ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি নৃশংসতার উৎস
রাজু আলাউদ্দিন । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

আমার লেখাটি বিদুষী বন্ধু নাদিয়া ইসলামের পুরনো একটা পোস্ট থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করব, যাতে একনজরে ইহুদি বসতি স্থাপনের আগের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপ আমরা চোখের সামনে রাখতে পারি। ‘থিওলজিকাল হিস্ট্রি অনুযায়ী, বর্তমান ইজরায়েল রাষ্ট্র এবং গাজা-স্ট্রিপ ও ওয়েস্ট ব্যাংকসহ প্যালেস্টাইনের অধীনের বর্তমান যেই অঞ্চল, তা যীশুর জন্মের ১৭০০ বছর আগে ইহুদি ধর্মের তিন নবী আব্রাহাম [বা ইব্রাহিম], আইজাক [বা ইসহাক] এবং জ্যেকোব [বা ইয়াকুব]-এর হাত ধইরা গইড়া উঠছিল সত্য। পরবর্তীতে ডেভিড [বা দাউদ] সেই প্যালেস্টাইন অঞ্চলের রাজধানী নির্ধারণ করছিলেন জেরুসালেমে। ডেভিড [বা দাউদ]-এর পুত্র সলোমন [বা সোলায়মান] সেই শহরে টেম্পোল স্থাপন করেন যীশুর জন্মের প্রায় ১০০০ বছর আগে।
সেই হিসাবে এই অঞ্চলের আদি নিবাসীরা ইহুদি—সত্য। কিন্তু জায়নিস্টরা যেই আলাপ করেন না, তা হইলো, এই অঞ্চলে ইহুদিরা ছাড়াও কেনাইট সম্প্রদায় বাস করতেন। উনারাও ঐ অঞ্চলের আদি নিবাসী। এছাড়াও উনারা আরও যা বলেন না, তা হইলো, ইহুদিগো এই অঞ্চল থিকা প্রথমে বিতারিত করেন রোমানরা।
যেই রোমানরা, সারপ্রাইজ সারপ্রাইজ, ধর্মবিশ্বাসের দিক থিকা মুসলমান না, এমনকি খ্রিশ্চানও না, বরং পেগান ছিলেন। পরবর্তীতে এই অঞ্চলে তুর্কীদের মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান আমলে যেই ইহুদিরা ততদিনে খ্রিশ্চিয়ানিটিতে কনভার্ট হন নাই, তাগো একাংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন [বা গ্রহণে বাধ্য হন]।
...ইহুদিগো প্রথম এলাকা ছাড়া করছিলেন রোমানরা, যীশুর জন্মেরও আগে। পরবর্তীতে খ্রিশ্চান এবং মুসলমানদের ক্রুসেডের সময় বাদবাকি সব ইহুদিই ঐ অঞ্চল ত্যাগ কইরা ইওরোপে মাইগ্রেট করেন।
সেই হিসাবে ইহুদিরা এই অঞ্চল নিজেগো পিতৃভূমি [বা মাতৃভূমি বা নবীভূমি] বইলা দাবী করার অধিকার রাখেন, নিশ্চয়ই।’
নাদিয়াসহ আরো অনেকেই এই ইতিহাসের কথা জানেন। আমরা এখান থেকেই প্রশ্নটা শুরু করব। ওই অঞ্চলে ইহুদিদের আগেই অন্য অনেক জাতি ছিল, যারা কেনাইট হিসেবে পরিচিত। যদি আদিবাসের অধিকার থেকে ইহুদিপূর্ব জাতিসমূহ এই অঞ্চলে ফিরে আসতে চায়, তাহলে ইহুদিদের আগে কেনাইটদের (Canaanites) অধিকারই বেশি।
আমরা তাহলে কেনাইটদের কথা বলছি না কেন? কারণ কেনাইটরা ইহুদিদের মতো ওই হাস্যকর দাবি করছে না বলে? কেন ‘হাস্যকর’ বললাম, তার ব্যাখ্যা আমি একটু পরে দিচ্ছি। ইহুদিরা আরো বলে থাকে যে ওই অঞ্চলটি প্রমিজড ল্যান্ড, ঈশ্বর ওল্ড টেস্টামেন্টে ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই অঞ্চলে বসবাসের। তাদের ঈশ্বর যদি, গোটা মানবজাতির ব্যাপারে চিন্তা না করে, একটি গোত্রেরই ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি ঈশ্বরই নন, তিনি বড়জোর এক গোত্রপতি হতে পারেন। ঈশ্বরের পক্ষে এত ছোট হওয়া কী করে সম্ভব! তারা এক পৌরাণিক দাবিকে ইতিহাস হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা করে থাকে, তা অন্য কোনো ধর্মের ইতিহাসেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য কোনো ধর্মই নিজের সম্প্রদায়কে নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় বসবাসের প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ইহুদি ছাড়া অন্য যে দুটি সেমেটিক ধর্ম আছে—খ্রিস্ট ও ইসলাম—তাদের ধর্মে কেন ও রকম কোনো প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হলো না? দুঃখজনক হলেও সত্য যে পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর ঈশ্বরকেই এ রকম অদ্ভুত কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা যায়নি। তার পরও যদি ধরেও নিই যে তাদের ঈশ্বর সত্যি সত্যি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবে—এই ঈশ্বর কেন ইহুদি-পূর্ববর্তী ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের অধিকারের কথা ভাবেননি? এতটা স্বার্থপর ন্যায়বোধহীন সত্তা কী করে ঈশ্বরের মর্যাদা পেতে পারে?
