দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের চালিকাশক্তি
মোহাম্মদ আনোয়ার| সূত্র : কালবেলা, ০৩ মে ২০২৫

বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিতে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা এখন অত্যন্ত সময়োপযোগী। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ঘাটতি এবং স্থগিত থাকা জিএসপি সুবিধার আলোকে, এখন শুধু রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নয়, বরং জ্বালানিভিত্তিক কৌশলগত কূটনীতি গঠনের মধ্য দিয়েই বহুমাত্রিক অগ্রগতি সম্ভব।
২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (USTR) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ১০ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য (প্রায় ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক), যেখানে আমদানি ছিল মাত্র ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এই ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি শুধু একটি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নয়, এটি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভারসাম্যহীনতার একটি কূটনৈতিক ইঙ্গিত। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক প্রয়োজন দাঁড়াবে ৪০০০ mmcf/d, যেখানে উৎপাদন ক্ষমতা ২০০০ mmcf/d-এর নিচে। এ ঘাটতি পূরণে প্রতি বছর গড়ে ৬৫ লাখ টন এলএনজি আমদানি করতে হয়, যার ৭০ শতাংশ কাতার ও ওমান থেকে আসে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির মোট ব্যয় ছিল ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ কাতার থেকে তিন মাসের গড় ব্রেন্ট ক্রুড মূল্যের ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে এবং অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ৪০ ডলার প্রিমিয়ামে এমএমবিটিইউ প্রতি গ্যাস আমদানি করে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের গড় রপ্তানি মূল্য ছিল ৬-৮ ডলার/MMBTU, যা আমদানির ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে এবং সরবরাহ উৎসে বৈচিত্র্য আনতে পারে।
এলএনজিভিত্তিক কৌশলিক চুক্তি এখন শুধু একটি আমদানি সিদ্ধান্ত নয়, বরং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ভারসাম্য আনার একটি বাস্তব কূটনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এলএনজি রপ্তানিকারক হিসেবে, ২০২৪ সালে ৮০ মিলিয়ন টন রপ্তানি করেছে, যার ১৫ শতাংশ গিয়েছে এশিয়ার বাজারে। Indo-Pacific Economic Framework (IPEF) এবং US-Asia Clean Energy Partnership (USACEP) উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র একটি কৌশলগত জ্বালানি অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করছে। এতে বাংলাদেশের জন্য দ্বিপক্ষীয় সংলাপ ও যৌথ প্রকল্পের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে, এলপিজি খাতেও ভরসা করার মতো শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের এলপিজি চাহিদা দাঁড়াবে ১৬ লাখ টন, যার ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। গড় আমদানি মূল্য ছিল ৬৩৫ ডলার/টন আর যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি মূল্য ছিল ৪৬০ ডলার/টন। এ মূল্য ব্যবধান বাংলাদেশের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক সরবরাহ চ্যানেল তৈরি করে।
বাংলাদেশের এলপিজি বাজারের ৯৯ শতাংশ বেসরকারি খাতের নিয়ন্ত্রণে, যেখানে সরবরাহ উৎস প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য। যুক্তরাষ্ট্রের Propane ও Butane উৎপাদকরা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবেশে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর ফলে মার্কিন এলপিজি আমদানি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস ও রপ্তানি সুবিধা পুনঃস্থাপনে অবদান রাখতে পারে।
এ সম্ভাবনাকে কৌশলগত সুবিধায় রূপ দিতে এখন প্রয়োজন একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ:
প্রস্তাবিত কৌশল: এক. উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি সংলাপ চালু করা। দুই. জয়েন্টভেঞ্চার এবং পিপিপি কাঠামোয় মার্কিন বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল ও স্টোরেজ অবকাঠামো গঠন। তিন. Energy Investment Facilitation Desk প্রতিষ্ঠা। চার. Trade-Gas Offset Agreement গঠন, যেখানে নির্দিষ্ট জ্বালানি আমদানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বা বাণিজ্যিক সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
বিশ্বের উন্নত অর্থনীতিগুলো যখন জ্বালানিকে রাজনৈতিক ও কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তখন বাংলাদেশ যদি এলএনজি ও এলপিজিকে একটি ‘জিও-ইকোনমিক লিভারেজ’ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে, তবে সেটি হবে একটি যুগান্তকারী কূটনৈতিক সাফল্য। এতে একদিকে যেমন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ভারসাম্য ফিরে আসবে, অন্যদিকে দেশের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপরও স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
এখনই সময় জ্বালানি ঘাটতিকে কূটনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এ সিদ্ধান্ত কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও জ্বালানি কূটনীতিতে একটি নতুন স্তরে নিয়ে যাবে।
লেখক: প্রতিবেদক, দৈনিক কালবেলা, দুবাই