কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য জরুরি

মাহফুজ সাদি [সূত্র : আমারে দেশ, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫]

ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য জরুরি

দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা জুলাই বিপ্লবের সপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ও মিত্রদের মধ্যকার বিবাদের সুযোগ নিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, জুলাই বিপ্লবীদের বিবাদের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করছে ফ্যাসিবাদীরা। এ ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিদের ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান তারা।

 

 

জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টায় ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে নতুন করে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা বলেন, সামনের দিনগুলোতে সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীসহ আরো অনেকের ওপর হামলা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটতে পারে। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা পতিত স্বৈরাচার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করতে পারে। তারা জুলাই বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিয়ে দেশে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে।

 

 

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ আমার দেশকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় নির্বাচন বানচালের একটি ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। এজন্য তিনি ভারত ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন।

 

 

অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি রাজনীতিকদেরঅপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি রাজনীতিকদের
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরের দিনই এ ধরনের ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলা স্পষ্টত নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্রের অংশ। শুধু ওসমান হাদি নয়, আরো অনেক প্রার্থীর ওপরও আক্রমণ হতে পারে। এটা ভারত থেকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে হটানোর পর আন্দোলনের পক্ষে শক্তিগুলো তাদের ঐক্য ধরে রাখতে না পারায় আজকের ঘটনা ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।

 

 

ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কমন শত্রু—আওয়ামী লীগ ও তার পৃষ্ঠপোষক ভারতের বিরুদ্ধে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখেছি, সফল আন্দোলনের পর সেটি আর দেখা যায়নি। বরং তারা বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ না থেকে নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ বিবাদে লিপ্ত হয়েছে। এ সুযোগে ওই কমন শত্রুরা নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছে।

 

 

ওসমান হাদির ওপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এটা বিএনপি করেছে বা মির্জা আব্বাস করেছে। কিন্তু এরকমভাবে চিন্তা করাটা ঠিক হবে না। কারণ নির্বাচন নষ্ট হয়ে গেলে এটা তাদের বৃহত্তর কোনো লাভ হবে না। এখানে বিবেচনা করতে হবে, কারা লাভবান হচ্ছে।

 

 

তিনি আরো বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কিন্তু লাভবান হবে আওয়ামী লীগই। এরকম হলে তাদের দেশের ভেতর ঢোকার সুযোগটা তৈরি হবে। কাজেই এখানে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সবার উচিত হবে একে অপরের ওপর দোষারোপ না করে অভিন্ন শত্রুর ওপর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা।

 

 

ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ঘটনা যেটা ঘটেছে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে দেখুক। এই ঘটনার সাথে সত্যিকারে কারা জড়িত এবং তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব কি না। চিহ্নিত করা গেলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

 

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হকও একই মন্তব্য করেন। জুলাই আন্দোলনের পরাজিত শক্তি ও ষড়যন্ত্রকারীরা জুলাই আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতা হামলা করে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে বিভেদ থাকলে শত্রুরা ষড়যন্ত্র করে সুবিধা নেবে এটাই স্বাভাবিক। ওসমান হাদির ওপর হামলা এ ধরনের ষড়যন্ত্রের অংশ হলে সেটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না।

 

 

ড. সাহাবুল হক বলেন, এটা স্পষ্ট যে জুলাই আন্দোলনের পক্ষের শক্তিগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়েছে। নিজেদের সম্পর্ক নষ্ট করেছে, একে অপর থেকে দূরে সরে গেছে। বিভিন্ন স্বার্থের সংঘাত তৈরি হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি বড় ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। যে স্পিরিট নিয়ে জুলাইয়ের পক্ষের শক্তিরা এক হয়েছিল এবং ৩৬ দিনের রাজপথ কাঁপানো আন্দোলনের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল—সেই স্পিরিট এখন অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। পক্ষান্তরে জুলাই আন্দোলনের শত্রুপক্ষকে বিভিন্নভাবে সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে।

 

 

তিনি বলেন, জুলাই শক্তিগুলোর উপলব্ধি করা উচিত ছিল যে ঐক্য মানেই শক্তি আর অনৈক্য মানেই দুর্বলতা। জুলাই শক্তির এ অনৈক্যের সুযোগ নিয়েছে জুলাইবিরোধী শক্তি এবং তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়েছে শত্রুপক্ষের কিছু মিত্র রাজনৈতিক দলও।

 

 

নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় জুলাইপন্থী শক্তির ঐক্যের বিকল্প নেই উল্লেখ করে এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরো বলেন, এ মুহূর্তেই বিষয়টি যদি তারা উপলব্ধি না করে, তবে এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য জাতির জন্য আর হবে না। তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শত্রুপক্ষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। দেশে এক অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাবে।

 

 

নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ এসেছিল, তা ভেস্তে যেতে বসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এখনো সময় ও সুযোগ আছে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর। দেশ ও জাতির স্বার্থে জুলাই আন্দোলনের পক্ষের শক্তিগুলো ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেদের মধ্যে যদি ঐক্য গড়ে তুলতে পারে।

 

 

এদিকে ওসমান হাদির ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলেছে, এখন গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর একে অপরকে দোষারোপ করে রাজনৈতিক লাভ তোলার সময় নয়। এখন সময় প্রকৃত অপরাধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি আনার। গণঅভ্যুত্থানের শক্তি যদি বিভক্ত হয়, তাহলে সুযোগ নেবে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও দেশবিরোধী চক্র, যারা অতীতেও হত্যা ও সহিংসতার মাধ্যমে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে।

 

 

এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে যার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী লীগ জুলাই মক্তির বিরুদ্ধে, জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছে। তারা জঙ্গি-সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে। তারা এখনো সক্রিয় রয়েছে এবং দেশ অস্থিতিশীল করতে সহিংতার চেষ্টা করছে। অবিলম্বে আওয়ামী লীগের এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা না করে, তবে তারা আবারও গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং দেশকে সহিংস অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে।

 

 

হাদিকে গুলি আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের মতো গভীর ষড়যন্ত্র, নেপথ্যে আ.লীগ-ভারতহাদিকে গুলি আরেকটি ওয়ান-ইলেভেনের মতো গভীর ষড়যন্ত্র, নেপথ্যে আ.লীগ-ভারত
আসন্ন সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নাশকতা, দেশ অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে বলে তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জুলাই শক্তির ওপর হামলা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, প্রার্থীদের ওপর আক্রমণসহ বিভিন্ন পন্থায় দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তার করছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সে পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তার প্রমাণ হাদিসহ জুলাই শক্তির ওপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণ।

 

 

 

জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের ওপর বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপরও বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত হয়েছে। সম্প্রতি এই ধরনের ঘটনা বেড়েছে। তফসিলের দুদিন আগে মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জে এনসিপির তিন কর্মীকে ছুরিকাঘাত করা হয়। কাছাকাছি সময়ে রাজশাহীতে এনসিপির জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক নাহিদুল ইসলাম সাজুর ওপর হামলা হয়েছে।

 

 

 

এর আগে গত জুলাইয়ে গোপালগঞ্জে এনসিপির শীর্ষনেতাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষনেতার নির্দেশে পূর্ব ঘোষণা দিয়েই ওই হামলা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের জড়িত থাকার বিষয়ে পরবর্তী সময়ে অনেকগুলো অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে আগুন দেওয়া, বোমাবাজির পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়।