গাজা নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ও আরব রাষ্ট্রগুলোর অগ্নিপরীক্ষা
এ কে এম আতিকুর রহমান । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

২০ জানুয়ারি ২০২৫ ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এর কদিন আগেই ১৫ জানুয়ারি গাজার হামাস যোদ্ধা এবং ইহুদিবাদী ইসরায়েল ছয় সপ্তাহের একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে রাজি হয়। এই চুক্তির অন্যতম বিষয় ছিল গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রত্যাহার ও জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া। ট্রাম্প আন্তরিকভাবে ওই যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, ‘অবশেষে মধ্যপ্রাচ্যে আবার শান্তি ফিরে আসবে।
’ যাহোক, নানা সংকটের মধ্যেও ওই যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি কার্যকর রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং কমপক্ষে এক লাখ ১২ হাজার জন আহত হয়েছেন। তবে এখনো গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে মরদেহ উদ্ধার অব্যাহত রয়েছে।
শপথ গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন বাড়ানোর কথা বললেও আশা করা যাচ্ছিল যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি হয়তো দুটি পক্ষকেই একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে।
কিন্তু কয়েক দিন পরই তিনি বললেন যে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া উচিত। ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরিত করা উচিত। তিনি গাজার ২.৩ মিলিয়ন বাসিন্দাকে মিসর এবং জর্দানে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব করেছেন এই যুক্তিতে যে তারা সেখানে ‘ভালো’ থাকবে। অন্যদিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে গাজাকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ হিসেবে পুনর্গঠিত করার ইঙ্গিত দেন।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে সফররত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিয়ে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন। স্পষ্টভাবেই ওই ঘোষণা যেমন মার্কিন আধিপত্যবাদের নগ্নতার প্রকাশ, তেমনি ফিলিস্তিন সার্বভৌমত্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যানের শামিল।
স্বাভাবিক কারণেই ট্রাম্পের ওই বক্তব্যের ফলে শুধু আরব রাষ্ট্রগুলো বা মুসলিম দেশগুলোতেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি কয়েক দিন আগে ইসরায়েল সফরকালে মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ছয় সিনেটরের একটি প্রতিনিধিদলের সদস্য সিনেটর রিচার্ড ব্লুমেন্থাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে গাজা দখলের যে পরিকল্পনা ট্রাম্প করছেন তার বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘গাজা দখলের জন্য সেনা পাঠানোর যে ঘোষণা তিনি দিয়েছেন, সেই সেনাবাহিনী চলে জনগণের করের টাকায়।
করদাতাদের অর্থে এমন একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা তার জন্য অসম্ভব হবে।’ তিনি আরব অঞ্চলের নেতাদের গাজা পুনর্গঠনসংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা হাজির করার আহ্বান জানান, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংকট নিরসনে বাস্তবসম্মত হবে এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার সমুন্নত রাখবে। তিনি ইঙ্গিত দেন যে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ কিছু লোক ছাড়া কোনো মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের ওই ঘোষণাকে সমর্থন করবে না। তাহলে কোন ধারণায় ট্রাম্প এসব কথা বলতে পারেন? নিশ্চয়ই পেছনের কারণটি অন্য কিছু। সেটি কি তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা যাচাই করা?
আমরা জানি, এ মাসে গাজা ইস্যু নিয়ে মিসরে আরব লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশেষ কারণে তা আগামী ৪ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়। মূলত ট্রাম্পের উদ্যোগের প্রতিক্রিয়ায় আঞ্চলিক সমর্থন বাড়ানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ওই বৈঠক আহ্বান করেছিল মিসর। মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে সম্মেলনের ‘মৌলিক ও যৌক্তিক প্রস্তুতির’ অংশ হিসেবে জোটের সদস্যরা নতুন তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে একমত হয়েছে। তারা গাজা নিয়ে একটি বিকল্প পরিকল্পনা তৈরির কাজ করছে। ওই পরিকল্পনায় ট্রাম্পের সম্মতি রয়েছে বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ওয়াশিংটন সফরকালে ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পের সঙ্গে এক একান্ত বৈঠকে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের ফলে ওই অঞ্চলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি, বিশেষ করে অস্থিতিশীলতা ও ইসলামী উগ্রবাদের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। হয়তো নতুন সম্ভাবনাটি সেই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ঘটতে যাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত যতটুকু বোঝা যায়, ট্রাম্পের পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে ঐক্যের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল আরব রাষ্ট্রগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় আরব নেতারা গাজার জন্য ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিপরীতে একটি ‘পুনর্গঠন পরিকল্পনা’ নিয়ে আলোচনা করার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মিলিত হন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল সৌদের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি, মিসরের রাষ্ট্রপতি আবদেল-ফাত্তাহ আল-সিসি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপতি শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, বাহরাইনের যুবরাজ সালমান বিন হামাদ আল খলিফা এবং কুয়েতের আমির শেখ মিশাল আল-আহমাদ আল-জাবের আল-সাবাহ উপস্থিত ছিলেন।
