কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ফিলিস্তিন : গাজায় মানবতার চেতনার পরীক্ষা চলছে

রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান [সূত্র : সমকাল, ১৭ আগস্ট ২০২৫]

ফিলিস্তিন : গাজায় মানবতার চেতনার পরীক্ষা চলছে

গাজায় মানবতার ট্র্যাজেডিকে শুধু একটি সংকীর্ণ ভূমিতে সীমাবদ্ধ সংঘাত হিসেবে দেখলে চলবে না; বরং একে মানবতার এমন এক গভীর বিপর্যয় হিসেবে দেখতে হবে, যা প্রতিদিন বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। ইসরায়েল মাসের পর মাস নারী, শিশু ও বয়স্কদের হত্যার নিশানা বানিয়েছে এবং ধ্বংসযজ্ঞে শহরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইবাদতের স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনীয় খাদ্য, পানীয়, স্বাস্থ্য ও বিদ্যুৎসেবা ভেঙে পড়েছে।  ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৬১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এর অধিকাংশই নারী ও শিশু। এটি কেবল যুদ্ধের সাক্ষ্যবহ নয়, নীতিগতভাবে জাতি নিধনের প্রমাণ।  

 

 

এমন ভয়ানক পরিস্থিতিতে বিশ্বের নীরবতা কিংবা তাদের দায়সারা প্রতিক্রিয়া যেমন নিপীড়নের মাত্রা বাড়াচ্ছে, তেমনি আগ্রাসন অব্যাহত রাখারও পথ করে দিচ্ছে। পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট, যেখানে তারা অন্য সংকটে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেখানে ইসরায়েলের ব্যাপারে দেখাচ্ছে নিস্পৃহ মনোভাব। এর ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা কমে আসছে, যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নীতি ও ন্যায়ের ওপর। বাস্তবতা হলো, ইউক্রেন সংকটে যে সংবেদনশীলতা ও প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে, সেই একই প্রতিক্রিয়া গাজার গণহত্যার ক্ষেত্রে দেখানো হলে আজ সেখানকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো। কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই ইসরায়েল যেভাবে আগ্রাসন ত্বরান্বিত করেছে, তা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার নীতির পরিপন্থি। গাজা সংকট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার ব্যাপারে সদিচ্ছা ও সক্ষমতা আছে কিনা, তার পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 


গাজায় নৃশংসতা বন্ধ ও মানবিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তুরস্ক দৃঢ়, অবিচল ও নীতিগত অবস্থান প্রদর্শন করেছে। আমাদের ডিজাস্টার ও ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট প্রেসিডেন্সি (এএফএডি), তার্কিশ রেড ক্রিসেন্ট ও নাগরিক সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সব ধরনের বাধা সত্ত্বেও সেখানে প্রতিবেশী ভ্রাতৃপ্রতিম দেশগুলোর মাধ্যমে খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে। আহত গাজাবাসীকে তুরস্কে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব প্রচেষ্টা যেমন জরুরি প্রয়োজন পূরণ করছে, তেমনি বিশ্বের কাছে জানান দিচ্ছে যে গাজা একা নয়। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা জাতিসংঘ ও ওআইসিতে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো অব্যাহত রাখছি। ফিলিস্তিনি গ্রুপগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

 

 

এ বছরের ২৫ জুন নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগে অনুষ্ঠিত ন্যাটো সম্মেলনে আমি গুরুত্ব দিয়ে বলেছি, ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতিকে অবশ্যই চিরশান্তির বন্দোবস্তে রূপান্তর ঘটাতে হবে। আমি সতর্ক করে বলেছিলাম, গাজাকে হারতে দেওয়া যাবে না। আমি ইসরায়েলের আগ্রাসন ও সবাইকে শাস্তি দেওয়ার নীতিকে জেনোসাইড হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলাম, যেখানে তারা আন্তর্জাতিক আইনকে অবজ্ঞা করছে। আমরা বিশেষত কাতারের সঙ্গে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো, যুদ্ধবিরতি আলোচনা ও গাজার পুনর্গঠনের ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। কাতার যেভাবে মানবিক সহায়তা পৌঁছানো ও গণহত্যা বন্ধের ব্যাপারে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে, আমরা তার মূল্যায়ন করছি।

 

 

গাজার সহিংসতা শুধু ফিলিস্তিনিদেরই হুমকিতে ফেলছে না, একই সঙ্গে এটি পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতায়ও সংকট তৈরি করছে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা বৃহত্তর সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, এর ফলে পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে আরব উপসাগর পর্যন্ত নিরাপত্তা ভারসাম্য হুমকিতে পড়বে। সংকট গভীর হলে বাস্তুহারা হওয়ার নতুন ঢেউ তৈরি হবে। এতে চরমপন্থা বাড়বে এবং জ্বালানি নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, গাজা প্রশ্নটি কেবল মানবিক বিপর্যয়ের প্রশ্ন নয়, একই সঙ্গে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও শান্তি কৌশলের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। 

 


সমাধানের পথ পরিষ্কার। অনতিবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে হবে এবং ইসরায়েলি হামলা নিঃশর্তে বন্ধ করতে হবে। খাদ্য, পানীয় ও ওষুধসামগ্রী যাতে কোনো বাধা ছাড়াই গাজায় প্রবেশ করতে পারে সেজন্য মানবিক করিডোর অবশ্যই খুলে দিতে হবে। একই সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মেকানিজম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য তুরস্ক প্রস্তুত আছে। গাজায় যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত করতে হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মাধ্যমে এবং অপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থাসহ (ইউএনআরডব্লিউএ) মানবিক সহায়তাকারী সংগঠনগুলোর টেকসই সম্পদ নিরাপদ হবে, তারা ইসরায়েলের চাপে কাজ করতে পারছে না। 

 

 

গাজার পুনর্গঠন কেবল ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিং পুনঃস্থাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়; বরং সেখানকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। এই প্রক্রিয়া জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে এবং গাজার মানুষদের সরাসরি অংশগ্রহণে সম্পন্ন করতে হবে। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিই হলো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি। দ্বিরাষ্ট্র সমাধানই এ অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি।

 

 

গাজার ঘটনাপ্রবাহে আবারও দেখা যাচ্ছে, এ যুদ্ধে সত্যবাদীদেরও নিশানা করা হচ্ছে। অসংখ্য সাংবাদিককে কেবল তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য হত্যা করা হয়েছে, তারা সংঘাতময় গাজার বাস্তবতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে আলজাজিরার সাংবাদিকদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হামলা করা হয়েছে এবং তথ্য অধিকারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। সাহসী সাংবাদিক, যারা বিশ্বের কাছে কোনো ধরনের পর্দা ছাড়া এবং নানা প্রপাগান্ডার ভিড়ে সত্য তুলে ধরার প্রচেষ্টায় ছিলেন, তাদের হত্যা বস্তুত আমাদের সবারই গভীর ক্ষতির কারণ হয়েছে। তাদের কাজ ন্যায়ের প্রতীক হয়ে থাকবে। আমি শোকাহত পরিবার, তাদের সহকর্মী ও পুরো মিডিয়া কমিউনিটির প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। 

 

 

ফিলিস্তিন ও গাজা পরিস্থিতি কোনো সীমান্তের বেড়ায় আবদ্ধ নয়; এটি মানবতার সাধারণ পরীক্ষা। বসনিয়া ও রুয়ান্ডায় যখন মানবতা বিপন্ন হচ্ছিল তখন বিশ্ব নীরব থাকার ফলে কী চরম মূল্য দিতে হয়েছে, আমরা যেন তা ভুলে না যাই। সে কারণেই তুরস্ক গাজার পক্ষে নৈতিক দায়িত্ববোধ ও কৌশলগত অবস্থান থেকে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কাতারসহ যারা মানবিক কূটনীতিতে বিশ্বাস করে–সবাই মিলে আমরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব, যাতে মর্যাদা ও ন্যায়ের সঙ্গে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। আমরা মনে করি, শান্তি অর্জন কোনো দূরের বিষয় নয়, এটি জরুরি লক্ষ্য; যা দীর্ঘদিন অপেক্ষমাণ। এই শান্তি প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টায় আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

 

 

ইতিহাস সাক্ষী, কারা এ লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে আর কারা গাজার নৃশংসতা দেখার পরও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গাজার আর সময় নেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই বিশ্ববিবেককে শুনতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা আজ যে পদক্ষেপ নেব, সে অনুযায়ীই ভবিষ্যতের মানবতা ঠিক হবে।

 

রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান: তুরস্কের প্রেসিডেন্ট; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক