কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

এবার ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তু কি ইরান

ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ০৯ এপ্রিল ২০২৫

এবার ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তু কি ইরান

এবারের মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ আগ্রাসী মেজাজে ছিলেন, যা তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পরও অব্যাহত রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যখন দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে এমন অবস্থায় তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদ্দেশেও হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, পুতিন যদি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর না করেন তাহলে রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বাইরেও যেসব দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে তাদের ওপর তিনি অতিরিক্ত করের বোঝা আরোপ করবেন। এই ধারাবাহিকতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ইরান।

 

 ‘নরকের স্বাদ’ ভোগ করতে হবে—এ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কার্যত তিনি হামাসের সঙ্গে ইরানকেও সতর্ক করেন।

 

 

এখানে একটি বিষয় বোঝার অবকাশ রয়েছে, আর তা হলো হামাস যতই চুক্তির প্রতি মান্যতা প্রদর্শন করুক না কেন, এই অঞ্চলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল এবং অভিন্ন শত্রু একটাই, আর সেটা ইরান। হামাস-ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি যদি টেকসই হিসেবে বিরাজ করে, তার পরও ইরানের নিশানা থেকে ইসরায়েলের সুরক্ষিত থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

 

 

সম্প্রতি ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একদম দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা হামাসকে ইসরায়েলের প্রতি হামলায় নিবৃত করতে পারলেও ভবিষ্যতে ইরানের সরাসরি লক্ষ্যবস্তু থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করা বেশ দুরূহ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাই কোনো ধরনের রাখঢাক না করে এবার তিনি ইরানের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগামী দুই মাসের মধ্যে একটি চুক্তি করতে হবে, নইলে ইরানের ওপর বোমা হামলা পরিচালনা করা হবে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার মতো একই কায়দায় এটাও জানিয়ে রেখেছেন যে ইরানের সঙ্গে যেসব দেশ বাণিজ্য করবে, তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এ নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তাবকে ইরানের দিক থেকে সরাসরি নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।

 

 

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য হামলার পাল্টা এবং কড়া জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। ফলে স্বভাবতই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক তুমূল উত্তেজনা বিরাজ করছে এই মুহূর্তে।

 

 

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পক্ষ থেকে ট্রাম্পের হুমকির জবাবের পর দেশটির প্রেসিডেন্টের তরফ থেকেও একই বার্তা দিয়ে জানানো হয়েছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা না করলেও বরাবরই পরোক্ষ আলোচনার পক্ষে রয়েছে, অর্থাৎ তৃতীয় কোনো দেশের মধ্যস্থতায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনাগ্রহী নয়। এর কিছুদিন আগে ট্রাম্প তাঁর কথিত ‘নিষেধাজ্ঞা’ বিষয়টি ভেনিজুয়েলার ওপর আরোপ করেছেন। দেশটির তেল ক্রেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন তিনি।

 

 

ট্রাম্পের মনোভাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর দিক থেকে আলোচনার জন্য ইরানকে চিঠি দেওয়ার পর ইরানের তরফ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়াকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি কী করতে পারেন সেটা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা থেকে যা বের হয়ে আসছে তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে সরাসরি হামলা চালাতে পারে। আর যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে চলমান মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরো ঘনীভূত হবে। ইরানের সামরিক প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমন্বিত শক্তির তুলনায় দুর্বল। তার পরও তাদের দিক থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি এটাই ইঙ্গিত করে যে ইরান একা নয় এবং তারা নিশ্চিতভাবেই এক বা একাধিক বড় শক্তি দ্বারা সমর্থনপুষ্ট। কে বা কারা সেই বড় শক্তি, এর সহজ জবাব হচ্ছে রাশিয়া ও চীন। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া কিভাবে এবং কতটুকু ইরানের সহায়তায় এগিয়ে আসবে সেটা স্পষ্ট না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত কৌশলগত চুক্তি ইরানকে সম্ভাব্য মার্কিন হামলা থেকে রক্ষা করতে ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বছর ১৭ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত এই চুক্তির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, দুই পক্ষের যেকোনো পক্ষের ওপর আক্রমণকারীদের সরাসরি হামলার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহায়তা দানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

 

ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে পুতিনের সঙ্গে গত মাসে আলোচনা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষ একত্রে কাজ করার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত না হলে তাদের ওপর বোমাবর্ষণের বিষয়ে যে হুমকি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র জানিয়েছেন, ‘ইরানের বিরুদ্ধে হুমকি এবং আলটিমেটাম এর কোনোটাকেই আমরা উপযুক্ত মনে করি না এবং আমরা এর নিন্দা জানাই।’

 

 

গত জানুয়ারি মাসে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরের আগ্রহ প্রকাশ করা হলেও ইরানের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করা হয়। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে এসে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থানের যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির চুক্তি স্বাক্ষরের বিনিময়ে তাদের পরমাণু কর্মসূচি বাতিল করার শর্তে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলেও ২০১৭ সালে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর সুস্পষ্ট কোনো কারণ ব্যতিরেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়। এর পরের ঘটনাগুলো নতুন করে আরো তিক্ততার জন্ম দেয়, যার মধ্যে অন্যতম ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের রিপাবলিকান গার্ডের কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা এবং ইরানের ভেতরে ইসরায়েলের গুপ্তচরবৃত্তিকে উৎসাহ দানের মাধ্যমে তাদের অনেক বিজ্ঞানীকে হত্যা করা। বর্তমান সময়ে এসে ইরান যদি তার পরমাণু কর্মসূচিকে সমৃদ্ধকরণে মনোযোগী হয়ে উঠে, তাহলে এর সম্পূর্ণ দায় যুক্তরাষ্ট্রের।

 

 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তিনি সব বাস্তবতাকে অবজ্ঞা করে নিজের এবং মার্কিন কর্তৃত্বকে সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান, এমন অবস্থায় এসে যুদ্ধ বন্ধ চুক্তি না হলে শুধু রাশিয়া নয়, রাশিয়ার তেলের পর নির্ভরশীল দেশগুলোকে হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যত তিনি গোটা বিশ্বকেই হুমকি দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, গত বছর রাশিয়া থেকে তুরস্ক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের,  ভারত ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এবং ইউরোপীয় দেশগুলো ২৯ বিলিয়ন ডলারের তেল আমদানি করেছে, যার মধ্যে ভারতের জামনগরের তেল শোধনাগার থেকে পরিশোধিত তেল অনেক দেশেই রপ্তানি করা হয়েছে। যেখানে যুদ্ধকে তোয়াক্কা না করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে রাশিয়ার তেলের বাজারকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমন অবস্থায় গোটা বিশ্বকে খেপিয়ে তুলে ট্রাম্প নিজের এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কার্যত বিপর্যয় ডেকে আনছেন কি না সেটা গভীর ভাবনার বিষয়। হামাস-ইসরায়েল, রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইরান-ইসরায়েল— এসব বিষয়কে একসঙ্গে ধরে গোটা পরিস্থিতিকে বেশ জটিল করে ফেলেছেন তিনি।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়