গাছ ও জলাভূমি সুরক্ষায় সবুজ সংহতি
মো. অহিদুর রহমান । সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫

আমি কাগজে লিখি, বই পড়ি, বাড়ি তৈরি করি, ঘরে সুন্দর আসবাবপত্র রাখি, পাখির গান শুনি, অক্সিজেন গ্রহণ করি, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি সবই সম্ভব হচ্ছে এ বন, গাছ ও জলাভূমির কারণে। যে নগরের শিশু ঘুম ভেঙে আকাশ দেখতে পায় না, বৃষ্টিতে ভিজতে পারে না, খালি পায়ে ঘাসে হাঁটতে পারে না, সবুজায়ন দেখে না, পাখির ডাক শুনতে পারে না, ঝিরিঝিরি বাতাসে খিলখিল করে হাসতে পারে না, মাছের সঙ্গে সাঁতার কাটতে পারে না, গাছের ফুল ফল ফোটা দেখে না, পোষা প্রাণীর সঙ্গে খেলা করতে পারে না; সে সৃজনশীল, বিবেকবান, ন্যায়, সৎ, সাহসী ও আবেগপ্রবণ হবে না, বৈচিত্র্যময় হবে না, হতে পারে না।
পান্থকুঞ্জ পার্ক, হাতিরঝিল জলাভূমি ধ্বংস করে কিসের উন্নয়ন? এগুলো রক্ষা করে আমাদের সব উন্নয়নের চিন্তা করতে হবে। তাই যুব-শিক্ষক-লেখক-গবেষক-সাংবাদিক-শিক্ষার্থী-উন্নয়নকর্মীসহ সাধারণ জনগোষ্ঠী আজ এ গাছ ও জলাভূমি রক্ষায় সবুজ সংহতির ডাক দিয়েছে। একটি গাছ অনেক জীবন। আমাদের বট, পাকুড়, ডুমুর, আম, জাম, শিমুল, পলাশ, হিজল, ছাতিম, কদম, শাল, তাল, তেঁতুল, জারুর, গাব, বরুণ, করচ, নিম, কাঁঠালসহ অনেক দেশি ফল ও ফুলের গাছ আজ বিলুপ্তির পথে। নগরে গাছ নেই, সবুজ নেই, মাটি কমে যাচ্ছে, জলাভূমি-পুকুর-খাল-ঝিল সবই ভরাট করে ইটপাথরের দালান তৈরি করা হয়েছে। বাড়ছে পাকা রাস্তা, দালান। পানি শোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। তাই নগর হয়ে ওঠে উত্তপ্ত।
ঢাকা শহরে গাছ এবং জলাভূমি না থাকলে পরিবেশে বিপর্যয় নেমে আসবে। গাছ না থাকলে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করবে, কারণ গাছ কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ এবং অক্সিজেন সরবরাহ করে। এ ছাড়া তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারাবে শহর, ফলে তাপদ্বীপ প্রভাব বাড়বে। জলাভূমি না থাকলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হবে, ফলে জলাবদ্ধতা বাড়বে। এতে মাটির নিচের পানি স্তর কমে যাবে এবং শহরের পানিসংকট তীব্র হবে। একই সঙ্গে গাছ ও জলাভূমি উধাও হলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে এবং মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠবে।
ঢাকা শহর দিনদিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে মূলত নগরায়ণ ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে। গাছপালা কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক উপায় হারিয়ে যাচ্ছে। কংক্রিটের ভবন ও রাস্তার সংখ্যা বাড়ায় তাপ শোষণ এবং ধরে রাখার মাত্রা বেড়েছে। এ ছাড়া যানবাহনের ধোঁয়া ও শিল্পকারখানার বর্জ্য বায়ুদূষণ সৃষ্টি করে, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। জলাভূমি ভরাটের কারণে শহরের প্রাকৃতিক শীতলীকরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এসব মিলিয়েই ঢাকা শহর ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি এবং গ্রীষ্মকালীন রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তা থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রাণী ব্যাপকভাবে হারিয়ে যায় এবং বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি ঘটে। বাসযোগ্য নগরের জন্য সবুজায়ন, গাছ ও জলাভূমিগুলো সুরক্ষা জরুরি জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট, প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস-মানুষ প্রাণীর খাদ্যসংকট, হাওর-জলাভূমি ও নদীর নাব্য হ্রাস, ভূমিতে অতিরিক্ত বিষপ্রয়োগ, বনদস্যু-মানুষের নির্দয় ব্যবহারের কারণে বন হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
বাঘ, হাতি, হরিণসহ সব প্রাণের অস্তিত্ব যে বন, প্রকৃতি, পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ, মানব জাতির জন্য একান্ত প্রয়োজন তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। নদী, হাওর, খাল-বিল, বন, পাহাড় আছে বলেই তো প্রাণের এত বৈচিত্র্য, আমাদের জীবনে উন্নয়ন, শান্তি, সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্য আছে বলেই আমাদের জীবন এত সুন্দর। এ বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, শ্রদ্ধাবোধের জায়গা তৈরি এবং আমাদের জীবনের জন্যই টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন বন, গাছ, জলাভূমি ও বন্যপ্রাণী।
বনই হচ্ছে প্রাণীর জন্ম, বিচরণ, প্রজনন ও বসবাসের উপযুক্ত জায়গা। দেশের জীববৈচিত্র্যের অফুরন্ত ভান্ডার হচ্ছে বন। যে জীবন প্রাণীর অবাধ মিউজিয়াম। বনই হচ্ছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ধারকবাহক। বন আছে বলেই উদ্ভিদ ও প্রাণী বেঁচে আছে। বন শুধু গাছপালাই রক্ষা করে না, প্রাণিজগৎ বাঁচিয়ে রাখে। বন ধ্বংসের প্রধান কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জ্বালানির চাহিদা মানুষ পূরণ করছে বনের কাঠ দিয়ে। এ ছাড়া বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ, ফসল চাষাবাদ, নগরায়ণ, জুম চাষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বৃক্ষের পরিচর্যার অভাব, পরিবেশদূষণ, পাহাড় কাটা, পাহাড় ধ্বংস, বৃক্ষের রোগ, বনবিধি অমান্যসহ বিভিন্ন কারণে বন ধ্বংস হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন বন্যপ্রাণীর ওপর নতুন বিপত্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া বন্যপ্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। জনসংখ্যার চাপ ও অর্থনৈতিক কারণে বনাঞ্চলে মানুষের মাত্রাতিরিক্ত বৈধ-অবৈধ হস্তক্ষেপের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগে কমে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
দেশে প্রতি বছর কমছে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও গাছ। শালবন কেটে বিমানবাহিনীর ফায়ারিং রেঞ্জ তৈরি করা হয়েছে। তেলের জন্য সেভরন কোম্পানি লাউয়াছড়া বন তছনছ করেছে। আমাদের পাহাড়ি বন পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। পাহাড় আজ খোলা হয়ে গেছে। বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। গাছপালা কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং ছায়া সরবরাহের মাধ্যমে মাটি আর্দ্র রাখে। চারপাশের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখে।
কিন্তু যখন কোনো বন কেটে বা পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন আর্দ্রতা কমে যায়; যার ফলে গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি এবং গ্রীষ্মকালীন রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তার থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রাণী ব্যাপকভাবে হারিয়ে যায় এবং বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি ঘটে। বাসযোগ্য নগরের জন্য সবুজায়ন, গাছ ও জলাভূমিগুলো সুরক্ষা জরুরি। তা না হলে সভ্যতার নগরে আমাদের বসবাস করা দুরূহ হয়ে উঠবে।
পরিবেশকর্মী