ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার ক্ষমতা কারও নেই
ফরহানা করিম চৌধুরী । সূত্র : সময়ের আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রোববার নেটজারিম করিডোর থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার পরে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের এলাকায় ফিরে আসতে শুরু করে। তারা তাদের বাড়িঘরের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখার সময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। প্রসঙ্গত, নেটজারিম করিডোর উত্তর গাজাকে দক্ষিণ থেকে আলাদা করেছে।
গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। সূত্রটি বলেছে, গাজা সিটির পূর্বদিকে ইসরাইলি বাহিনী রোববার ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলি চালিয়েছে। এরপর তিনজনের মরদেহ শহরের ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাজা সিটির পূর্বদিকে অবস্থানরত ইসরাইলি বাহিনী বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এই ফিলিস্তিনিরা কুয়েত গোলচত্বরের কাছে তাদের নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার সময় এ হামলার ঘটনা ঘটেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, রোববার নেটজারিম করিডোর থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার পরে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের এলাকায় ফিরে আসতে শুরু করে। তারা তাদের বাড়িঘরের অবস্থা পরীক্ষা করে দেখার সময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। প্রসঙ্গত, নেটজারিম করিডোর উত্তর গাজাকে দক্ষিণ থেকে আলাদা করেছে। এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রটি জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের পূর্বে আল-কারারা এলাকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গুলিতে একজন বয়স্ক ফিলিস্তিনি নারীও নিহত হয়েছেন। ইসরাইলি সেনাবাহিনী গুলি চালানোর খবরটি নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গাজা সিটির পূর্বাঞ্চলে নাহাল ওজের কাছে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর অবস্থানের দিকে ফিলিস্তিনিরা এগিয়ে আসছে সন্দেহ করে গুলি চালানো হয়।
১৯ জানুয়ারি থেকে গাজা উপত্যকায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়েছে। এরই মধ্যে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় নতুন করে ফিলিস্তিনি নিহত হলো। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে চলমান গাজা যুদ্ধে অন্তত ৪৮ হাজার ২০০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখের বেশি আহত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। ইসরাইলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) ইতামার বেন-গভির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গাজা নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই নীতির কারণে ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্যের ‘হাসির পাত্র’ হয়ে উঠেছে। আনাদোলু নিউজ এজেন্সির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। রোববার স্থানীয় রেডিও স্টেশন কল বারামাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বেন-গভির গাজায় যুদ্ধ পরিচালনায় সরকারের ভূমিকার ব্যাপক সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যের হাসির খোরাক হয়ে গেছি। তবে আমি নিশ্চিত নই, আমরা এখনও তা বুঝতে পারছি কি না।’
কট্টর ডানপন্থি এই রাজনীতিবিদ দাবি করেন, তিনি সরকারের একমাত্র ব্যক্তি যিনি গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিরোধিতা করেছিলেন। তার মতে, তার অবস্থান পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে বদলে দিতে পারত। নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের প্রতি নতিস্বীকার করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আপনি শুধু বাহ্যিক চাপের ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করতে পারেন না।’
বেন-গভিরের মতে, ইসরাইলের কখনোই গাজায় জ্বালানি ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়া উচিত হয়নি, কারণ এটি হামাসের স্বার্থে কাজ করে। তিনি গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বেচ্ছা অভিবাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নেরও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের আজই এ বিষয়ে উদ্যোগ শুরু করা উচিত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন সময় আছে কিন্তু ইসরাইলের স্বার্থে আমাদের আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।’
বেন-গভির স্পষ্ট করে বলেন, যতদিন না হামাসকে ধ্বংস করা হচ্ছে, ততদিন তিনি সরকারের অংশ হবেন না। গত জানুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তির বিরোধিতা করে তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করেন। তখন থেকেই তিনি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের স্বেচ্ছা অভিবাসনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। গত মঙ্গলবার তার ওটজমা ইয়েহুদিত পার্টি নেসেটে একটি বিল জমা দেয়, যেখানে গাজা বাসিন্দাদের স্বেচ্ছায় দেশত্যাগে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এদিকে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের হুমকির মুখে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস এক প্রতীকী বার্তা দিয়েছে। গাজার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহতে ইসরাইলি বন্দিদের হস্তান্তরের মঞ্চে একটি বিশাল ব্যানারে লেখা হয়, ‘আমরা বন্যা... আমরাই আগামীকাল’। হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডের উত্তোলিত এই ব্যানারে আরবি, হিব্রু ও ইংরেজি ভাষায় এই বার্তা লেখা ছিল। এর সঙ্গে ছিল একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত ও ফিলিস্তিনি পতাকা।
ইসরাইলি গণমাধ্যমে হামাস নেতাদের গাজা থেকে অন্যত্র নির্বাসনের খবর প্রকাশের পরপরই হামাসের এই বার্তা আসে। ইসরাইল গত ১৫ মাস ধরে গাজায় হামাসকে নির্মূল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হামাসের এই বার্তা ইসরাইলের হামলা সত্ত্বেও তাদের অবিচল প্রতিরোধের ইঙ্গিত বহন করে। এই বার্তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজার ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র সরিয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরিকল্পনার প্রসঙ্গে আলোচনার সময়ও প্রকাশিত হলো।
৮ ফেব্রুয়ারি শনিবার দেইর আল বালাহতে বন্দি বিনিময় অনুষ্ঠানে শতাধিক কাসাম ব্রিগেড সদস্য উপস্থিত ছিলেন। বন্দিবিনিময়ের পঞ্চম ধাপে হামাস তিনজন ইসরাইলি বন্দিকে রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর করে। বিনিময়ে ইসরাইল ১৮৩ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেবে, যাদের মধ্যে ১৮ জন যাবজ্জীবন এবং ৫৪ জন দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত। নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলাও করা হয়েছে। হামাস ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় শনিবার আরও তিন ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে। একই দিন ইসরাইলের কারাগার থেকে ১৮৩ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
শনিবার হামাস যোদ্ধারা গাজার দেইর আল-বালাহ শহরে ইসরাইলি জিম্মি অর লেভি, ইলিয়াহু শারাবি এবং ওহাদ বেন এমিকে রেড ক্রসের প্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলুর একজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিদের মধ্যে একজন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সামরিক ইউনিফর্মে উপস্থিত হয়েছিল এবং অন্য দুজন বাদামি পোশাক পরেছিল। রেড ক্রসের প্রতিনিধিরা নথিতে স্বাক্ষর করে জিম্মিদের গ্রহণ করে এবং তাদের ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে যে তারা রেডক্রসের কাছ থেকে হামাসের মুক্তি দেওয়া তিন জিম্মিকে পেয়েছে। প্রাথমিক মেডিকেল চেকআপের জন্য তাদের গাজা থেকে সীমান্তের কাছে একটি সামরিক স্থাপনায় স্থানান্তর করা হয়েছে।
হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, হস্তান্তর প্রক্রিয়ার দুর্দান্ত দৃশ্য ও প্রতিরোধের বার্তাগুলো নিশ্চিত করে যে আমাদের জনগণ এবং তাদের প্রতিরোধ উন্নত থাকবে। আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাস্তুচ্যুতি ও দখলের সব প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করেছে। পাশাপাশি এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তিন জিম্মির মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তিনি জানিয়েছেন, বন্দিদের অবস্থা দেখে তিনি মর্মাহত। শিগগিরই তিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। এদিকে চলমান গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে তিন ইসরাইলি জিম্মির বিনিময়ে শনিবার ১৮৩ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইল। এদের মধ্যে ১৮ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাদের এই শাস্তি দিয়েছিল ইসরাইলি আদালত।
সর্বশেষ খবর হচ্ছে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান জোর দিয়ে বলেছেন, গাজা, পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেম ফিলিস্তিনিদেরই। কোনো শক্তিরই ফিলিস্তিনিদের গাজাবাসীসহ, চিরস্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করার ক্ষমতা নেই। ৯ ফেব্রুয়ারি রোববার ইস্তানবুলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। মার্কিন প্রশাসনের গাজা সংক্রান্ত প্রস্তাবের তীব্র সমালোচনা করে এরদোগান বলেন, ইহুদিবাদী শাসনের চাপেই এ প্রস্তাব এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের প্রস্তাব আলোচনার যোগ্য নয়।
তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন, হাজার বছরের মাতৃভূমি থেকে গাজাবাসীদের উচ্ছেদ করার ক্ষমতা কারও নেই। এরদোগান হামাসের বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়ার প্রশংসা করে বলেন, ইসরাইলি বাধা সত্ত্বেও হামাস প্রতিশ্রুতি পালন করছে। সিরিয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানে গণকবরের সন্ধান পাওয়ায় আসাদ সরকারের রক্তাক্ত চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বে সিরিয়ায় শান্তি ফিরবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সিরিয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কোনো স্থান নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।