কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

এলডিসি থেকে উত্তরণ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

মো. আকতার হোসাইন [সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১৯ আগস্ট ২০২৫]

এলডিসি থেকে উত্তরণ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

১৯৭১ সালে সর্বপ্রথম স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়েছে। এই উত্তরণের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে আরও তিনটি দেশ। যে তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশও।  ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। প্রশ্ন হলো, এলডিসি থেকে কেনই উত্তরণ হবে এবং এর সুবিধা-অসুবিধাই বা কী? বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালে এলডিসিতে যুক্ত হয়ে কিছু সুবিধা গ্রহণ করে আসছে। বিশেষত শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধাসহ নানা রকম সুবিধা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ যেহেতু দরিদ্র দেশ হিসেবে থাকছে না, তাই বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে দেশটি। এটা একটি স্বাভাবিক বিষয় এবং চ্যালেঞ্জিংও বটে। এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, এ বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর, এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যে কোনো দুটি সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদ- সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশকে মানদ- অতিক্রম করতে হলে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে ৩২ পয়েন্ট বা এর নিচে থাকতে হবে। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ বা এর বেশি পয়েন্ট পেতে হবে। মাথাপিছু আয় সূচকে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। মাথাপিছু আয় হিসাবটি জাতিসংঘ করেছে অ্যাটলাস পদ্ধতিতে। সেখানে মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করে তিন বছরের গড় হিসাব করা হয়। এর বিপরীতে বাংলাদেশের অবস্থান, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৪৯ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২.৯, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা মাত্রা ২৫ ভাগে রয়েছে।

 

 


এলডিসিতে যোগদান করা যে কোনো দেশের জন্য ঐচ্ছিক হলেও, এ থেকে উত্তরণ বাধ্যতামূলক। অতএব বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণও বাধ্যতামূলক। একদিন না একদিন বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতেই হবে। তাহলে এখনই কেন নয়, কেন আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণে পেছাতে চাই? কারণ হলো উন্নয়নশীল দেশ হলে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে অগ্রাধিকারমূলক ও শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, তা আর পাবে না। এলডিসি হিসেবে দাতা দেশগুলো থেকে যে সহজ শর্তে ঋণ পায়, তা বন্ধ হবে। প্রযুক্তি খাতে উন্নত দেশের প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের প্রদত্ত বিভিন্ন সহায়তা ও প্রণোদনা প্রদান বন্ধ হবে। ওষুধ খাতে বড় একটি প্রভাব পড়বে। এতে বাংলাদেশ ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব কেনা ছাড়াই ওষুধের ফর্মুলা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ হলে, বাংলাদেশকে প্রতিটি ওষুধ উৎপাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট ফর্মুলার মেধাস্বত্ব কিনে নিতে হবে। এর ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে বহুগুণ। এর প্রভাব পড়বে খুচরা বাজারে। এতো হলো এলডিসি থেকে উত্তরণের অসুবিধার কথা। কিন্তু শত অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষার আশায় কি মানুষ বিত্তবান হওয়া বাদ দেয়। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বীকৃতি হলো এলডিসি থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ। এছাড়াও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ উত্তরণ হলে, বাংলাদেশ হয়তো কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে, পাশাপাশি ভারত ও চীন প্রতিযোগী দেশ হিসেবে তারা কিছু সুবিধা পাবে এ কথা সত্য। তাই বলে তো স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না।

 

 


প্রতিযোগী দেশ ভারত ও চীন কি বাংলাদেশের মতো সস্তায় শ্রম দিতে পারবে। আমাদের দেশে বড় একটি সুবিধা হলো সস্তা শ্রম যা বিশ্বের আর কোনো দেশে এই সুবিধা নেই। বাংলাদেশ চাইলেই কি তার এলডিসি থেকে উত্তরণ আটকাতে পারবে? আজ যে শুল্ক সুবিধা নিয়ে কথা হচ্ছে,  তা তো ডোনাল্ড ট্রাম্প এমনিতেই বন্ধ করে দিচ্ছে। গত ১৪ আগস্ট ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত আইসিসি-বির সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। অতীতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বাহবা নিতে। বর্তমান সরকার ভঙ্গুর অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির জায়গা থেকে একটু ভালো জায়গায় নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এক কথায় এলডিসি উত্তরণের সিদ্ধাস্ত হবে আত্মঘাতী। কারণ, আমরা এখনো ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে বের হতে পারিনি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করতে ১ হাজার ২০০ আবেদন জমা পড়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৪০ শতাংশ। গ্যাসের অপর্যাপ্ততা, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ শিল্পের সক্ষমতা কমিয়ে ফেলেছে।

 

 

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই পথে চললে তা দেশের অর্থনীতির জন্য হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাই উত্তরণের সময় ৩-৫ বছর পেছানো উচিত।’ আবার বিপরীত মন্তব্যও আছে গত ২৩ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ : প্রস্তুতি ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক বৈঠকে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের গবেষণাপ্রধান ইশতিয়াক বারী বলেছেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ এ তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিছু দেশ ও অঞ্চলে বাংলাদেশের বাণিজ্যে শুল্কছাড় সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত থাকবে। আর ওষুধ উৎপাদনে মেধাস্বত্বে ছাড় সুবিধা থাকবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত। এলডিসি থেকে উত্তরণ আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। এর ফলে  আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াবে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।

 

 

লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট