গাজা টিকলে ফিলিস্তিন টিকবে
মুজাহিদ অনীক । সূত্র : দেশ রূপান্তর, ১২ মার্চ ২০২৫

ইসরায়েলি আগ্রাসনে গাজায় বোমা-বন্দুকের আওয়াজ থামতে না থামতেই যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট গাজার জন্য নতুন এক পরিকল্পনা হাজির করেছেন; যার সারকথা হলো গাজাবাসীকে উঠিয়ে নিয়ে নতুন কোনো জায়গায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এমন তুঘলকি ব্যাপার তিনি কল্পনা করতে পেরেছেন, কারণ তিনি ট্রাম্প। অবশ্য পশ্চিমা শাসকরা ফিলিস্তিনিদের জীবন নিয়ে দশকের পর দশক ধরে যা করে যাচ্ছেন, তা ট্রাম্পের কল্পনার মাত্রার চেয়ে কম কিছু নয়। নিজেদের নীলনকশায় এসব শাসকের পূর্বসূরিরা গোটা একটা জনগোষ্ঠী এবং ভূখন্ডকে বিলীন করে দেওয়ার সব আয়োজনই করে গেছেন। অবশ্য ট্রাম্পের এ প্রস্তাব নিয়ে তার প্রশাসনের কর্তাদের নানা মত পাওয়া যাচ্ছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন যে ট্রাম্প গাজাবাসীকে উচ্ছেদ করার কথা বলেননি, বরং তিনি পুনর্গঠন কাজের ইঙ্গিত করেছেন। কিন্তু কর্মকর্তারা যাই বলুক না কেন; ট্রাম্পসহ গোটা পশ্চিমা দুনিয়া ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে এরূপ পরিকল্পনার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখেছে। হয়তো ট্রাম্প ব্যাপারটায় কোনো রাখঢাক করেননি। তফাৎ এটুকুই পশ্চিমা শাসককুল চক্ষুলজ্জার ব্যাপারটা ভেবেছেন, ট্রাম্প সে সবের ধার ধারেননি। যদি তাই না হতো; তাহলে কি গাজা অবরুদ্ধ এক উপত্যকায় পরিণত হতো; আর পশ্চিম তীর ক্রমে ক্রমে ইহুদি বসতিতে রূপান্তরিত হতো? নিশ্চয়ই নয়। আর হ্যাঁ, ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও যে এ ধরনের চিন্তাভাবনা রয়েছে, তা পরিষ্কার। কারণ, ট্রাম্প যে পরিকল্পনা হাজির করেছেন, তা উত্থাপনের সময় হোয়াইট হাউজে তার পাশেই ছিলেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। অর্থাৎ, গত ২৫ বছর ধরে ইসরায়েলের শাসকরা ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র অধিকারের স্বপ্নকে যেভাবে বিস্মৃতপ্রায় করে দিয়েছেন, ট্রাম্পের বয়ান সেটিরই প্রতিরূপ। নেতানিয়াহু ও ডানপন্থি মিত্ররা ইসরায়েলের রাজনৈতিক পরিসরে এ কথা জোর গলায় বলেন যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে তারা সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে প্রতিহত করবে।
ইয়াসির আরাফাত এবং আইজ্যাক রবিনের মধ্যে সই হওয়া ‘অসলো চুক্তির’ মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রসত্তার ভবিষ্যৎ কল্পনা করা সম্ভব হয়েছিল; এখন তা চূড়ান্তভাবে অপসৃত। ইসরায়েলি রাজনীতিকদের অধিকাংশই এখন দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলেন না। সেখানে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির মানুষজন ক্রমশ কোণঠাসা। স্পষ্টত, ট্রাম্প গাজাবাসীকে সরানোর মধ্য দিয়ে যা করবেন, তা ইসরায়েলি বয়ানের কাছাকাছি। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ফিলিস্তিনিরা দশকের পর দশক ধরে যে ‘জাতিগত নিধনের’ মুখোমুখি, ট্রাম্পের বক্তব্য সেই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করারই নামান্তর। বর্তমান বিশ্বে পশ্চিম তীরের জাতিগত নিধনের একমাত্র ধ্রুপদী উদাহরণ। সেখানে ইহুদি বসতি চলছে জবাবদিহি ও আন্তর্জাতিক আইনকে পদদলিত করে। ইসরায়েলি প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার প্রত্যক্ষ মদদে ফিলিস্তিনিদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ইসরায়েলকে কোনোভাবেই থামাতে পারছে না। যে হারে ফিলিস্তিনিরা ভূমি হারাচ্ছে, একদিন হয়তো দেখতে হবে হাইফা বন্দর অবধি কোনো ফিলিস্তিনি বসতি আর অবশিষ্ট নেই। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্র্তৃপক্ষ (পিএ) জনগণের ভূমি রক্ষাকারী কিংবা শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হিসেবে কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারেননি, যার দ্বারা ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। ঠিক এ জায়গায় গাজা অনন্য। গাজায় ফিলিস্তিনি জনতা প্রতিরোধটুকু জারি রাখতে পেরেছেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, গাজা এক খ- ফিলিস্তিন হিসেবে স্বকীয়তার পুরোটা ধরে রেখেছে। অন্তত ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও জনসমষ্টির বিশেষত্বকে গাজাবাসী নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের লেশটুকু হিসেবে অটুট রেখেছে। এখন ট্রাম্প বা ইসরায়েলি শাসকরা গাজার এই বিশেষত্বের ওপর ছুরি চালাতে চায়। ছোট্ট ভূখণ্ড গাজার ২২ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করতে পারলে ইসরায়েল ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে নিজ ভূমির অবাধ যাতায়াত তৈরি করতে পারবে। ইসরায়েলের ডানপন্থি নেতাদের মনোবাসনা তাই-ই।
ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্রে যত প্রেসিডেন্ট এসেছেন ট্রাম্প পশ্চিমা ঐক্য অটুট রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নেতিবাচক চরিত্র হলেও ইসরায়েলনীতির প্রশ্নে এই রিপাবলিকান সবচেয়ে ইতিবাচক চরিত্র। দেখা গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে কিংবা ইউরোপীয় মিত্রদের এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রে তিনি দ্বিধাহীন। অথচ ইসরায়েলের অস্তিত্ব আর আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপের পক্ষে তিনি যেমন ছিলেন তেমনি, যা চিরাচরিত মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল্যবোধ। আগের মেয়াদে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করেছে। সেইসঙ্গে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ইসরায়েলের সহাবস্থান জোরদার করতে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’ সই করিয়েছে তারা। গাজার ৪৮ হাজার মানুষকে হত্যা করার পরও ইসরায়েলের সমর্থনে ওয়াশিংটনের ছাতা একটুও নড়চড় হয়নি।
এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের গাজা পরিকল্পনা সামনে আসার পর আরব বিশ্বে ওয়াশিংটনের মিত্ররা বেশ বিপাকে পড়েছে। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি আবেগ ও সমর্থন; অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওইসব দেশের বিদ্যমান সম্পর্ক এ দুয়ের মধ্যে থেকে গাজানীতি প্রণয়ন করতে হবে। ফলে, ট্রাম্পের প্রস্তাবকে খোলাখুলিভাবে নাকচ করেছেন এসব শাসক। এ অবস্থায় আরব লিগের তত্ত্বাবধানে আরব দেশগুলো মিসরের আনা একটি প্রস্তাবকে গ্রহণ করেছে, যেটি যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠনে বিপুল অর্থের জোগান দেবে। বলা হচ্ছে, চলতি মাসের ৪ তারিখ গাজা পুনর্গঠনে আরব দেশগুলো সম্মিলিতভাবে পাঁচ হাজার ৩০০ কোটি ডলার অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রক ফাতাহ এবং পিএ’র পাশাপাশি গাজার শাসক হামাস আরব শাসকদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। ইউরোপও প্রস্তাবটিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবফেল ফাত্তাহ আল সিসি জানিয়েছেন, পুনর্গঠন পরিকল্পনাটির মেয়াদ হবে ২০৩০ সাল অবধি। সিসির ভাষ্য অনুযায়ী, মোট তিনটি ধাপে পুনর্গঠন পরিকল্পনাটিকে সাজানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং গাজা শাসনের রূপরেখা এভাবে তিনটি ধাপে বাস্তবায়িত হবে পরিকল্পনাটি। অবকাঠামো উন্নয়নের আওতায় গাজা সড়ক যোগাযোগ, টেলিকমিউনিকেশনসহ আরব দেশগুলোর প্রস্তাবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তরটি হলো গাজার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোসংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি। আরব শাসকরা গাজাকে হামাসের হাত থেকে নিয়ে একটি ফিলিস্তিনি ব্যবস্থার হাতে ন্যস্ত করার কথা বলছেন। আরব নেতাদের ভাষায় এই শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘টেকনোক্রেটিক গভর্নমেন্ট’, যা ধীরে ধীরে পিএ শাসনের পথ প্রশস্ত করবে। এ বিষয়ে হামাস কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, যারা ২০০৭ সালে ফাতাহ তথা পিএ প্রশাসনকে উপত্যকা থেকে উচ্ছেদ করেছে। বাস্তবে আরব নেতাদের এ প্রস্তাব কতটা কার্যকর হবে, তা এখনই বলার সময় হয়নি।
এখন আরব বিশ্ব এবং মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান পৃথক দুটি বিন্দুতে বলে মনে হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের পুতুল শাসকরা এরই মধ্যে ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে। তাদের এ বিরোধিতার কারণ বোঝা খুবই সহজ। ১৯৪৮ সাল থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা জর্ডান, লেবানন, সিরিয়া, মিসরসহ নানা দেশে আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। গাজা বা পশ্চিম তীর থেকে আরও বেশি উচ্ছেদের ফল হলো এসব দেশে আরও শরণার্থীর স্রোত তৈরি হওয়া। বিশেষ করে মিসর ও জর্ডান সম্ভাব্য শরণার্থী স্রোতের মূল গন্তব্য হবে; কারণ তারাই প্রধান দুই প্রতিবেশী। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও গাজাবাসীর প্রতিরোধটুকু জারি রাখতে হবে। গাজা টিকে থাকলে ফিলিস্তিনিদের অধিকারবোধের শৌর্য টিকে থাকবে। যেহেতু পশ্চিম তীরে ফাতাহ এবং পিএ প্রশাসনের ভূমিকায় খোদ ফিলিস্তিনিরাই নাখোশ, তাই গাজায় হামাসে জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। তা ছাড়া পিএ কর্তাদের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রশাসনের সঙ্গে তাদের আপসরফার কথা শোনা যায়। ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা দফায় দফায় বাস্তুচ্যুত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের সেই স্বাধীনতার বীজ মরে যায়নি।
১৯৮৮ সালে হামাস প্রতিষ্ঠালাভের থেকে স্পষ্টভাবেই বলে আসছে যে তারা জর্ডান নদীর তীর থেকে ভূমধ্যসাগরের তটরেখা পর্যন্ত স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন দেখে। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালের পূর্বতন সীমানার ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্র সমাধান এ সংকটের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বাস্তবায়নযোগ্য সমাধান হিসেবে তাত্ত্বিকদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে ক্রমে ক্রমে মাথা তোলা ইসরায়েল ভূখণ্ডের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতির পটভূমিতে তা কীভাবে আলোর মুখ দেখবে, সেটা এখন জটিল এক প্রশ্ন। আবার ফিলিস্তিনিদের লাঞ্ছিত-বঞ্চিত করে এই প্রশ্নকে ধামাচাপা দেওয়া সম্ভব না। ট্রাম্পের নতুন পরিকল্পনা সেই ব্যর্থতার আরেক অধ্যায়ই হবে। সম্ভবত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আরেক ইন্তিফাদার জন্ম দেবে, নয়তো ২০২৩ সালের ৭ অক্টবরের মতো কোনো সহিংস প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত দেখা যাবে। বস্তুত ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধ, নিষ্পেষণ ও নিপীড়নেও গাজার জাতিগত স্বকীয়তা বিলীন করা যায়নি। মিসরের হাত থেকে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গাজা দখলে নেওয়ার পর জায়নবাদী শাসকগোষ্ঠী মোটেও স্বস্তিতে ছিল না। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুদের উচ্ছেদ পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ সংকটাপন্ন, বরং ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধযুদ্ধই ন্যায্য এবং অবধারিত সত্যরূপে ফিরে আসবে।
লেখক: বিশ্লেষক ও অনুবাদক