দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের কূটনৈতিক তৎপরতা
ড. সুজিত কুমার দত্ত। সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৬ মে ২০২৫

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে মনোযোগ দিয়েছে বেইজিং। এর অংশ হিসেবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ১৪ থেকে ১৫ এপ্রিল ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া সফর এবং ১৫ থেকে ১৮ এপ্রিল কম্বোডিয়া সফর ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২৫ সালে শি চিনপিংয়ের প্রথম বিদেশ সফর হতে যাচ্ছে এটি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে চীন ১৪৫ শতাংশ মার্কিন শুল্ক আরোপের শিকার।
ট্রাম্পের রেসিপ্রোকাল শুল্কের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে চীন।
শি চিনপিংয়ের সফরের মাধ্যমে চীনকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখা হচ্ছে। চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈঠকে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত বন্ধন জোরদার করার ঘোষণা দেন চিনপিং। এখানে উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ বাণিজ্য কর্মকর্তার সঙ্গে ভিডিও বৈঠক করেছেন। টোকিও ও সিউলে নিযুক্ত চীনা কূটনীতিকরা স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রধান লক্ষ্য হলো তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা। বেইজিং মনে করে, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস করা গেলে নিজস্ব নিয়ম ও বাণিজ্য শর্তাবলি প্রতিষ্ঠা করা চীনের জন্য সহজ হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য চীন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শি চিনপিংয়ের মতো শীর্ষ নেতারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ঘন ঘন সফর করছেন, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার একটি অংশ। চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, বিশেষ করে অবকাঠামো, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তিতে। এই বিনিয়োগ এই দেশগুলোর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, একই সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াচ্ছে। চীন আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ফোরামগুলোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চীন আঞ্চলিক নিয়ম-কানুন এবং বাণিজ্য চুক্তিতে তার স্বার্থ সুরক্ষিত করতে চায়। এসব কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে চায়, যা তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা চীনের জন্য একটি জটিল বিষয়। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপের মাধ্যমে চীনের অর্থনীতিকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। এই দেশগুলো তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রেখে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়। আসিয়ান দেশগুলোর ‘খোলামেলা ও গঠনমূলক’ আলোচনার আহ্বানের মধ্যে এই মনোভাব স্পষ্ট। তারা চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশ নিতে আগ্রহী, কিন্তু একই সঙ্গে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়। এই কারণে চীনকে তার অর্থনৈতিক কৌশল এমনভাবে তৈরি করতে হচ্ছে, যা এই অঞ্চলের দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং তাদের মধ্যে কোনো প্রকার আধিপত্যের ধারণা তৈরি না করে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নে চীন বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে চীনের রপ্তানি কমে যাওয়ায় বেইজিংকে নতুন বাজার খুঁজতে হচ্ছে এবং রপ্তানি পণ্যের জন্য নতুন চাহিদা তৈরি করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই অঞ্চলে চীনের প্রধান প্রতিযোগী হলো জাপান, কোরিয়া এবং অন্যান্য উন্নত দেশ। এসব দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা চীনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে চায়। চীনকে তাদের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, যাতে এই দেশগুলো চীনের আধিপত্য মনে না করে। এই ভারসাম্য বজায় রাখা একটি জটিল বিষয়। চীনকে একই সঙ্গে তার অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে হবে এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে।
শি চিনপিংয়ের এই সফরের কিছু ইতিবাচক ফলাফল এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। ভিয়েতনামের শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব এবং থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার আলোচনার আগ্রহ চীনের প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাবের প্রমাণ। এই দেশগুলো চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবকে স্বীকার করে এবং তার সঙ্গে একটি ফলপ্রসূ সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, যা এই অঞ্চলে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে। চীনকে তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে তার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। এই দেশগুলোর আস্থা অর্জনের জন্য চীনকে তাদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে সম্মান জানাতে হবে এবং এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, যা তাদের মধ্যে আধিপত্যের ধারণা তৈরি করে। একই সঙ্গে চীনকে তার অর্থনৈতিক প্রস্তাবগুলোকে এই দেশগুলোর উন্নয়নের চাহিদা এবং অগ্রাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন তার অর্থনৈতিক কৌশল এবং সুচিন্তিত কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখতে বদ্ধপরিকর। তবে এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যযুদ্ধের মোকাবেলা করা চীনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেইজিংকে তার অর্থনৈতিক নীতিমালা এমনভাবে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে, যা শুধু চীনের নিজস্ব অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণে সহায়ক নয়, বরং এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর স্বার্থের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানানো এবং তাদের সঙ্গে পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক স্থাপন করা চীনের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশলও চীনকে অবলম্বন করতে হবে। আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে কোনো প্রকার আধিপত্যের ধারণা তৈরি হলে তা চীনের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাই চীনকে ধৈর্য, বিচক্ষণতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি টেকসই আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।