কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গাজা কেনাবেচার কোনো সম্পত্তি নয়

সুমন আমীন । সূত্র : সময়ের আলো,

গাজা কেনাবেচার কোনো সম্পত্তি নয়

প্রায় পনেরো মাসব্যাপী ইসরাইলি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর গাজায় বর্তমানে যুদ্ধবিরতি চলছে। এই একপক্ষীয় যুদ্ধে ইহুদি বাহিনী গাজাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এই হামলায় প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষকে হত্যা করেছে ইসরাইল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, সংঘাতের এক বছরে শনাক্ত হওয়া মৃতদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। আহত হয়েছে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার ৪৫৩ জন ফিলিস্তিনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানায়, এই আহতদের মধ্যে ২৫ শতাংশের আঘাত এতটাই গুরুতর যে তাদের জীবন আর আগের অবস্থায় ফিরবে না। বর্বর ইসরাইলি বাহিনী গাজার পুরো অবকাঠামো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।

 



জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টারের (ইউএনওস্যাট) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজার ৭৯ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধকালে যেসব অবকাঠামো নিরাপত্তা এলাকার আওতায় থাকে, যেমন গাজার সে হাসপাতালগুলোকেও পরিকল্পিতভাবে বোমা হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইল। জাতিসংঘের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী চলমান সংঘাতে অন্তত ১ হাজার ৬০ জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন। ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে গাজায় যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয় ইহুদি বাহিনী। স্বল্পকালীন এই যুদ্ধে বিশ্ববাসী যে বর্বরতা প্রত্যক্ষ করল তা সত্যিই বেদনাদায়ক। পৃথিবীর তাবৎ শান্তিকামী মানুষের প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের পরও ইসরাইলি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার মাধ্যমে যেভাবে ফিলিস্তিনের গাজায় মানবিকতার গলা টিপে হত্যা করে তা বিস্ময়কর! হাজার বছরের পথপরিক্রমায় যে গাজায় তারা বসবাস করে আসছে, তাদের সেই জন্মভ‚মি থেকে উৎখাতের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠছে বর্তমান বিশে^র শান্তিপ্রিয় মানুষের আতঙ্কের নাম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

 

 

গত পাঁচ আগস্ট হোয়াইট হাউসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প গাজা নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের অন্য কোনো দেশে পুনর্বাসিত করে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজা দখল করে নিয়ে সেটির মালিক হবে। গাজা হবে ‘সারা বিশ্বের মানুষের বাড়ি’। ট্রাম্পের এই ঘৃণ্য পরিকল্পনা শোনার পর সমগ্র বিশ্বে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ট্রাম্পের মন্তব্য সম্পর্কে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, ‘এটা বেআইনি, অনৈতিক ও পুরোপুরি দায়িত্ব জ্ঞানহীনের মতো কথা। তিনি ( ট্রাম্প) নির্বোধের মতো একটি প্রস্তাব দিয়েছেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।’ ট্রাম্প তার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার জন্য কাজও শুরু করে দিয়েছেন। তিনি জর্ডান, মিসর ও অন্যান্য আরব দেশকে ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার আহ্বান জানান। 

 



গাজার বর্তমান বাসিন্দা প্রায় ২৩ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে ট্রাম্প আসলে মধ্যপ্রাচ্যকে কী করতে চাচ্ছেন? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা ঘোষণার পর কাতারে অবস্থিত জর্জ টাউন বিশ^বিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল আরিয়ান আল জাজিরা টেলিভিশনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের এ ধরনের মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। কারণ আমরা দেখেছি বিগত দেড় বছর ধরে এমন দাবি তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া গাজা যুদ্ধের শুরুতেও ইসরাইলি কর্মকর্তারা যতটা সম্ভব ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। 

 



বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্য কোথাও সরে যেতে বাধ্য করা হলে মহাবিপর্যয়ের মতো কালো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ১৯৪৮ সালের তৎকালীন পৃথিবীর সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ মদদে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড জোরপূর্বক দখল করে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। 

 



ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান ভয়ংকর পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়ন হয়, তা হলে ফিলিস্তিনি জাতি গোষ্ঠীর জন্য তা সর্বশেষ মহাবিপর্যয়ের শামিল হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জঘন্য জাতিগত নিধনের উদাহরণ হয়ে থাকবে গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিন। তবে আশার কথা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের উদ্ভট এই পরিকল্পনার সঙ্গে আরব বিশ্বসহ সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ একমত না। আরব দেশগুলো ট্রাম্পের পরিকল্পনা পুরোপুরি সম্মিলিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনা ঘোষণার পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি আরব বিশ্বের সাতটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে আলোচনায় বসেন।

 



ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার যুদ্ধ-পরবর্তী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করা ছিল তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এ বৈঠক ডেকেছিলেন। বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, কুয়েতের আমির শেখ মেসাল আল আহমাদ আল সাবাহ এবং বাহরাইনের যুবরাজ সালমান বিন হামাদ আল খলিফা। গাজা যুদ্ধ-পূর্ববর্তী আরব বিশ্বে ইহুদি লবিং যেভাবে বিভেদ ও দূরত্ব তৈরি করেছিল, পনেরো মাসব্যাপী গাজার গণহত্যা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্ভট ঘোষণার কারণে তারা আবার ফিলিস্তিন প্রশ্নে এক টেবিলে ফিরল। জাতিগত নিধনের মাধ্যমে দেশ দখল ও জোর করে চেপে বসা, বর্তমান আমেরিকার সাদা মানুষদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। 

