের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। নেপাল আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ভারতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, অন্য দিকে ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটিতে পানির প্রাপ্যতা হ্রাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই বিরোধগুলো ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে, কৃষি, জীবিকা ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা অপরিহার্য।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার