এআই ও জলবায়ু প্যারাডক্স
জিয়াউদ্দিন সাইমুম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তিকে যদি যুগোপযোগী ‘ব্যবসা’ বিবেচনা করা হয়, তাহলে সেটি ‘স্মার্ট উদ্যোগ’ বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয় ঠেকাতে যদি এআই প্রযুক্তিনির্ভর হতে হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদের সতর্কবাণী সব সময় মাথায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে রেখেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এআই প্রযুক্তি যেমন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, তেমনি এটি পৃথিবীর জন্য বিপর্যয়কারী উপাদান হিসেবেও আবির্ভূত হতে পারে।’ তার পরও পৃথিবী এখন এআই ব্যান্ডওয়াগনে চড়তে একপায়ে খাড়া।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে এআই প্রযুক্তি কি সত্যি টেকসই? জলবায়ুর বিপর্যয় রুখতে পুরো পৃথিবী এখন রীতিমতো রেসে নেমে গেছে। অথচ জলবায়ুর বিপর্যয় রোখার এই সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাঝেই লেপ্টে আছে একটি বিদ্রুপাত্মক মোচড় (ironic twist) । যাকে আমরা এআই নামে চিনি, সেটিই নাকি আমাদের ডিজিটাল রক্ষাকর্তা, যা লড়বে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রবল তৃষ্ণা রয়েছে আমাদের মেধা-মননে।
কিন্তু এই প্রযুক্তি যে হারে সুপেয় পানি আর জ্বালানি শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে চলেছে, বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এআই প্রযুক্তি মানুষের বর্বর লোভের কারণে ভুলপথেও পরিচালিত হয়ে যেতে পারে।
আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময় চ্যাটজিপিটির কথাই ভাবুন। এটি জলবায়ুর বিপর্যয় নিয়ে কবিতা লিখতে পারে অথবা কার্বন ফুটপ্রিন্ট গণনাও করতে পারে। সব প্রশ্নের উত্তর এটির জিবের ডগায় লাফায়।
অথচ যে কম্পিউটার এই প্রযুক্তিগত বুদ্ধির জোগানদাতা, সেটি ব্যবহারকারীর প্রশ্ন শুনতে শুনতে এতই কাহিল হয়ে যায় যে মাথা ঠিক রাখতে এটিকে দৈনিক বিপুল পরিমাণ সুপেয় জল পান করতে হয় (এসি চালাতে)! বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিপিটি-৩ চালাতে গেলে দৈনিক লাখো লিটার পানির অপচয় মেনে নিতেই হবে।
ওপেন এআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টমান সদ্যঃসমাপ্ত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অধিবেশনে রাখঢাক ছাড়াই উচ্চারণ করলেন, ‘এআই প্রযুক্তি বর্তমানে যে হারে জ্বালানি গিলছে, সেটি একটি মূর্তিমান সমস্যা। দুনিয়া-কাঁপানো নতুন উদ্ভাবন ছাড়া এই সমস্যার সমাধান আমাদের হাতে নেই।’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজ করে মূলত আমাদের অস্থিরমতি স্নায়ুতন্ত্রের মতোই। এটি সেন্সিং (অনুমান), প্রেডিক্টিং (পূর্বাভাস) আর হেল্পিংয়ের (সহায়তা) মাধ্যমে পরিবেশগত ঝুঁকি শনাক্ত করে আমাদের উপকারে আসে।
কিন্তু এআই সিস্টেম সচল রাখতে বিপুল পরিমাণ কম্পিউটিং পাওয়ার লাগে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জিপিটি-৩ চালাতে এক হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট-আওয়ার বিদ্যুৎ লাগে। বাংলাদেশের একটি সাধারণ পরিবার (বছরে গড়পড়তা ৬৪৩ কিলোওয়াট হারে) দুই হাজার বছরে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করবে, একটি জিপিটি-৩ কম্পিউটার চালাতে মাত্র এক ঘণ্টায় সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, ২০২৬ সালের মধ্যেই বিশ্বে বিদ্যুতের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। কারণ এআই প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
এআই প্রযুক্তির কার্বন ফুটপ্রিন্টের পরিমাণও অতি ব্যাপক। একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলের এআই কম্পিউটার একবার চালালে এটি তিন লাখ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুতে মেশে। অথচ একটি বিমান নিউইয়র্ক থেকে বেইজিং ১২৫ বার যাতায়াত করলে একই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নির্গত হবে। ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা মতে, এআই মডেলের একটি কম্পিউটার থেকে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসৃত হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি মোটরগাড়ি সারা জীবনে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে, তার সমান।
পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এআই প্রযুক্তি পিছিয়ে নেই। একটি আধুনিক এআই ডেটা সেন্টারে শুধু কুলিং খাতে দৈনিক পাঁচ লাখ গ্যালন পানি লাগে। গবেষকরা ধারণা করছেন, ২০২৭ সালে পুরো ব্রিটেনে এক বছরে যে পরিমাণ পানি ব্যয় হবে, বিশ্বের শুধু এআই সিস্টেম খাতে তার অর্ধেক পরিমাণ পানি ব্যয় হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেটে এআই মডেলের জিপিটি-৪ ভার্সন ডেটা সেন্টার চালু হয়েছে।
২০২২ সালে এলাকার একজন বাসিন্দা মামলার পর জানতে পারেন যে ওপেনআই তার একটি মডেল চালু করতেই আইওয়া রাজ্যের ৬ শতাংশ পানি একাই ব্যবহার করে ফেলেছে। ২০১২ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, বৃহদাকার এআই ট্রেনিং সেন্টারগুলোতে প্রতি ৩.৪ মাসে বিদ্যুতের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। অথচ কম্পিউটিং জগতে ‘মুরস ল’ নামে পরিচিত থিওরি মতে, প্রতি ১৮ মাসে তা দ্বিগুণ হওয়ার কথা!
