কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ফিলিস্তিন ধ্বংসের প্রথম পেরেক গাজায়

কেরামত আলী। সূত্র : সময়ের আলো, ১৬ এপ্রিল ২০২৫

ফিলিস্তিন ধ্বংসের প্রথম পেরেক গাজায়
‘গাজা যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে গেলে ভালো হবে’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এরূপ হঠকারী বক্তব্যের কারণে ইসরাইল যুদ্ধবিরতি ভেঙে ১৮ মার্চ থেকে ‘এথনিক ক্লিনজিং’ বা জাতিগত বিনাশ শুরু করে। দীর্ঘ ১৫ মাস সামরিক অভিযানের পর ২ মাস বন্ধ রেখে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ভঙ্গ করে আবার বিমান হামলা শুরু করে। ৫০০ জন শিশুসহ ১৫০০ জনের বেশি মানুষ মারা যায়। ৩ হাজার ৮০০ মানুষ আহত হয়। গাজার চারদিকে শুধু আহাজারি, ধ্বংস, রক্ত ও লাশের সারি। মুসলিম বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রনায়ক একথা বলে না যে, ‘স্টপ জেনোসাইড।’ এটা দেখে মনে হচ্ছে যেন ইসরাইলিরা ফিলিস্তিন ধ্বংসের প্রথম পেরেক গাজায় বসিয়ে দিয়েছে।
 
 
 
এবার আসা যাক, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে মার্কিনপন্থি ইহুদি নেতা ডেভিন বেন গুরিন তেল আবিবকে রাজধানী করে ইসরাইল রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। পরের দিন ১৫ মে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসান ঘটে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নবঘোষিত ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু ইসরাইলকে ঘিরে রাখা ২১টি মুসলিম দেশ সেটা মেনে নিতে পারেনি। যার পরিপ্রেক্ষিতে নব্য ঘোষিত অবৈধ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরবরা যুদ্ধ ঘোষণা করে। তখন থেকে আজ অবধি আরব-ইসরাইল, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ লেগেই আছে। আর আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্ধ সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি বাহিনী তাদের সহযোগিতায় পাখির মতো ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে।
 
 
 
প্রথম যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের ১ দিন পর থেকে তাদের ভূমিদখল ১৯৪৮ সালের ১৫ মে থেকে শুরু করে যা এক বছরব্যাপী চলে। ১৯৪৯ সালের ৯ জানুয়ারি শেষ হয়। ইসরাইলের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিশে আমেরিকার সেনাবাহিনী মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক, সৌদি আরব, মরক্কো, ইয়েমেন ও সুদান মোট আটটি আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়। দ্বিতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে ১৯৫৬ সালের ২৯ অক্টোবরে। এ যুদ্ধ হয়েছিল মূলত স্যুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে। ১৯৬৪ সালে পিএলও সৃষ্টি হওয়ার পর তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বেঁধেছিল ১৯৬৭ সালের ৫ জুন। গাজা, পশ্চিম তীর, সিনাই পেনিনসুলা ও গোলান হাইটস ইসরাইলের দখলে চলে আসে। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর চতুর্থ আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধেও ইসরাইলের মিত্র আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের কারণে আরবরা পরাজিত হয়।
 
 
 
১৯৭৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইসরাইল-মিসর শান্তি চুক্তি হয় যা ইতিহাসে ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি নামে খ্যাত। ১৯৯৩ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি চুক্তি করে যাকে অসলো চুক্তি বলে। কিছুদিন স্বাভাবিকভাবে চললেও ১৯৯৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হেবরন মসজিদে রমজান মাসে নামাজরত অবস্থায় ১২৫ জন মুসুল্লিকে ইহুদিরা হত্যা করে। এর পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইলের সেনাবাহিনী আরও ১৯ জন মুসলমানকে হত্যা করে, যার তিন বছর পর ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি হেবরন চুক্তি হয়। ২০০৭ সালে হামাস ও পিএলওর গৃহযুদ্ধ বাধে নির্বাচনকেন্দ্রিক যাকে দ্য ব্যাটেল অব গাজা বলা হয়। উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো-২০১৪ সালের ৭ জুলাই ফিলিস্তিনের গাজা ও ইসরাইল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে গাজার ২১৪৩ জন সাধারণ মানুষ মারা গেলেও কোনো সৈন্য মরেনি। অন্যদিকে ইসরাইলের ৬৬ জন সেনা নিহত ও ৫০০ জন আহত হয়। আর সাধারণ কিছু নাগরিক নিহত হয়। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষ বিজয় দাবি করলেও ইসরাইলের জন্য এটা একটা বড় ধরনের ধাক্কা। 
 