 



আমেরিকার আদিমতম অধিবাসী তথা মালিক রেড ইন্ডিয়ানরা। শ্বেতাঙ্গদের পূর্বপুরুষ ইউরোপ থেকে এসেছে। ইউরোপীয় ভূ-পর্যটক মার্কো পোলো বিশ্ব ভ্রমণ করে জানান যে, পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও ধনী দেশ ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষ স্বর্ণ, রুপা ও সম্পদের প্রাচুর্যে পৃথিবীতে অনন্য। ভারতবর্ষের সম্পদের লোভে স্পেনের তৎকালীন রানী ইসাবেলা ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে ইউরোপ থেকে সমুদ্রপথে ভারতে যাওয়ার পথ আবিষ্কার করতে পাঠান। কিন্তু দীর্ঘদিনের সমুদ্রপথ পেরিয়ে কলম্বাস এক নতুন মহাদেশে এসে পৌঁছান। যা ছিল আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের জন্মভূমি। তারপর ইউরোপের দেশগুলো থেকে দলে দলে লোক আসতে লাগল আমেরিকা মহাদেশজুড়ে। বর্বর ইউরোপীয়দের আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে উঠতে না পেরে সহজ-সরল আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজ দেশেই পরবাসী হয়ে বাস করতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘ যুদ্ধ, সংঘাত আর সামরিক শক্তির বলে বলীয়ান ইউরোপীয় জাতি গোষ্ঠী আমেরিকা মহাদেশ নিজেদের করায়ত্ত করে। 

 



জাতিগত নিধন চালিয়ে দেশ দখল করা আমেরিকার পূর্বপুরুষের রক্তে লেগে আছে। যার বর্তমান প্রমাণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণায় মেলে। স্বাধীনতা মানুষের শ্রেষ্ঠতর সম্পদ। কোনো মানুষ, দেশ বা জাতি পরাধীন থাকতে চায় না। স্বাধীনতা মানুষের আজন্ম স্বপ্ন। স্বাধীনতার মূল্য যে কত অমূল্য তা ফিলিস্তিনি জনগণের চেয়ে অন্য কোনো দেশের জনগণ বুঝবে না। গাজায় গণহত্যা চালিয়েও যখন বর্বর ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের পরাজয়বরণ করাতে পারেনি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন এক পরিকল্পনা নিয়ে গাজাকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চাইছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো পরাশক্তি স্বাধীনচেতা ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করতে পারেনি। এত মৃত্যু, ধ্বংস আর নির্যাতনের পরও ধ্বংসস্ত‚প থেকে দ্বিগুণ প্রেরণা নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়াবে ফিলিস্তিন। যার অভিব্যক্তি আমরা ফিলিস্তিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কথায় পাই।

 



 গত শনিবার আফ্রিকার উন্নয়নের শীর্ষ সম্মেলনে মাহমুদ আব্বাস বলেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণকে বাস্তুচ্যুত করার যে কোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি। ফিলিস্তিন বিক্রির জন্য নয়। গাজা, পশ্চিমতীর বা জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের কোনো অংশই ছেড়ে দেওয়া হবে না।’

 



বিধ্বস্ত গাজায় ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়ানোর নয়’ এই দীপ্ত শপথে যারা ভ্যানগার্ডের মতো এখনও সক্রিয়তার সঙ্গে জালিমের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। তারা হলো ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আর আপসহীনতার অগ্রদূত ‘হামাস’। ট্রাম্পের গাজা দখলের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় হামাস তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। 

 



হামাসের সিনিয়র নেতা ইজ্জাত এল-রেসিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের নির্বাসন এবং গাজা উপত্যকার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিবৃতিকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। এ ধরনের বিবৃতি ফিলিস্তিন এবং এই অঞ্চল সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও গভীর অজ্ঞতার প্রতিফলন। গাজা অবশ্যই সাধারণ কোনো ভূখণ্ড নয় এবং এটি এমন কোনো সম্পত্তি নয় যা কেনাবেচা করা যায়। ট্রাম্পের এমন বিবৃতি প্রমাণ করে যে, ইসরাইলের প্রতি এবং আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ও তাদের ন্যায্য অধিকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতিত্ব অব্যাহত। আমরা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এই বিবৃতি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই। কারণ এ ধরনের মন্তব্য আগুনে ঘি ঢালবে।’

 



অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির জোরে সারা পৃথিবীকে কলোনিয়াল যুগের মতো শাসন ও শোষণ করার বিভ্রান্তকর স্বপ্ন দেখছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশে দেশে অন্যায় যুদ্ধ ও শক্তির অপপ্রয়োগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেকে ভিলেনের চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরব বিশ্বের ফিলিস্তিনে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বসহ শান্তিকামী কোটি কোটি মানুষের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে শিগগিরই তার অবসান হবে বলে মনে হয় না। শুধু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলে নেওয়ার ঘোষণা প্রলাপ হয়ে থাকুক- বিশ্বের লাখো কোটি মানুষের এটাই কামনা।