এআইয়ের জন্য বিশেষ চিপ বানাতে গেলে শুধু বিশেষ ধরনের বিশুদ্ধ পানিই লাগে না, বিশেষ ধরনের ধাতুও লাগে। লাগে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এআই সিস্টেমের ব্যাটারির সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং এই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ আহরণের কারণেও এটি নিজেই পরিবেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আরেকটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
সেটি হচ্ছে বিশ্বের সব অঞ্চলে এআই সিস্টেমের পরিবেশগত মূল্য এক ধরনের নয়। সব দেশের সামর্থ্যও সমমানের নয়। তাই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের নিশ্চয়তায় অনেক দেশকে জীবাশ্ম জ্বালানির দিকেও হাত বাড়াতে হচ্ছে। বিশেষত এআই সিস্টেম খাতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচের ধারণা দেওয়া হয়েছিল, নাটকীয়ভাবে তা এখন ১০ গুণ বেড়ে গেছে। এ কারণে বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রযুক্তি নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে গবেষণা বাড়িয়েছে, যাতে স্বল্প খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গ্যারান্টি মেলে।
শুধু বিদ্যুৎ নয়, এআই সিস্টেম চালুতে পানি ব্যবহারের বিষয়টিও সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হয়। গুগল এরই মধ্যে বিশ্বের সব জলাভূমি ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে বিশেষ তাগিদ দিয়েছে। ফেসবুক তথা মেটার ডেটা সেন্টারগুলো ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পানি বাঁচাতে গিয়ে দেখতে পেয়েছে, খোদ তাদের ডেটা সেন্টারগুলোর তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। সোজা কথায়, এআই সিস্টেমের পরিবেশগত সমীকরণটি দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গার্টনার জানিয়েছে, এআই ও জেনারেটিভ এআই (জেনএআই) প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০২৭ সালের মধ্যে বিদ্যুত্শক্তির সমস্যা আরো তীব্র হতে পারে। গার্টনার বলছে, মূলত এআই-অপটিমাইজড সার্ভার বাড়ায় বিদ্যুতের যে চাহিদা বাড়ছে, তা ডেটা সেন্টারের কার্যক্ষমতা ও সম্প্রসারণের প্রচেষ্টায় প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২৭ সালের মধ্যে বিশ্বে এআইসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য বছরে মোট বিদ্যুত্শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ ৫০০ টেরাওয়াট-ঘণ্টা (টিডব্লিউএইচ) পৌঁছানোর পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
সংখ্যাটি ২০২৩ সালের ১৯৫ টেরাওয়াট-ঘণ্টার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। এর আগে ২০২২ সালে এআইসংশ্লিষ্ট কাজের জন্য মোট বিদ্যুত্শক্তি ব্যবহৃত হয় ৭৪ টেরাওয়াট-ঘণ্টা। সংস্থাটির মতে, ২০২৭ সালে বিদ্যুত্সংকটে পড়বে ৪০ শতাংশ এআই ডেটা সেন্টার। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ৪ মার্চ টেসলা কম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের মতে, এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে ২০২৫ সালে মধ্যে বিদ্যুৎ খাত ও ট্রান্সফরমারগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ সংকটের মুখে পড়তে পারে সারা বিশ্ব। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, জলবায়ু বিপর্যয় রুখতে গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনার কথা থাকলেও দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের চেয়ে বর্তমানে ৪৮ শতাংশ বেড়ে গেছে গুগলের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ।
বিবিসির মতে, সাধারণ অনলাইন কাজের চেয়ে এআই চালাতে গেলে ডেটা সেন্টারে অনেক বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়। আর এতেই পরিবেশের ওপর ধারাবাহিক চাপ বাড়ছে। গুগল প্রতিজ্ঞা করেছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষতিকারক গ্যাসের নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবে। আর এখন গুগল বলছে, ‘এখন যেহেতু আমাদের সেবায় এআই যোগ করতে হয়েছে, এই নিঃসরণ কমিয়ে আনা আর সহজসাধ্য থাকছে না।’
প্রশ্ন হতে পারে, এআই প্রযুক্তি কি বিশ্বের সব দেশের জন্য ইতিবাচক প্রমাণিত হবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগে নিশ্চিত হতে হবে, এআই সিস্টেম চালুর ব্যাপারে বিশ্বের সব সমাজের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি কি না।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, কালের কণ্ঠ