 
 
২০১৮ সালে ইসরাইল জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করলে সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা তাদের স্বীকৃতি প্রদান করে ও তাদের এম্বাসিও জেরুজালেমে স্থানান্তর করে। সেদিন ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে গাজায় ৫৮ জন নিহত হয়। তারপর কিছুদিন স্বাভাবিকভাবে চললেও, ২০২১ সালের ১০ মে রমজান মাসের শেষের দিকে ঈদের কিছুদিন পূর্বে ইসরাইলি বাহিনী হঠাৎ আগ্রাসন চালিয়ে ৫০-৬০ জন মুসুল্লিকে আহত ও রক্তাক্ত করে। প্রতিশোধ হিসেবে থেকে যেসব মিসাইল মারা হচ্ছিল তা ইসরাইলের ড্রোনে কাজ করছিল না। অন্যদিকে তুরস্ক ও পাকিস্তান গোপনে জর্ডানের বিমানবন্দর ব্যবহার করে ইসরাইলে হামলার জন্য জর্ডানের সঙ্গে গোপন চুক্তি করে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফোন করলে ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এতে আল-আকসা চত্বরে ফিলিস্তিনিরা সমবেত হয়ে বিজয় উল্লাস করে।
 
 
 
ফিলিস্তিনের গাজা ও ইসরাইলের সর্বশেষ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর। হামাস ইসরাইলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে ১২১০ ইসরাইলিকে হত্যা ও ২৫১ জনকে জিম্মি করে। এর জবাবে ইসরাইল হামাসকে ধ্বংস করার জন্য সামরিক অভিযান শুরু করে। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে তাদের ৮৯১ জন সেনা নিহত হয় কিন্তু হামাসকে তারা কিছুই করতে না পেরে গাজাতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। আজ কোনো বিল্ডিং অক্ষত নেই। সবই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২৩ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে। ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর (পিসিবিএস) তথ্যমতে, ৫১ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও ১১ হাজার মানুষ। তারাও নিহত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে ল্যানসেটের তথ্য মতে, ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা ৬৪ হাজার ২৬০ জন যাতে গাজার জনসংখ্যার ২ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ মারা গেছে বলে রিপোর্টে উঠে এসেছে। গত ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ সালে এক যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে গাজা-ইসরাইল যুদ্ধের অবসান ঘটে যা ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ থেকে কার্যকর করা হয়। চুক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও মিসর। 
 
 
 
বর্তমান সারা বিশ্বে গাজার পক্ষে জনমত গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশে মিছিল-মিটিং স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ১২ এপ্রিল, ২০২৫ ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন দল ও শ্রেণিপেশার মানুষ গাজার পক্ষেক্ষ সমবেত হয়। তাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট’ বাংলাদেশের আয়োজনে মার্চ ফর গাজা কর্মসূচি পালিত হয়। এতে লাখ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে। আসলে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ ও বিরোধের মীমাংসা হবে কি না তা আমরা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারি না। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু-পরবর্তী ইসরাইলের মদদপুষ্ট ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনকে বিশ্ব মানচিত্রে আদৌ টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না তা আজ ভাবার বিষয়। ১৯৪৮ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৭৬ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাসে ফিলিস্তিন প্রায় দখলের পথে যা আগামী ১০০ বছরের মাথায় ফিলিস্তিন ভুখণ্ড থাকবে কি না তা আজ সন্দেহ দেখা দিয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নীরবতার কারণে হয়তোবা জাজিরাতুল আরব একদিন ইহুদিরা দখল করে নেবে। যেদিন মুসলমানদের আর কিছুই করার থাকবে না। কোনো সমাধানও হবে না। কিয়ামতের আলামত হিসেবে আরব উপদ্বীপে শুধুই ইহুদিদের আধিপত্য বিরাজ করবে বলে আমি মনে করি।
 
 
 
লেখক: কেরামত আলী, প্রভাষক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ), রোভারপল্লী ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর