দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি
ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১১ মার্চ ২০২৫

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল হয়ে উঠেছে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রস্থলও এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ও চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এই অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক কৌশলের ওপর উভয় দেশের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
এই অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা মূলত দক্ষিণ চীন সাগর সংকট, তাইওয়ান সংকট, চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ (IPS) -কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। চীন তার অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে চীনের সম্প্রসারণবাদ প্রতিহত করতে চায়। ফলে এই অঞ্চল একটি সম্ভাব্য সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
দক্ষিণ চীন সাগর কৌশলগতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে আসছে। বিশেষ করে স্প্রাটলি ও প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা নিয়ে চীন, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও তাইওয়ানের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর একদিকে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ বিদ্যমান। চীন দাবি করে যে প্রায় পুরো দক্ষিণ চীন সাগর তাদের অঞ্চলভুক্ত, যা ‘নাইন ড্যাশ লাইন’ নামক একটি ঐতিহাসিক দাবির ওপর ভিত্তি করে।
তবে এই দাবির বিরোধিতা করে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও ইন্দোনেশিয়া। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক আদালত চীনের দাবিকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করলেও চীন তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ এবং সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির মাধ্যমে তার শক্তি প্রদর্শন করছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন’ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে চীনের আধিপত্য প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী এবং মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়া চীনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বার্তা দেয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও মার্কিন সমর্থনের দিকে ঝুঁকছে, তবে তারা চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়েও সচেতন।
তাইওয়ান ইস্যুটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র ভূ-রাজনীতির অন্যতম প্রধান অগ্নিগর্ভ বিষয়। তাইওয়ান চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর একটি। চীন তাইওয়ানকে তাদের ভূখণ্ডের অংশ হিসেবে দেখে এবং একীভূত করার ঘোষণা দিয়েছে, যদিও তাইওয়ান কার্যত স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের মতো পরিচালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এক চীন নীতি’ মেনে চললেও তারা তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা সহযোগী হিসেবে কাজ করছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। সম্প্রতি চীনের সামরিক মহড়া ও তাইওয়ানের চারপাশে নৌ ও বিমান শক্তির প্রদর্শন দ্বীপটির নিরাপত্তার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে যে তারা তাইওয়ানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে। এর ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
চীনের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ বা অবর (OBOR) উদ্যোগটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম প্রধান কৌশল। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অবকাঠামো নির্মাণ ও বিনিয়োগের মাধ্যমে চীনের প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ চীনের অবর প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেলেও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবরের মাধ্যমে চীন ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে, বিশেষ করে বন্দর, সড়ক ও রেল প্রকল্পে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, লাওসসহ একাধিক দেশে চীনের প্রকল্প চলছে। তবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রভাব কিছু দেশকে উদ্বিগ্ন করেছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, অবর প্রকল্পের মাধ্যমে চীন তাদের প্রতি দেশগুলোর নির্ভরশীলতা তৈরি করছে, যা কিছু ক্ষেত্রে ‘ঋণের ফাঁদ’ সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর চীনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। কারণ তারা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি এটি সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (IPS) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। চীনের ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ চালু করেছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করা। যুক্তরাষ্ট্র জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ‘কোয়াড’ (QUAD) নামে একটি কৌশলগত জোট গঠন করেছে, যা মূলত চীনবিরোধী একটি উদ্যোগ। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে। যেমন—‘ব্লু ডট নেটওয়ার্ক’ নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে, যা ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে।
তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে এবং কোনো এক পক্ষের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে পড়তে চাচ্ছে না। এই কৌশলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতা গভীর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সহায়তা করছে এবং চীনের বিরুদ্ধে একটি কৌশলগত ব্যূহ গঠনের চেষ্টা করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণের চেষ্টা করছে। আসিয়ান (ASEAN) জোট এ বিষয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে, তবে বাস্তবতা হলো প্রতিটি দেশ নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে তারা চীনের ওপর নির্ভরশীল আবার নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে ফিলিপিন্সের বিরোধ থাকলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশটি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। তবে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো পুনরায় সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত ফিলিপিন্সের যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতারই ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে ভিয়েতনাম চীনের সঙ্গে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করছে, কিন্তু সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। আবার ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া চীনের অবর প্রকল্প থেকে লাভবান হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বজায় রাখছে।
চীন-মার্কিন সম্পর্কের অন্যতম প্রধান দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শুল্ক আরোপ করেছে, যা চীনের অর্থনীতিকে কিছুটা চাপে ফেলেছে। তবে চীনের প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে দেশটি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে; যদিও ট্রাম্প চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তথাপি কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতি ক্রমেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে।
চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ও সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে চীনের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে। দক্ষিণ চীন সাগর সংকট, তাইওয়ান ইস্যু, ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল—এসব বিষয়ই দুই পরাশক্তির মধ্যে ভবিষ্যতে সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি করছে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আসিয়ান ও অন্যান্য কৌশলগত সংলাপের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক
সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়