এবার সরাসরি ওই প্রশ্নটিতে আমরা ফিরে যাব, যেখানে ঈশ্বর তাদের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
মানুষের ইতিহাস হচ্ছে ক্রমাগত স্থানান্তরের (Migration) ইতিহাস। ক্লদ লেভি-স্ত্রাসের মৌলিক গবেষণা আমাদের এই বিশ্বাসকে আরো বেশি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করায়। অক্তাবিও পাস ফরাসি এই গবেষকের সূত্র ধরে বলেছেন : ‘Tristes Tropiquezs এবং অন্যান্য রচনায় তিনি এশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং এমন একটি ধারণার দিকে ঝুঁকেছেন, যা গবেষকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়—আমেরিকান, চীনা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সভ্যতার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো আসলে সন্দেহাতীত সাদৃশ্য উভয় মহাদেশের মধ্যে অভিবাসন এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ফলাফল ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।’ (Claude Levi-Strauss: An Introduction, Octavio Paz, A Delta Book, September 1978, P 44-45) প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকেই মানুষ ছিল ভ্রাম্যমাণ। খাদ্যসংকট, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে তাকে প্রতিনিয়ত এক জায়গা থেকে অরেক জায়গায় ছুটতে হয়েছে। এই প্রাকৃতিক কারণের কথা যদি বাদও দিই, তাহলেও ইহুদিদের ফিলিস্তিন অঞ্চলে বসতি এবং পরে ধীরে ধীরে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো দখল করার কোনোই যৌক্তিক ও ইতিহাসসম্মত কারণ নেই।
এমন নয় যে শুধু ইহুদিরা ফিলিস্তিন থেকে রোমানদের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছে। নানা সময়ে রাজনৈতিক কারণে প্রতিটি জাতিই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বাধ্য হয়েছে। মানবসভ্যতার সূচনাকাল থেকে রাজনৈতিক কারণে কোনো কোনো জাতি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। যখন সে আগের জায়গাটা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়, তখন আগের জায়গাটির ওপর তার আর অধিকার থাকে না। যদি ধরেও নিই যে ইহুদিদের জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাহলেও সেই আগের জায়গাটিতে শত শত বছরের ব্যবধানে অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো সুযোগ তার থাকে না। অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন সেখানে থেকে লড়াই করবে। ইহুদিরা সেই লড়াইটি কখনোই করেনি। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে নিরস্ত্র ও সামরিক শক্তিতে দুর্বল হওয়ার কারণে তারা লড়াই করতে পারেনি, তাহলে এই প্রশ্নও তো তৈরি হবে, তারা কেন নিকটতম সময়ে সংগঠিত হয়ে সামরিক শক্তি সঞ্চয় করে হারানো জায়গাটি পুনরুদ্ধার করেনি? তারা যদি বলে যে কয়েক শ বছর পরই তাদের কাছে ‘নিকটতম’ সময়, তাহলে এরই মধ্যে যারা বসতি স্থাপন করে বংশানুক্রমে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে, তাদের কোথায় স্থানান্তর করা হবে? তাদের উচ্ছেদ করার নৈতিক অধিকারই বা তাদের কে দিয়েছে?
এবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়—তারা বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই দেশগুলোতে তারা শত শত বছর থেকেছে। ঠিক যেমনভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে পার্শ্ববর্তী ও দূরবর্তী দেশগুলো থেকে বিদেশি জনগোষ্ঠী এসেছিল এবং এখানে তারা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে ভারতীয় সভ্যতাকে বহুজাতি ও বহুসংস্কৃতির এক ঋদ্ধ সভ্যতায় রূপান্তর করেছে। তারা কেউ আর উৎসভূমিতে ফিরে যায়নি কিংবা উৎসভূমির দাবিও জানায়নি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ইতিহাসও আমাদের এই বার্তাই দেয়। ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, রোমানদের দ্বারা অধিকৃত হওয়ার আগে লৌহ যুগে সেল্টিকভাষী ব্রাইটনরা, একসময় স্যাক্সনরা, ডেনমার্কের জুটল্যান্ড পেনিনসুলা থেকে আগত জুটরা (Jutes) ইংল্যান্ডে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল ঠিকই, শত শত বছর সেখানে বাস করার পরও সেই দেশকে তাদের নিজেদের দেশ বলে মনে হলো না! কেন মনে হলো না? পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি, অসংখ্য ধর্মসম্প্রদায় আছে, তাদের কেউই শত শত বছর আগে ছেড়ে আসা উৎসভূমিতে ফেরত যেতে চায়নি।
ইহুদিরাই একমাত্র জাতি ও ধর্মগোষ্ঠী, যারা পৃথিবীর অন্য কোথাও নয়, ঠিক সেই জায়গাটিতে তারা ফিরে যেতে চাইল, যেখান থেকে খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে খ্রিস্টোত্তর বিভিন্ন সময়ে তারা বিতাড়িত হয়েছিল। ইসরায়েল ভূখণ্ডে বসবাসের এই ধারণা ও দাবিটা স্রেফ ধর্মীয় গোঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের আকাঙ্ক্ষা ও আচরণ মানবজাতির স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতির ঠিক বিপরীত। ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র গঠনটিও পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। ইংরেজ ও জায়নবাদীদের ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে তারা চোরের মতো, প্রতারকের মতো, ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দেশগুলোর মতো ইসরায়েল ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করতে শুরু করেছে। প্রতিটি জাতি তার নিজের ভূখণ্ড রক্ষা করেছে বা স্বাধীন করেছে ন্যায়সংগত অধিকারের ভিত্তিতে। জায়নবাদীরা সেই ন্যায়বোধের কোনো তোয়াক্কাই করেনি। উল্টো তারা শত শত বছর ধরে বসবাসরত অধিবাসীদের ভূখণ্ড সামরিক শক্তির বলে শুধু দখলই করছে না, তারা গণহত্যা চালাচ্ছে। একসময় ইউরোপে তারা যে অন্যায় নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছিল, আজ তারা নিজেরাই তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে, অনেক বেশি সংগঠিত রূপে এবং অনেক বেশি সামরিক দক্ষতায় ফিলিস্তিনিদের উত্খাত ও হত্যা করছে। যদিও পৃথিবীর নানা দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের এই আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবীর বেশির ভাগ রাষ্ট্রই তাদের এই আচরণে নির্বিকার। ইহুদি জনগোষ্ঠী যখন জার্মানদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছিল, তখন জার্মানির বিরুদ্ধে বহু রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু আজকে যখন ইহুদি রাষ্ট্র দ্বারা ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হচ্ছে, তখন তাদের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ভূমিকায় নেই।
তারা আজ এতই উদ্ধত যে পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রকেই তারা তোয়াক্কা করে না। না করার কারণ পৃথিবীর রাষ্ট্রপ্রধানদের প্রায় সবাই নৈতিকভাবে যেমন দেউলিয়া, তেমনি তারা ইসরায়েলিদের আর্থিক বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। এরই মধ্যে ৫১ হাজার ফিলিস্তিনি হত্যা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অসংখ্য শিশু ও নারী আছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আক্রমণ থেকে গাজার চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোও রেহাই পায়নি, এমনকি তারা ১৫ জন রেড ক্রস কর্মীকেও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে হত্যা করেছে। আমেরিকাসহ ইউরোপীয় বেশির ভাগ রাষ্ট্রই ইসরায়েলের এই নির্বিচার গণহত্যাকে নীরবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয় পরারাষ্ট্রনীতির অনৈতিকতা নতুন নয়, তারা যখন জায়নবাদীদের দাবির প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের জন্য বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করেছিল, তারা তখন ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের কথা ভাবেনি। জায়নবাদীরাই একমাত্র সম্প্রদায়, যারা ধর্মীয় প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করেছে, যার উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি। যে ধর্মের ভিত্তিতে তাদের এই রাষ্ট্র গঠন এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতা আজকে দেখা যাচ্ছে, তার উৎস তাদের সেই ধর্মেই নিহিত। মুসা নবী মৃত্যুর আগে তোরাহ-এর পঞ্চম খণ্ড ডিউটিরহনমিতে (Deuteronomy) অনুসারীদের উদ্দেশে বেশ কিছু নির্দেশ দিয়ে যান, যার মধ্যে কয়েকটিতে পাওয়া যাবে তাদের সাম্প্রতিক এই নিষ্ঠুর আচরণের বীজ :
“যদি কোনো নবী এসে অলৌকিক ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করে, এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়ে যায়, এবং সে যা বলেছে তা সত্য হয়, এবং সে তোমাকে বলে : ‘এসো, আমরা অদ্ভুত দেবতাদের অনুসরণ করি...’ তাহলে তাকে অবিলম্বে হত্যা করো। তোমার পর বাকি সবাই যেন তাকে আঘাত করে। যখন প্রভু অন্য জাতিকে তোমার হাতে সমর্পণ করবে, তখন একজনকেও রেহাই না দিয়ে তাদের সবাইকে হত্যা করো এবং কারো প্রতি দয়া কোরো না।” (Philosophical Dictionary, Voltaire, Penguin Books, 1972,P 25)
যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় ১৩০০ বছর আগে মুসা নবী যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, জায়নবাদীরা সেই নির্দেশ আজ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করছে। তারা সহাবস্থানে নয়, অন্য জাতিকে নির্মূলে বিশ্বাসী। একটি জাতির মনোগঠন ও বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে কিছুটা ধর্মীয় রচনা আর সে জাতির সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের বাণী ও রচনার যৌথ প্রণোদনায়। স্লাভয় জিজেক তাঁর The Poetic Torture@House of Language নামক এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে জাতীয়তাবাদী কবিতা অন্য জাতিগোষ্ঠী নির্মূলে ভূমিকা পালন করে :
“প্লেটোর খ্যাতি সংকটে পড়ে যায় যখন তিনি বলেন, কবিদের শহর থেকে বের করে দেওয়া উচিত। কবিদের বিপজ্জনক স্বপ্নের দ্বারা যেখানে জাতিগত নির্মূলকরণ প্রস্তুত হয়েছে, সেই যুগোস্লাভিয়ার পরবর্তী অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করলে প্লেটোর এই পরামর্শকে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়েছে। এটা সত্য যে স্লোবোদান মিলোসেভিচ জাতীয়তাবাদী আবেগকে ‘উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ব্যবহার’ করেছিলেন, কিন্তু কবিরাই তাঁকে সেই জিনিসগুলো সরবরাহ করেছে, যা তাঁকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে ব্যবহারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।” (Poetry [Magazine], March 2014) আজকে নেতানিয়াহু যা করছেন, তা আকস্মিক মনে হলেও এর বীজ রয়েছে তাদের ধর্মীয় বাণীগুলোর মধ্যে।
ইহুদিবাদীরা ইতিহাসের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে এমন এক জাতির সঙ্গে, যারা তাদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় তো করেইনি, বরং সহিষ্ণুতা ও ঔদার্যের সঙ্গেই তাদের জায়গা করে দিয়েছিল। তারা বুঝতে পারেনি যে ইহুদিরা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে এমন এক উপনিবেশ গড়ার দিকে, যেখান থেকে একসময় ফিলিস্তিনিদেরই উচ্ছেদের পরিকল্পনায় মেতে উঠবে। ইহুদিদের যদি প্রতিশোধ নিতেই হতো, তাহলে সেটা নেওয়া উচিত ছিল সেইসব ইউরোপীয় জাতির বিরুদ্ধে, যারা তাদের অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেছে এবং নির্যাতন করেছে। কিন্তু ইতিহাসের করুণ বাস্তবতা হচ্ছে এই যে সবল সব সময়ই দুর্বলের ওপরই নির্যাতন চালায়।