কল করুন

কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স

গাজার যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ

ড. ফরিদুল আলম । সূত্র : কালের কণ্ঠ, ৪ জানুয়ারি ২০২৫

গাজার যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণ

গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনার মাঝেই নতুন বছরের প্রথম দিনে জাবালিয়া ও মধ্য বুইরেজ শরণার্থী শিবির এবং খান ইউনিস শহরসহ বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, যেখানে শিশুসহ ২২ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এর আগে গাজায় চালু থাকা শেষ হাসপাতালটিতে হামলার ফলে বন্ধ হয়ে গেছে সেটিও, চিকিৎসাব্যবস্থায় পুরোপুরি ধস নেমেছে। এই অবস্থায় কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যস্থতায় যে যুদ্ধবিরতি আলোচনা চলছিল, সেটি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সময়কালের মধ্যে শেষ করে এ বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব কি না, তা নিয়ে গভীর সংকট দেখা দিয়েছে। দূরত্ব বেড়েছে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যেও।

দুই মাসের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানো নিয়ে দুই পক্ষের তরফ থেকে যে প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে আপত্তি তুলেছে ইসরায়েল। হামাসের পক্ষ থেকে ৩০ জন জিম্মিকে মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি হামাসের সদস্যদের মুক্তি এবং গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহের পথ উন্মুক্ত করার দাবি জানানো হলে ইসরায়েল সব জিম্মিকে জীবিত মুক্তি ছাড়া যুদ্ধবিরতিতে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। তা ছাড়া হামাসের তালিকা অনুযায়ী সবাইকে মুক্তি দিতেও অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমন অবস্থায় আগামী ২০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষে কোনো ধরনের চুক্তির কৃতিত্বপ্রাপ্তির আর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

এ ক্ষেত্রে গাজায় অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিরতি হতে যাচ্ছে কি না, বিষয়টির অনেকটাই পরবর্তী মার্কিন প্রশাসনের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগে তার নির্বাচনকালীন প্রচারণায় গাজা এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন। যত দূর বোঝা যাচ্ছে, তিনি এখন পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টি তার অগ্রাধিকারের তালিকার সবচেয়ে ওপরে রেখেছেন। অন্যদিকে রাশিয়ার দিক থেকে এই যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে নানা ধরনের শর্তের বিষয় সামনে চলে আসছে, যেগুলো মেনে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন এবং ইউরোপের জন্য অনেকটা পরাজয়ের শামিল, অর্থাৎ ইউক্রেনে রাশিয়ার দখল করা এলাকাগুলো ছেড়ে দিতে হবে এবং ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করতে হবে।

এই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি না করে কিংবা উভয় যুদ্ধ নিয়ে যুগপত্ভাবে ট্রাম্প বা তার প্রশাসন কাজ করে যাবে কি না, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রসিডেন্ট বাইডেনের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে এই দুটি যুদ্ধ বর্তমানে যে অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে, এগুলো বন্ধ করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের অন্য মূল্য চোকাতে হবে। যদি সত্যি গাজার যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ক্ষীণযুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়, তাহলে নতুন করে পুনর্বাসন এবং যুদ্ধের ক্ষত সারাতে যে অর্থের প্রয়োজন হবে, সেটির বড় অংশেরই জোগান দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। আবার এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলেও অর্থ এবং অস্ত্রের একটি বড় অংশের চালান দিতে হবে তাদেরই। এককথায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক কঠিন জঞ্জাল রেখে তার দায়িত্ব শেষ করতে যাচ্ছেন।

 

ধরে নিই, ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর রাশিয়া-ইউক্রেনের মতো গাজা যুদ্ধ বন্ধের জন্যও উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগের ধরনটা কেমন হবে। এরই মধ্যে তিনি যুদ্ধবিরতি কিংবা যুদ্ধ বন্ধের জন্য শর্ত দিয়েছেন। গত ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি এক বক্তব্যে জানিয়েছেন যে হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের ২০ জানুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দেওয়া হলে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হবে, যা হামাসের প্রতি এক পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর আগে ডিসেম্বর মাসের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বার্তায় তিনি বলেছিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার জন্য যারা দায়ী, তাদের মূল্য চোকাতে হবে। এমনভাবে তাদের আঘাত করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কেউ কখনো দেখেনি।’ আমরা জানি, ১৫ মাস ধরে যে সহিংসতা, হত্যাযজ্ঞ এবং মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে, এটি একতরফা। হামাসের ক্ষুদ্র শক্তির তুলনায় ইসরায়েলের মতো প্রশিক্ষিত বাহিনী এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পরিচালিত হয়ে আসছে এ ধরনের সব ঘৃণ্য কাজ। এর মধ্য দিয়ে এটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে ট্রাম্পের এই হুমকি ইসরায়েলকে উদ্দেশ করে। তার মানে এটিই ধরে নেওয়া যায়, তিনি ইরানকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলেছেন। তার এই হুমকির বিষয়টি যদি তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর কার্যকরের উদ্যোগ নেন, তাহলে সন্দেহাতীতভাবেই এই যুদ্ধ বন্ধ বা বিরতির সম্ভাবনার পরিবর্তে আরো বিস্তৃত হবে এবং ইরান নতুন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। সেদিক দিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় বাইডেন যদি দুই পক্ষকেই অন্ততপক্ষে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি করাতে সক্ষম হন, তাহলে কিছুটা রক্ষা হতে পারে। অন্যথায় আরো ভয়ংকর পরিণতির দিকে যেতে পারে গোটা পরিস্থিতি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি ইসরায়েলের স্বার্থ বাদ দিয়ে সাধন করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল নীতি নিয়ে অতীতেও ডেমোক্রেটিক বা রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের মধ্যে কোনো মতভেদ দেখা দেয়নি, ভবিষ্যতেও এর সম্ভাবনা কম। উপরন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি একটু বেশি সদয় বলা যেতে পারে, অন্যদিকে ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্বও বাইডেনের চেয়ে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ট্রাম্পের ওপর অধিক আস্থাশীল—এমনটা বললেও খুব একটা ভুল হবে না। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সফরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সে দেশের কংগ্রেসে ভাষণ দেওয়ার পর ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে ছুটে যান ফ্লোরিডায় তার অবকাশযাপন কেন্দ্রে। ধারণা করা যায়, দুই নেতার সেই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইহুদি ভোটারদের ট্রাম্পের প্রতি সমর্থনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কিছু গোপন বোঝাপড়া হয়ে থাকাটাও অসম্ভব কিছু নয়। অনেক বছর ধরেই হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনে করে আসছে। ট্রাম্প এ ক্ষেত্রে সব সময়ই ইসরায়েলের স্বার্থের বিষয়ে অধিক মনোযোগী। সেই ট্রাম্প এখন নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় ইসরায়েলের সঙ্গে তার বোঝাপড়ার জায়গাটিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, এটিই স্বাভাবিক। তা ছাড়া তার সাম্প্রতিক ঘোষণা এবং পরোক্ষ হুমকি দ্বারা এটিও ধারণা করা যেতে পারে যে এর মধ্য দিয়ে তিনি যে কেবল হামাস বা ইরানকে হুমকি দিয়েছেন তা-ই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অপরাপর পক্ষ, যারা এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের পক্ষে যুদ্ধ করেছে, তারা সবাই ট্রাম্পের ভবিষ্যতের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। তাদের মধ্যে রয়েছে লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতিরাও। তাই এমনটা ধারণা করা যেতেই পারে যে ট্রাম্পের সময়কালে এই যুদ্ধের দ্রুত নিষ্পত্তির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অভিন্ন শত্রুদের বিরুদ্ধে আরো বিস্তৃত পরিসরে যুদ্ধ পরিচালনা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হামাস একটি উপলক্ষ মাত্র।

এসব অনুমানকে ছাপিয়ে পাল্টা কিছু অনুমানও করা যেতে পারে। ধরা যাক, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হলো। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার যে মনোযোগ, সেটি গিয়ে ধাবিত হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। ইরানের সঙ্গে তাদের যে কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে, বর্তমান সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে সেটি খুব একটা কার্যকর নেই, যার কারণে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন ঘটেছে, ইরান দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং গাজা যুদ্ধ ও এর মধ্য দিয়ে ইরানপন্থী সংগঠনগুলোকে মদদ দেওয়ার কারণে ট্রাম্প ইরানের প্রতি অধিক মারমুখী হয়ে উঠলেন। এ ক্ষেত্রে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি ইউক্রেন থেকে মনোযোগ সরিয়ে ইরানের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতায় মনোযোগ দেন, সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দুই বৃহৎ শক্তি মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমান সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কৌশলগত স্বার্থ সম্পৃক্ত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এমনটি হলে ট্রাম্প যে পরিকল্পনা করছেন, সেটি বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

এখানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প—উভয়েই এই যুদ্ধ বন্ধ করতে উৎসাহী। তবে দুজনের কৌশল দুই রকমের। বাইডেন এই মুহূর্তে তাড়াহুড়া করে একটি যুদ্ধবিরতি করে তার মেয়াদের অনেক বিতর্ক ছাপিয়ে কিছুটা আলো ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ হুমকি দিয়ে ইসরায়েলবিরোধী পক্ষগুলোকে দুর্বল করতে চাইছেন। তবে বাস্তবে ইসরায়েল যে এই মুহূর্তে বাইডেনের কোনো ধরনের চাওয়ার বিষয়ে খুব একটা তোয়াক্কা করছে না, সেটা সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধবিরতি আলোচনা চলা সত্ত্বেও গাজায় তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে যাচ্ছে। সুতরাং যুদ্ধবিরতির সব সম্ভাবনা ছাপিয়ে গাজা যুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।


লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়