মূলত এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল ট্রাম্পের সাম্প্রতিক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের ওপর আলোকপাত করা, যাতে ফিলিস্তিনিদের ছিটমহল থেকে না সরিয়ে নেওয়া যায়। ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ এবং গাজা উপত্যকার উন্নয়নের সমর্থনে যৌথ প্রচেষ্টা সম্পর্কে ওই দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে আলোচনার পর বৈঠকটি শেষ হয়। বৈঠকে নেতারা সর্বশেষ ফিলিস্তিনি ঘটনাবলি মোকাবেলায় ৪ মার্চ কায়রোতে অনুষ্ঠিতব্য জরুরি আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনের প্রতি তাদের সমর্থনও ব্যক্ত করেন।
ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আরব দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ হলেও গাজা উপত্যকার প্রশাসন কার হাতে থাকবে এবং পুনর্গঠনের জন্য অর্থায়ন কিভাবে হবে, সেই প্রশ্নগুলো রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওই দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যও বিদ্যমান। যদিও কায়রোতে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে মিসর কী পরিকল্পনা উত্থাপন করতে যাচ্ছে তা জানা যায়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে তিন থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ওই পরিকল্পনায় ১. গাজায় যে ধ্বংসস্তূপ জমে আছে তা অপসারণ করা; ২. গাজার নগর পরিকল্পনা, আবাসন নির্মাণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা; ৩. প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ব্যবস্থা করা; ৪. দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের জন্য একটি রাজনৈতিক পথ উন্মোচন এবং একটি টেকসই যুদ্ধবিরতির জন্য প্রণোদনা সৃষ্টি করা ইত্যাদি বিষয় থাকতে পারে। যাহোক, এসব জানার জন্য আমাদের সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতেই হবে।
এদিকে জাতিসংঘ বলেছে যে গাজা পুনর্গঠনে ৫৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি লাগবে, যার মধ্যে প্রথম তিন বছরের জন্য ২০ বিলিয়নের বেশি প্রয়োজন হতে পারে। আসন্ন সম্মেলনে রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে এই অর্থের সংকুলান কিভাবে করা হবে তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হবে। আর মিসরের পরিকল্পনায় অর্থায়নের বিষয়টিই হয়ে উঠবে এক বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত এ বাবদ অর্থ ব্যয় করার আগে মিসর ও কাতারের কাছ থেকে হামাস ইস্যু নিয়ে কিছু শর্তারোপের উল্লেখ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের পরিবর্তে ‘কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক ফিলিস্তিনি প্রশাসন’-এর হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে।
অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো হয়তো নানা যোগ-বিয়োগের হিসাব করে অর্থায়নে সম্মত হবে। তবে মূল অর্থ জোগানদাতা দেশ যদি মার্কিনদের বন্ধুরাষ্ট্র হয়, তাহলে সেই সমীকরণে যে মার্কিন প্রভাব থাকবে না এমনটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। অন্যদিকে মিসর ও জর্দানের ভূমিকা কী হবে সে বিষয় নিয়েও কথা উঠবে। তবে ওই অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম দেশের (যেমন ইরান, লেবানন, লিবিয়া, ইরাক বা তুরস্ক) প্রতিক্রিয়া কী হবে বা তাদের অবস্থান কোথায় দাঁড়াবে তা হয়তো কায়রো পরিকল্পনাটি ঘোষণা করার পরই স্পষ্ট হবে।
রাজনৈতিক দিক থেকে ওই পরিকল্পনায় হামাসের ভূমিকা কী হবে সেটি যেমন গুরুত্ব পাবে, তেমনি ওই পরিকল্পনা ইসরায়েল কিভাবে গ্রহণ করবে সেই প্রশ্নটিও রয়েছে। যতটুকু জানা গেছে, রিয়াদ গাজার নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে দেখতে চায়। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী কাতারও জোর দিয়ে বলেছে যে গাজার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে হবে ফিলিস্তিনিদেরই। আসলে সব আঞ্চলিক পক্ষই বুঝতে পারছে, তাদের প্রস্তাবিত যেকোনো বিকল্প পরিকল্পনায় কোনোভাবেই হামাস থাকতে পারবে না। কারণ হামাসের উপস্থিতি এটিকে মার্কিন প্রশাসন ও ইসরায়েলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে না। আর পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করতে অবশ্যই ট্রাম্পের সম্মতির প্রয়োজন হবে সেটিও বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাহলে ট্রাম্পের গাজা খেলার এই অগ্নিপরীক্ষায় আরব রাষ্ট্রগুলো কি উত্তীর্ণ হতে পারবে? ফিলিস্তিনিরা কি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি তাদের এই পরিকল্পনায় সম্মত হবে? সব প্রশ্নের শেষে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের একটাই প্রত্যাশা, তারা ফিলিস্তিন বা ইসরায়েল কোথাও আর মানুষের জীবন নিয়ে কোনো নৃশংস খেলা দেখতে চায় না।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব