গাজায় গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষে বিশ্বায়নের দায়
আশেক মাহমুদ [সূত্র : আমাদের সময়, ২১ আগস্ট ২০২৫]

গাজাবাসী এখন শুধু গণহত্যার শিকার নয়, দুর্ভিক্ষেরও শিকার। ৭৫ বছর ধরে চলমান ইসরায়েলি গণহত্যার ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৬১ হাজারের বেশি গাজাবাসী শহীদ হন। নির্মমভাবে আহত হন ১ লাখ ৪৩ হাজার নারী, শিশু ও পুরুষ। যারা বেঁচে আছেন তাদের জন্য চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ইসরায়েলি বোমার আঘাতে গাজার ৯৫ শতাংশ হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে আহতদের উদ্ধার করার কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে পড়েছে। গাজার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিও ইসরায়েলি টার্গেটে পড়েছে। শুধু তাই নয়, যারা বেঁচে আছেন তাদের প্রতিটি দিন যায় মৃত্যুর শঙ্কায়।
খাদ্যের অভাব, পানির অভাব, ওষুধের অভাব এখন তাদের নিত্যদিনের সাথি হয়ে গেছে। গাজার ওপর ইসরায়েল এমনভাবে অবরোধ আরোপ করেছে, যেন গাজাবাসী খাদ্যাভাবে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল সিবিএস নিউজকে জানান, “শিশুমৃত্যু ‘সীমা ছাড়িয়ে গেছে’ এবং এটা ‘ভয়াবহ’। অসংখ্য শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, যাদের ‘কান্না করার মতো শক্তিও অবশিষ্ট নেই’। হাজারো শিশু আহত হয়েছে। তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকতে পারে। হাজারো শিশু তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে।” এদিকে ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবিক ত্রাণ সম্মেলন উদ্বোধনের সময় গত ১৭ মার্চ ইইউর বৈদেশিক নীতিমালাবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছিলেন, ‘গাজা এখন আর দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে নেই, বরং সেখানে দুর্ভিক্ষ চলছে এবং হাজারো মানুষ এর ভুক্তভোগী।’ এটি কোনো প্রাকৃতিক দুর্ভিক্ষ নয়, বরং ইসরায়েল-সৃষ্ট।
এ থেকে স্পষ্ট যে, গাজাবাসীর বিরুদ্ধে এখন ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল। অধিকাংশ মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তাদের খাদ্যসংস্থান এতই অপ্রতুল যে, গাজাবাসীর জন্য যেখানে দিনে প্রয়োজন ৬০০ ট্রাক খাবার সহায়তা, সেখানে দিনে আসছে ২৮ ট্রাক খাবার। মার্চ মাস পর্যন্ত পুরো গাজা এতটাই অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল যে, কোনো খাদ্য সহায়তা তারা পায়নি। গাজায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য অপেক্ষমাণ ৯৫০ ট্রাক সমপরিমাণ সাহায্য রয়েছে, যা তারা অবরোধের কারণে সংগ্রহ ও বিতরণ করতে পারেনি। সারাবিশ্বের মানবিক সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে স্থবির হয়ে গেছে। মে মাসের শেষে সীমিতসংখ্যক ট্রাক ঢুকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেছেন, গাজায় যে পরিমাণ ত্রাণ রয়েছে, তা মরুভূমিতে এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো। এদিকে খাদ্যের অভাবে খাদ্যের দাম আগের চেয়ে ৪০ গুণ বেড়েছে।
গাজাবাসীর ওপর অত্যাচার কতটা নির্মম হলে অভুক্ত নারী-শিশুদের গুলি করে হত্যা করা হয়? বিশ্বায়নের এই যুগে শুধু ভোগের উৎসবই চলছে না, গণহত্যাও চলছে, চলছে দুর্ভিক্ষ। আমরা মানি বা না মানি, পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতাকে এর দায় নিতে হবে সবার আগে। পাশ্চাত্য সভ্যতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই শুধু সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়নি। যুদ্ধ আর জবরদখলকেও উসকে দিয়েছে। অতীতের মতো আজও জবরদখলনীতি চালু আছে। সেই জবরদখলের শিকার ফিলিস্তিন। পুঁজিবাদী ইসরায়েল তার আগ্রাসী নীতির মধ্য দিয়ে ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনের ভূমি জবরদখল করে চলছে। ফিলিস্তিনবাসী এই জবরদখলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল বলে বহু ধাপে গণহত্যা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এই গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। ইউরোপের দেশগুলো যেহেতু মার্কিন বলয়কে আঁকড়ে ধরে আছে, সে কারণে ইসরায়েলি জবরদখল আর গণহত্যাকে সমর্থন দিয়ে চলছে ইউরোপের দেশগুলো।
পুঁজিবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থা বিশ্বকে এতটাই অমানবিক করে তুলেছিল যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আগ্রাসী ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। পুরো আরববিশ্ব তেলসম্পদে ভরপুর। সেই তেলসম্পদ আগামীতে মার্কিন দখলদারত্বের আওতায় আনতে আমেরিকা ইসরায়েলকে কাজে লাগাচ্ছে। বস্তুগত বিশ্বব্যবস্থায় বৈশ্বিক পুঁজি হিসেবে জ্বালানিসম্পদের গুরুত্ব অনেক বেশি বেড়েছে। এই সম্পদকে শুধু ডলারনীতির বাণিজ্যে নিয়ে আসাই পাশ্চাত্য পুঁজিবাদীদের লক্ষ্য নয়, তাদের লক্ষ্য এই সম্পদ দখল করা। এই দখলদারত্ব নিশ্চিত করতে ইসরায়েল সামরিক নীতি গ্রহণ করে। সম্প্রতি ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে জর্ডান উপত্যকাসহ পুরো অধিকৃত পশ্চিম তীর ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। এভাবে ইসরায়েলের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করাই তাদের লক্ষ্য। এই সম্প্রসারণবাদ পুঁজিবাদেরই সম্প্রসারণ। আমেরিকার নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের সমর্থনে এমন বর্বর সম্প্রসারণ চলছে।
গোটা পাশ্চাত্যের সমর্থন পেয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজাকে হলোকাস্ট বানিয়ে রেখেছে। ইসরায়েল দেখেছে, আরববিশ্ব পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী নীতিতে সৃষ্ট ভোগবাদী ব্যবস্থার কোলে আশ্রয় নিয়েছে। এতে করে আরবের রাজা-বাদশাহরা জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামের মৌলিক নীতিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা এখন ইসরায়েলের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করছে। ইসরায়েলের কাছে শুধু তেল বিক্রিই করছে না, ইসরায়েলকে জাহাজ ভরা অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। এদিকে জনগণের সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশ্বিক প্রভাবশালী শক্তির কাছে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। আধুনিক বিশ্বায়নের এই যুগে আধুনিক রাষ্ট্র তো জনগণের অধিকার সুরক্ষা দেওয়ার কথা। কোনো রাষ্ট্র যদি সুরক্ষা দিতে না পারে, তখন জাতিসংঘ দায়িত্ব পালন করার কথা। কোনো ভূখণ্ডে যুদ্ধাপরাধ হলে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে তার ফয়সালা হওয়ার কথা। অথচ জাতিসংঘকে এমনভাবে মার্কিনিকরণ করা হয়েছে যে, মার্কিন ইশারা ছাড়া জাতিসংঘ কাজ করতে অনিচ্ছুক।
আরব লীগ, ওআইসির প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল আরব দেশের তথা মুসলমানদের সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান নিশ্চুপ হয়ে আছে। কারণ, সদস্য রাষ্ট্রের শাসকরা মার্কিন তোষণনীতিতে সক্রিয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দায়িত্ব ছিল হারিয়ে যাওয়া মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা। মার্কিন-ইসরায়েলি প্রভাবে এসব সংস্থা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। যেখানে বৈশ্বিক মিডিয়ার কাজ হলো ইসরায়েলি অত্যাচারের সব বাস্তব চিত্র সারাবিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, সেখানে এসব মিডিয়া এমনভাবে তথ্য প্রচার করছে- যেন এসব সাধারণ ব্যাপার। সড়ক দুর্ঘটনার মতো সংবাদমাত্র।
বৈশ্বিক গণজাগরণ ছাড়া ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হবে না। চেতনার জাগরণ আর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এখানে অত্যাবশ্যক। জাতিসংঘের সংস্কারও জরুরি। সমস্যা হলো সংস্কার করবে কে? এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে উদ্যোগী হতে হবে সে দেশের জনগণকে। সম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করায় যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৮০ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার, ডিগ্রি প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন ধরনের সাজা দেওয়া হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় এখনও স্বাধীন সত্তায় পরিণত হতে পারেনি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীন সত্তায় পরিণত করতে হবে। সেখান থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার জন্ম হবে। আরব দেশের জনগণকে রাষ্ট্র সংস্কারে এগিয়ে আসতে হবে। আস্তে আস্তে প্রতিটি দেশের জনগণ যত বেশি রাষ্ট্র সংস্কারে ভূমিকা রাখতে পারবে তত বেশি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করা সম্ভব হবে। এক পর্যায়ে জাতিসংঘ মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত হবে। তখনই ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সহজ হবে।
গণজাগরণের বিশ্বায়ন ছাড়া ঘুণে ধরা বিশ্বায়নের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা আর গণহত্যা দেখতে চাই না, রক্তপাত চাই না, অত্যাচার চাই না, জনগণের মুক্তি চাই। আগামীর পৃথিবী হোক মুক্তির পৃথিবী।
ড. আশেক মাহমুদ : সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা