কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

দক্ষিণ কোরিয়ায় বিক্ষোভ, প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে

ড. মো. মোরশেদুল আলম । সূত্র : জনকণ্ঠ, ১১ জানুয়ারি ২০২৫

দক্ষিণ কোরিয়ায় বিক্ষোভ, প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে

দক্ষিণ কোরিয়া একটি নজিরবিহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চরম অনিশ্চয়তার পাশাপাশি দেশটিতে উত্তেজনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামরিক আইন জারির চেষ্টা থেকে সৃষ্ট সংকটের কারণে দেশটিতে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালে রাজনীতিতে নবাগত নেতা ইউন সুক ইওল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন। এই নির্বাচনে মাত্র ০.৭ শতাংশ পয়েন্টের ব্যবধানে বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী লি জা-মিউংকে পরাজিত করেছিলেন।

 

 ১৯৮৭ সালে সরাসরি নির্বাচন শুরু হওয়ার পর এটিই ছিল দুই প্রার্থীর অত্যন্ত কম ব্যবধানে নির্বাচনে জয়লাভের ফল। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে পার্লামেন্টারি নির্বাচনে বিরোধী দল জয় পাওয়ার পর পিপল পাওয়ার পার্টির এই নেতা ‘খোঁড়া হাঁস’ প্রেসিডেন্টে পরিণত হন। তার ক্ষমতা ছিল কেবল বিল ভেটো দেওয়া। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৭ সালে। দেশটির প্রেসিডেন্ট যদিও ইউন সুক-ইওল ছিলেন, তবে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল বিরোধীদের। গত ৩ ডিসেম্বর দেশে সামরিক আইন জারি করেছিলেন ইউন। এটি ছিল রাজনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সিদ্ধান্ত।

 

এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে তিনি রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এমনকি তার দলের শীর্ষ নেতা হ্যাঙ ডং-হুন এই সদ্ধিান্তকে ‘ভুল’ ও ‘অসাংবিধানিক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট এমন এক সময়ে সামরিক আইন জারির ঘোষণা দিয়েছিলেন, যখন নতুন বছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে তার দল পিপল পাওয়ার পার্টি এবং বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব চলমান।

 

জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ইউন সুক-ইওল বলেছিলেন, উদারপন্থি দক্ষিণ কোরিয়াকে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট বাহিনীর হুমকি থেকে সুরক্ষা প্রদান এবং রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন অপশক্তি নির্মূল করতে তিনি সামরিক আইন জারি করেছিলেন। এমনকি দেশটিতে সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একইসঙ্গে দেশের সকল গণমাধ্যম সরকারি পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকার কথা বলা হয়েছিল।

 


মূলত বাজেট বিলে বিরোধীদের ভেটো ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটিকে ঘিরে সামরিক আইন জারির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তবে আকস্মিকভাবে সামরিক শাসন জারির আদেশ মেনে নিতে পারেননি দেশটির আইনপ্রণেতারা। ২০২৪ সালে বিরোধী আইনপ্রণেতারা পার্লামেন্টারি কমিটির মাধ্যমে ছোট আকারের বাজেট পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছিলেন। তবে ইউন বলেছিলেন, বিরোধীরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বাজেটে কাটছাঁট করেছেন।

 

তিনি বলেন, কার্যক্রমগুলোর মধ্যে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই ও জননিরাপত্তার মতো জরুরি বিষয়গুলো ছিল। বাজেটের আকার ছোট করার ফলে দেশ মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। সামরিক আইন জারির বিষয়টি অনিবার্য ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বিরোধী দলের সদস্যরা রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি বলে তিনি মনে করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদ অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

 

এটি আইনি একনায়কতন্ত্রের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। তারা বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করতে চায়। একইসঙ্গে উদারপন্থি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বিরোধী দলের সদস্যরা পাল্টে দিতে চাইছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। অর্থনৈতিক সংকটসহ স্ত্রী কিম কেওন হিকে জড়িয়ে বিতর্কের কারণে যদিও তার জনপ্রিয়তা একেবারেই কমে গেছে। তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রেসিডেন্টের জন্য নতুন করে সমস্যা তৈরি হয়েছিল।

 

তাছাড়া তার দলের শীর্ষ নেতাদের কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিতর্ক দেখা দিলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করতে রাজি ছিলেন না। প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছিলেন বিরোধী দলের নেতারা। এমনকি নিজ দলের নেতৃবৃন্দও তার সামরিক শাসন জারির ঘোষণাকে ‘ভুল উদ্যোগ’ বলে অভিহিত করেছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় এর আগে ১৯৭৯ সালে সে সময়ের সামরিক শাসক পার্ক চুং-হি এক অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানোর পর সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল।

 

দেশটিতে ১৯৮৭ সালে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর তা আর জারি হয়নি। গ্যালাপের জরিপ অনুযায়ী, ইউন সুক-ইওলের জনসমর্থন বর্তমানে ১৯ শতাংশ মাত্র। দেশটিতে সামরিক আইন জারির পর পার্লামেন্ট ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সামরিক আইন জারি করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেনাপ্রধান জেনারেল পার্ক আন-সুকে। প্রেসিডেন্টের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদস্বরূপ বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্টের বাইরে অবস্থান গ্রহণ করে তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সেøাগান দিয়েছিল।

 

এমন পরিস্থিতিতে রাতেই নিরাপত্তা বাহিনীকে এড়িয়ে ১৯০ জন আইনপ্রণেতা পার্লামেন্টে প্রবেশ করে সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেছিলেন। আর দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, পার্লামেন্টের ৩০০ সদস্যের মধ্যে অধিকাংশ সদস্য চাইলে সামরিক আইন বাতিল হয়ে যাবে। সামরিক আইন জারির জন্য অভিশংসিত করে তাকে ক্ষমতা থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরবর্তীসময়ে তার বিরুদ্ধে দেশটির একটি আদালত গত ৩১ ডিসেম্বর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুমোদন করে।

 

এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ ছিল বলে জানা গেছে। গত ৩ ডিসেম্বর ইউন সামরিক আইন জারির ঘোষণা দিলে তার অভিশংসন হয় ১৪ ডিসেম্বর। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ৩ জানুয়ারি তাকে আটক করার জন্য পুলিশ, তদন্ত কর্মকর্তা ও কৌঁসুলিদের দেড়শ’ জনের একটি টিম প্রায় ছয় ঘণ্টা চেষ্টা করে। কিন্তু তার সমর্থকদের বাধার মুখে ইউনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি সার্ভিস (পিএসএস) বাধা প্রদানের কারণে গ্রেপ্তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

 

 

সিউলের হানকুক ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টাডিজের অধ্যাপক ম্যাসন রিচি এ প্রসঙ্গে বলেন, ইউনের প্রতি আনুগত্য থেকে কিংবা নিজেদের আইন ও সাংবিধানিক ভূমিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা থেকে পিএসএস গ্রেপ্তারে বাধা প্রদান করে থাকতে পারে। পিএসএসের ভূমিকা প্রসঙ্গে ম্যাসন রিচি দুটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ইউনকে সুরক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে হয়তো পিএসএসকে নির্দেশনা প্রদান করেননি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই। অথবা তারা তার এমন আদেশ মানেননি।

 


ইউনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিরুদ্ধে করা আপত্তি দেশটির একটি আদালত খারিজ করে দিয়েছে। ইউনের আইনজীবী বলেন, তারা স্থানীয় আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে দেশের শীর্ষ আদালতে আপিল করবেন। তিনি আরও বলেন, আবেদন খারিজ করে দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাটি আইনগত বৈধ। সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। এখন তিনি সাংবিধানিক আদালতের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছেন।

 

এই রায়ই তাকে স্থায়ীভাবে পদ থেকে অপসারণ করবে অথবা পুনর্বহাল করবে। তবে আদালতের এই রায় দিতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে। ইউনের পক্ষে-বিপক্ষে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী সিউলে জড়ো হয়েছিল। এদের একটি অংশ ইউনকে গ্রেপ্তারের দাবিতে আবার আরেকটি অংশ তার অভিশংসনকে অবৈধ ঘোষণা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। ইউনের সমর্থকরা মনে করেন, তাকে গ্রেপ্তার করা হলে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা জোটকে দুর্বল করতে পারে। আর প্রেসিডেন্ট ইউনকে রক্ষা করা মানে হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার হুমকির বিরুদ্ধে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা।

 

ইউন দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে প্রথম চলমান প্রেসিডেন্ট, যিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং তার ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে। এছাড়াও এই প্রথমবারের মতো দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অনেকে মনে করেন, ইউন একজন নিন্দিত, অসম্মানিত নেতা। তার ভাগ্য ঝুলে আছে সাংবিধানিক আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর। আদালত যদি ইউনের অভিশংসন বহাল রাখেন, তাহলে তাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারিত করা যাবে।


মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের সঙ্গে দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এমনকি মার্কিন মিত্র জাপানের সঙ্গে সিউলের সম্পর্কের টানাপোড়েন সত্ত্বেও জাপানকে সিউলে স্থিতিশীলতায় উৎসাহিত করার পরামর্শও দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ব্লিঙ্কেন অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মেয়াদের শেষ দিন তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর আগে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সাং-মকের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন।

 

চোই এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আইনপ্রণেতারা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টকেও অভিশংসন করেছিলেন। মার্কিনপন্থি নীতির কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জো বাইডেনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন ইউন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এই প্রভাব দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতেও পড়েছে। তার সামরিক আইন জারির ঘোষণার জেরে এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি সংকটে পতিত হয়েছে।

 

দক্ষিণ কোরিয়ায় বর্তমান যে অচলাবস্থা চলছে, তা দেশটির রাজনৈতিক মেরুকরণকেও প্রতিফলিত করে। এতে দেশটি সাংবিধানিক সংকটে নিমজ্জিত হয়। এর ফলে, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে প্রবল প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইনজীবী ও কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফার জুমিন লি বলেন, বিষয়টি এমনও হতে পারে ইউন এই পরিস্থিতির প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তার কট্টর অনুগত ব্যক্তিদের দিয়ে পিএসএসকে সজ্জিত করেছেন।

 

দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট যেটি করতে পারেন সেটি হচ্ছে, সাময়িক সময়ের জন্য ইউনের সুরক্ষার কাজ থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য পিএসএসকে নির্দেশ দেওয়া। যদি তিনি তা না করেন, তাহলে পার্লামেন্ট তাকেও অভিশংসিত করতে পারেন। কারণ, এর আগে ইউনের অভিশংসনের পর হান ডাক-সু দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দেশটির আইনপ্রণেতারা তাকেও অভিশংসন করলে অর্থমন্ত্রী চোই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন অভ্যন্তরীণ সংকট দেশটির গণতন্ত্রকেই কেবল নয়, বৈশি^ক নীতিগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে।

 

বর্তমান সংকটে দক্ষিণ কোরিয়া যদি তার মিত্রদের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারে, তাহলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এর প্রভাব পড়তে পারে। ইউক্রেনে উত্তর কোরিয়ার সম্পৃক্ততা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক সহায়তার প্রস্তাব বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করার জন্য ইউক্রেনে উত্তর কোরীয় সৈন্য মোতায়েনের পর ইউক্রেনে সরাসরি অস্ত্র সরবরাহ করতে চেয়েছিল সিউল।

 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার সময়কালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে জো বাইডেন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের ক্যাম্প ডেভিডে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই মিত্র রাষ্ট্রকে চীনের বিরুদ্ধে একটি অভিন্ন প্রতিরোধ কৌশলের আশ^াস প্রদান এবং টোকিও এবং সিউলের মধ্যে একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করা।

 

এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রচেষ্টা ছিল তাদের কূটনৈতিক ব্যবস্থাকে বিশ^ মানচিত্রে ফিরিয়ে আনা বা প্রাসঙ্গিক করা এবং মার্কিন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যয় সংকোচনের আশঙ্কা দূরীভূত করা। ২০২৪ সালের শুরুতে তিনি দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘গণতন্ত্রের সম্মেলন’ আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছিল।

 


দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের মিত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছিল মার্কিন প্রশাসন। জো বাইডেন তার ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক নীতি যেমন ক্যাম্প ডেভিডে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় জোট এবং অউকাস চুক্তির মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরে কৌশলগত ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতি এসকল অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক কিভাবে অগ্রসর হবে তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

 

দক্ষিণ কোরিয়া একটি অনিশ্চিত মিত্রে রূপান্তরিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতিতে প্রভাব ফেলবে। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে প্রভাবিত করতে পারে। এমন ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি করবে। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকলে উত্তর কোরিয়া সামরিক পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে। এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তর কোরিয়া বিদ্রƒপ করতে পারে এবং রাজনৈতিক সংকটের এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে কিম জন উন।

 

এমন সংকটময় পরিস্থিতি চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি করবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ত্রিশ হাজার মার্কিন সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বিদেশী সামরিক ঘাঁটিগুলোর মধ্যে এটি একটি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং চীনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ প্রদানের জন্য একটি কৌশলগত মিত্র রাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি চীন ও রাশিয়া সবসময়ই বিরোধিতা করে আসছিল। দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার প্রতিরক্ষা চুক্তি চীনের জন্য উদ্বেগজনক।

 

 পাঁচ বছরের বিশেষ ব্যবস্থা চুক্তিটি ২০২৬ সাল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়াকে প্রথম বছরে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের অবস্থানের খরচে তাদের অবদান ৮.৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১৪৭ কোটি ডলার করবে। চুক্তিটিকে উভয় পক্ষের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তবে চুক্তিটি হচ্ছে একটি নির্বাহী সমঝোতা। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে চুক্তিটি বাতিল করা সহজ।

 

এর কারণ, হচ্ছে এতে কংগ্রেসের অনুমোদনের কোনো প্রয়োজন নেই। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার রোধ করতে চীন সবসময় তৎপর। তাছাড়া রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হচ্ছে; যা এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত ভারসাম্যকে আরও জটিলতর করে তুলেছে।
 
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়