কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গাজা প্রসঙ্গে আরববিশ্বের এমন অসহায়ত্ব কেন

ড. সুজিত কুমার দত্ত । সূত্র : কালের কন্ঠ, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

গাজা প্রসঙ্গে আরববিশ্বের এমন অসহায়ত্ব কেন

ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম দশকজুড়ে আরব ঐক্য, ইসলামী পরিচয় এবং উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজার মাটিতে ইসরায়েলি বুলডোজারের অত্যাচার, পশ্চিম তীরের রক্তঝরা সংঘাতের মধ্যেও আরব রাষ্ট্রগুলোর কণ্ঠস্বর প্রায় নিঃশব্দ। একদিকে ইরান ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সক্রিয় কূটনীতি, অস্ত্র ও অর্থায়নের মাধ্যমে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’-এর নেতৃত্ব দিচ্ছে; অন্যদিকে মিসর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে ব্যস্ত। এই নীরবতা কি ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার অগত্যা, নাকি নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা? আরববিশ্ব যখন ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা মেরুকরণের দিকে ঝুঁকছে, ইরান এই শূন্যতা পূরণে সক্রিয়।

 

হামাস, ইসলামিক জিহাদের মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে তেহরান কৌশলগতভাবে নিজেকে ‘উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মিত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে এই সমর্থন নিছক মানবতাবাদী নয়, এটি ইরানের জন্য একটি ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার। শিয়াপ্রধান ইরান সুন্নি আরববিশ্বে প্রভাব বিস্তার, সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন জোটের বিপরীতে প্রতিরোধ অক্ষ শক্তিশালীকরণ এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের লড়াইয়ে ফিলিস্তিনকে ব্যবহার করছে। ইরানের এই ভূমিকা সত্ত্বেও শিয়া-সুন্নি বিভাজন এবং ফিলিস্তিনি সংগ্রামের সঙ্গে এর ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক দূরত্ব প্রকট।

 

ফিলিস্তিনিরা ঐতিহাসিকভাবে আরব জাতীয়তাবাদ ও সুন্নি নেতৃত্বের সঙ্গে একাত্ম। তাই ইরানের সাহায্যকে অনেকে ‘বাহ্যিক হস্তক্ষেপ’ হিসেবেই দেখে। তবু হামাসের সামরিক সক্ষমতা এবং গাজায় ইরানি ড্রোনের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধে তেহরানই একমাত্র বাহ্যিক বলয়। অন্যদিকে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদানের মতো রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছে।

 

সৌদি আরব, যদিও এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তবে মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টি এবং অর্থনৈতিক লাভের লক্ষ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখছে। মিসর ও জর্দান ১৯৭০-৮০-এর দশকের শান্তিচুক্তির জেরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

 

একুশ শতকে তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ফিলিস্তিনি সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা বিস্ময়কর। সামাজিক মাধ্যমের ‘Free Palestine’ ট্রেন্ড, গাজায় বোমাবর্ষণের ভাইরাল ভিডিও—এগুলো ক্ষণস্থায়ী আবেগ ছাড়া স্থায়ী কোনো গণ-আন্দোলনের জন্ম দেয় না। পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণ মানুষ মুদ্রাস্ফীতি, জলবায়ু সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত; ফিলিস্তিনকে তারা ‘দূরবর্তী সংঘাত’ হিসেবেই দেখে।

 

 

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো কূটনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানালেও বাস্তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বা অর্থনৈতিক চাপের ভয়ে নিশ্চুপ। আরববিশ্বে স্বৈরশাসকদের দমননীতি গণ-আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। মিসর, সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফিলিস্তিনি পতাকা উত্তোলন করলেই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। ইউরোপে ফিলিস্তিন সমর্থনকে বারবার ‘ইহুদিবিদ্বেষ’-এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়, যা বামপন্থী ও মানবাধিকারকর্মীদের ভীত করে। তরুণ প্রজন্ম, যারা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের কোনো সমাধান দেখেনি, তারা হতাশায় আন্দোলনের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। ফলে ফিলিস্তিনি সংগ্রাম আজ আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় প্রান্তিক।

 

 

আরব রাষ্ট্রনেতাদের সামনে একটি কঠিন দ্বন্দ্ব। একদিকে ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা তাঁদের ফিলিস্তিনের পক্ষে সোচ্চার হতে বলে; অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, পশ্চিমা মিত্রতা এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় ইসরায়েলের সঙ্গে সমঝোতা জরুরি। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এই দ্বন্দ্বের প্রতীক। তিনি ভিশন ২০৩০-এর নামে সমাজকে মডার্নাইজ করার লক্ষ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন, যদিও ২০২২ সালের আরব ব্যারোমিটার জরিপে ৭২ শতাংশ আরব ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা করে। এই দ্বন্দ্বের মূলে আছে প্যান-অ্যারাবিজম এবং রাজনৈতিক ইসলামের পতন। জামাল আবদেল নাসেরের সময়ে আরব জাতীয়তাবাদ ফিলিস্তিনকে সমগ্র আরববিশ্বের সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব ও মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান ফিলিস্তিনকে ইসলামী ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করেছিল। কিন্তু বর্তমানে আরব নেতারা এই ধারাগুলোকে হুমকি হিসেবে দেখেন। মিসরে সিসি সরকার মুসলিম ব্রাদারহুডের সমর্থকদের দমন করেছে, সৌদি আরব সালাফি গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। ফলে ফিলিস্তিন ইস্যু এখন আরব রাজনীতিতেও প্রান্তিক। 

 

 

ফিলিস্তিন ইস্যুতে পশ্চিমা প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। মিসর বছরে ১.৩ বিলিয়ন ডলার মার্কিন সামরিক সাহায্য পায়, যার শর্ত হলো ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমাতে ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে জ্বালানি চুক্তি করছে। মিডিয়া যুদ্ধে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ইসরায়েলি বর্ণনাকে প্রাধান্য দেয়। গাজায় হামাসের রকেট হামলা ‘সন্ত্রাস’, অন্যদিকে ইসরায়েলি বিমান হামলা ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে উপস্থাপিত হয়। আরব মিডিয়াও এখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। আলজাজিরা কিছুটা ব্যতিক্রম, যেটি ইসরায়েলি দখলদারির কঠোর সমালোচনা করে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবের মিডিয়া হাউসগুলো ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীদের গল্প প্রায় উপেক্ষা করে। তাদের সংবাদের ফোকাস বাণিজ্য, বিনোদন এবং সরকারি প্রকল্পের সাফল্য। এই মিডিয়া যুদ্ধ ফিলিস্তিনি সংকটকে বিশ্বব্যাপী ‘স্বাভাবিক’ করে তুলছে। 

 

 

আরববিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমবর্ধমান। বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ২০১১ সালের আরব বসন্তের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলার সময় জর্দান ও মরক্কোতে বিক্ষোভ দেখা গেছে, যা রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সংগঠিত হয়েছিল। সামাজিক মাধ্যম এই প্রজন্মকে সংঘবদ্ধ করতে সাহায্য করছে। তবে একটি টেকসই আরব জাগরণের প্রয়োজন। তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে উৎপাদনশীল অর্থনীতি গড়ে তুলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি), আরব লীগের বিভেদ দূর করে সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। হামাস, ফাতাহর মতো গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অনৈক্য দূর করা এবং আন্তর্জাতিক আইনি লড়াইয়ে জোর দেওয়া। এখানে ইরানের ভূমিকা সীমিত, যেখানে শিয়া-সুন্নি বিভাজন এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তাদের প্রভাব সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে তুরস্ক ও কাতারের মতো রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে সীমিত ভূমিকা রাখছে।

 

 

আরববিশ্বের নীরবতা একাধারে বাস্তবতা ও নৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রগুলো তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় পশ্চিমা মিত্রতার ওপর নির্ভরশীল, যা একটি কঠিন সত্য। কিন্তু এই নীরবতা আরব সমাজের ইসলামী চেতনা ও ঐতিহাসিক দায়িত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, কিন্তু সম্ভাবনার আলো আছে। তরুণ প্রজন্ম, নারী ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে নতুন গণজাগরণের বীজ লুকিয়ে আছে। ফিলিস্তিনের প্রশ্নে আরববিশ্বের নীরবতা শুধু রাষ্ট্রীয় নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর নৈতিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে রাজনীতির হিসাব-নিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়